ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইংরেজী নববর্ষ ও আমাদের সংস্কৃতি

রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইংরেজী নববর্ষ ও আমাদের সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইংরেজী নববর্ষ ও আমাদের সংস্কৃতি

একটি জাতির সংস্কৃতি সেই জাতির নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদি সামগ্রিক পরিচয় স্পষ্টভাবে ধরে রাখে এবং তা বিশ্ব দরবারে সেই জাতির আত্মপরিচয়কে বুলন্দ করে দেয়। মূলত সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির আয়না। সংস্কৃতির বহুবিধ উপাদানের মধ্যে নববর্ষও অন্যতম। আমরা যাকে ইংরেজী সন বা খ্রিস্টাব্দ বলি, আসলে এটা হচ্ছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। বাংলা ভাষায় অব্দ শব্দের চেয়ে সন ও সাল দুটি বেশি পরিচিত ও সর্বাধিক প্রচলিত। সন শব্দটি আরবী এবং সাল শব্দটি ফারসী। সন ও সাল এই শব্দ দুটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যজাত, আমাদের তমদ্দুনীয় উৎস সঞ্জাত। আমাদের দেশে বর্তমানে তিনটি সন প্রচলিত রয়েছে আর তা হচ্ছে হিজরী সন, বাংলা সন ও ইংরেজী সন। এখানে হিজরী সনের প্রচলন হয় যেদিন এখানে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে তখন থেকেই। এই হিজরী সন মুসলিম মননে পবিত্র সন হিসেবে গৃহীত। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মুনওয়ারায় হিজরত করেন। ইসলামের ইতিহাসের সেই দিগন্ত উন্মোচনকারী ঘটনাকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে এই হিজরী সন। ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হযরত উমর রাদিআল্লাহু তায়ালা আন্হুর খিলাফতকালে তারই উদ্যোগে হিজরতের বছর থেকে হিসাব করে হিজরী সনের প্রবর্তন করা হয়। সেটা ছিল হিজরতের ১৭ বছর। যতদূর জানা যায়, তারই পরের বছর থেকে বাংলাদেশে সাংগঠিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয়- আর তখন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা)-এর খিলাফতের মধ্য ভাগ। অবশ্য প্রায় ১০/১২ বছর আগে থেকেই বাংলাদেশে সমুদ্রপথে ইসলামের খবর এসে পৌঁছতে থাকে। ইসলামের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে হিজরী সনেরও আগমন ঘটে, কারণ এই সনের বিভিন্ন মাসে ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান, ইবাদত-বন্দেগীর নির্দিষ্ট দিন-রজনী, তারিখ ও নির্দিষ্ট মাস প্রভৃতি রয়েছে। এই হিজরী সনই বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত সবচেয়ে পুরনো সন। ১২০১ খ্রিস্টাব্দে সিপাহ্সালার ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বিন বখ্তিয়ার খিল্জী বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের বিজয় নিশান উড্ডীন করেন- আর তখন থেকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজরী সন বাংলাদেশে প্রচলিত হয়, যা ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। সুলতানী আমলে কি মুঘল আমলে রাষ্ট্রীয় কাজ-কর্মে, আদান-প্রদান তথা সর্বক্ষেত্রে হিজরী সনই প্রচলিত ছিল। অবশ্য মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে ঋতুর সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি সৌর সনের তাকিদ রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে দেখা দেয়ায় হিজরী সনকেই সৌর গণনায় এনে একটি রাজস্ব বা ফসলী সনের প্রবর্তন করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, হিজরী সন চান্দ্র সন হওয়ায় ঋতুর সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকে না। সম্রাট আকবরের নির্দেশে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে আমীর ফতেহ্উল্লাহ সিরাজী সম্রাট আকবরের মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার বছর ৯৬৩ হিজরী মুতাবিক ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের নির্দিষ্ট তারিখ থেকে হিসাব করে হিজরী সনকে সৌর গণনায় এনে যে সনটি উদ্ভাবন করেন সেটাই আমাদের দেশে বাংলা সন নামে পরিচিত হয়। হিজরী সনের বছরের হিসাব ঠিক রেখেই এর মাসগুলো নেয়া হয় শকাব্দ থেকে। বৈশাখ মাসকে স্থির করা হয় বছরের প্রথম মাস। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই সম্রাট আকবরের ফরমানবলে রাজত্বের রাজস্ব আদায়ের সন হিসেবে তা প্রচলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশে হিজরী সনের সৌরকরণ পঞ্জিকাটি ব্যাপকভাবে গৃহীত ও সমাদৃত হয়, যা একান্তভাবে বাংলার মানুষের নিজস্ব সন হিসেবে স্থান করে নিতে সমর্থ হয়। আর এখানে ইংরেজী সন এলো সেই ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পরাধীনতার শেকল পরিয়ে। একটা জিনিস লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে কিন্তু এখন পর্যন্ত ইংরেজী সনের গ্রহণযোগ্যতা তেমন একটা নেই। আবার শহর জীবনে বাংলা সনের ব্যবহার নেই বললেই চলে। অবশ্য শহুরে জীবন কি গ্রামীণ জীবনে হিজরী সনের প্রচলন সমানভাবে বর্তমান। বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও সংহতির অন্যতম অবলম্বন এই হিজরী সন। আর এই হিজরী সন থেকে উৎসারিত বাংলা সন আমাদের জাতীয় জীবনে নিজস্বতার বৈভব এনে দিয়েছে। মুসলিম দুনিয়ার অনেক দেশেই হিজরী সনের চান্দ্র হিসাবের বৈশিষ্ট্যেই জাতীয় সন হিসেবে প্রচলিত রয়েছে। এমনকি এই সনের সৌর হিসাব এনে বাংলা সনের মতোই কোন কোন দেশে প্রচলিত রয়েছে, যেমন ইরানে হিজরী সনকে সৌর হিসাবে এনে সেখানে হিজরী সন প্রচলিত রয়েছে। ইরানে নওরোজ পালিত হয় হিজরী সনের শামসী বা সৌরকরণের হিসাবে আনা তাদের নিজস্ব প্রথম মাসের ১ তারিখে। আমাদের দেশে হিজরী সনের সৌর হিসাবের প্রথম মাস যেমন বৈশাখ মাস, তেমনি ওখানে হচ্ছে ফারবারদীন প্রথম মাস। এই মাসের ১ তারিখ ওদের হয় ২১ মার্চ। আর আমাদের ১ বৈশাখ হয় ১৪ এপ্রিল। আমাদের দেশে বাংলা নববর্ষের যে আনন্দ বৈভব কি গ্রামে কি নগরে-গঞ্জে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে, ইংরেজী নববর্ষ কিন্তু শহুরে জীবনের মুষ্টিমেয় বিশেষ মহলে ছাড়া তা ব্যাপকভাবে কোথাও আলোড়ন সৃষ্টি করে না। তবুও ইংরেজী নববর্ষ আসে। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টার ঘণ্টা বাজার পর পরই ঘোষিত হয় এই ভিন ঐতিহ্যজাত নববর্ষের সূচনা মুহূর্ত, ঘোষিত হয় ইংরেজী নববর্ষের আগমন বারতা। মধ্যরাতের সেই মুহূর্তটা আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে কোনরূপ আনন্দ-আবেগ সৃষ্টি না করলেও খ্রীস্টান জগত ওই মুহূর্তে হ্যাপি নিউ ইয়ার উচ্চারণের মধ্য দিয়ে এক হৈ-হুল্লোড়ে উল্লাস ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। ঘটে যায় কতই না অঘটন, ঘটে যায় কতই না পৈশাচিক কর্মকা-, মদ্যপানের নামে বহু স্থানে জীবন পানের মহড়াও চলে। ইংরেজী নববর্ষ আসে রাতের গভীরে নিকষ অন্ধকারে প্রচ- শীতের প্রবাহ মেখে। ইংরেজী ক্যালেন্ডার যেহেতু আমাদের কাজ-কর্মের তারিখ নির্ধারণে, হিসাব-নিকেষ সংরক্ষণে, আন্তর্জাতিক আদান-প্রদানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তাই এতে যতই ঔপনিবেশিক গন্ধ থাকুক না কেন, যতই এতে প্রায় ২০০ বছরের গোলামির জোয়ালের চিহ্ন থাকুক না কেন, আমরা এর থেকে মুক্ত হতে পারছি না এই কারণেই বোধ করি যে, আমরা স্বকীয়সত্তা সজাগ হওয়ার চেতনার কথা বললেও, আমরা নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমুন্নত করার কথা বললেও তা যেন অবস্থার দৃষ্টিতে মনে হয় বাতকা কি বাত তথা কথার কথা। ইংরেজী নববর্ষ আমাদের স্কন্ধে সিন্দবাদের সেই দৈত্যটির মতো, সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে এমনভাবে বসে আছে যে, আমরা একে ছাড়তে পারছি না। ইংরেজী নববর্ষ আমাদের নতুন দিনের হিসাব শুরু করায়, যদিও চিঠিপত্রে বাংলা তারিখ উল্লেখ করার নির্দেশ রয়েছে, কিন্তু সেটাও কি কার্যত হচ্ছে? আমরা যাকে ইংরেজী ক্যালেন্ডার বলি আদতে এর নাম গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে রোমের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি প্রাচীন জুলিয়ান ক্যালেন্ডারটির সংস্কার সাধন করেন। এই গ্রেগরির নামে এই ক্যালেন্ডার গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত হয়। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তারিখ লেখার শেষে যে এডি (অ.উ) লেখা হয় তা লাতিন এ্যানো ডোমিনি (অহহড় উড়সরহর)-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এই এ্যানো ডোমিনির অর্থ আমাদের প্রভূত বছরে (ওহ ঞযব ণবধৎ ঙভ ঙঁৎ খড়ৎফ) অর্থাৎ খ্রিস্টাব্দ। ডাইওনিসিয়াম একমিগুয়াস নামক এক খ্রীস্টান পাদ্রী জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ৫৩২ অব্দে যিশুখ্রিস্টের জন্ম বছর থেকে হিসাব করে এই খ্রিস্টাব্দ লিখন রীতি চালু করেন। মানুষ আদিকাল থেকেই কোন না কোনভাবে দিন-ক্ষণ, মাস-বছরের হিসাব রাখতে প্রয়াসী হয়েছে চাঁদ দেখে, নক্ষত্র দেখে, রাত-দিনের আগমন-নির্গমন অবলোকন করে, ঋতু পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা পর্যবেক্ষণ করে। সাধারণ কোন বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দিন গণনা, মাস গণনা, বছর গণনার রীতি কালক্রমে চালু হয়েছে। তিথি, নক্ষত্র বিশ্লেষণ করার রীতিও আবিষ্কার হয়েছে, উদ্ভাবিত হয়েছে রাশিচক্র। চাঁদের হিসাব অনুযায়ী যে বছর গণনার রীতি চালু হয় তা চান্দ্র সন নামে পরিচিতি লাভ করে। এই চান্দ্র সনে বছর হয় মোটামুটি ৩৫৪ দিনে আর সূর্যের হিসাবে যে বছর গণনার রীতি চালু হয় তা সৌর সন নামে পরিচিত হয়। সৌর সনের বছর হয় মোটামুটি ৩৬৫ দিনে। আমাদের দেশে ইংরেজী তথা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার যে ব্রিটিশ বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাত করে আমাদের ওপর গোলামির জোয়াল চাপিয়ে দেয়, সেই ব্রিটিশ এই ক্যালেন্ডার তাদের দেশ গ্রেট ব্রিটেনে চালু করে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে। তারা যেখানেই তাদের উপনিবেশ স্থাপন করেছে, সেখানেই তারা তাদের পোশাক-আশাক, শিক্ষা-দীক্ষা, প্রশাসনিক কাঠামো, সংস্কৃতি যেমন চাপিয়ে দিয়েছে, তেমনি তাদের ক্যালেন্ডারটিও দিয়েছে, তারা প্রভু সেজে বসেছে আর নেটিভদের বানিয়েছে মোস্ট অবিডিয়েন্ট সারভেন্ট। এর থেকে কি আমরা নিজেদের উদ্ধার করতে পারব না? বল বীর/বল উন্নত মম শির/শির নিহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রিরÑ এই বীরত্বব্যঞ্জক উচ্চারণ কি শুধু আমাদের জাতীয় কবির কবিতায় আবৃত্তির জন্য অনুরণিত হতে থাকবে, নাকি আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে ঝংকৃত হবে, সেটা কি আমরা ভেবে দেখতে পারি না? লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরিফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×