ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুই বছরের মধ্যে মূল্যসূচক সর্বোচ্চ অবস্থায়

বছর শেষে শেয়ার বাজারে চমক

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

বছর শেষে শেয়ার বাজারে চমক

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ চলতি বছরের প্রায় পুরোটা সময় শেয়ারবাজার ঢিলেঢালাভাবে চললেও শেষের দিকে এসে মূল্যসূচক ও আর্থিক লেনদেনে চমক দেখা যায়। মূল্যসূচক প্রায় ২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে যায়। বুধবার পর্যন্ত ডিএসইর সার্বিক সূচকটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ২৭ পয়েন্ট। আর লেনদেন বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে আসে। অর্থনীতির সব সূচকে ইতিবাচকতা ও শেয়ারবাজারে আস্থার প্রতিফলনে সূচক ও লেনদেন এমন অবস্থানে উঠে এসেছে বলে বাজার সংশ্লিষ্টদের দাবি। এছাড়া বর্তমান বাজার আরও অনেক দূর যাবে বলে প্রত্যাশা। দেখা গেছে, ৪ হাজার ৬২৯ পয়েন্ট মূল্যসূচক নিয়ে চলতি বছরের যাত্রা শুরু হয়। বছরের ১ম কার্যদিবসেই প্রায় ৬ পয়েন্ট পতন দিয়ে শুরু হয়। এরপর কয়েক কার্যদিবসের উত্থানে ১৯ জানুয়ারি ৪ হাজার ৬৯৭ পয়েন্ট হয়। যে মূল্যসূচকে পৌঁছাতে পরবর্তীতে অপেক্ষা করতে হয় ৪ অক্টোবর পর্যন্ত। এর মধ্যে ধারাবাহিক পতনে ২ মে চলতি বছরের মূল্যসূচক সর্বনিম্ন অবস্থানে চলে যায়। এদিন মূল্যসূচক ছিল ৪১৭১ পয়েন্টে। এরপর আবার ধারাবাহিক উত্থানে বছরের শুরুর সূচকে পৌঁছায় ৪ অক্টোবর। এদিকে ৪ অক্টোবরের পর শেয়ারবাজারে কিছুটা নেতিবাচক অবস্থা দেখা যায়। যাতে কয়েকদিনের লেনদেনে প্রায় ১০০ পয়েন্ট কমে ৩১ অক্টোবের ৪ হাজার ৫৯২ পয়েন্ট দাঁড়ায়। এরপরই শুরু হয় মূল্যসূচকের উত্থানে চমক ও দেখা যায় ষাঁড়ের দৌড়। নবেম্বর মাস ও ডিসেম্বরের ২২ দিনের এই ষাঁড়ের দৌড়ে সূচক ওঠে যায় ৪ হাজার ৯০০ পয়েন্টে। যা স্পর্শ করে প্রায় ২৩ মাস পর। মূল্যসূচকের পাশাপাশি আর্থিক লেনদেনও বছরের শেষেদিকে এসে চমক দেখা যায়। চলতি বছরে ৫ কার্যদিবস হাজার কোটি টাকার ঘরে লেনদেন হয়েছে। এই ৫ কার্যদিবসই হয়েছে ২২ নবেম্বরের পর। ২৩ নবেম্বর এবং ৮, ১৪, ১৫ ও ১৯ ডিসেম্বর হাজার কোটি টাকার ঘরে লেনদেন হয়েছে। এই ৪ কার্যদিবস ও বছরের মধ্যে ২৩ নবেম্বর সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৪৭৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা। আর ১০ জুলাই বছরের সর্বনিম্ন লেনদেন হয়েছে। এদিন ২০৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানান, শেয়ারবাজার বর্তমানে স্থিতিশীল ও ভাল অবস্থানে রয়েছে। আর যেকোন মূল্যে এই শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল রেখে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে লোভে পড়ে অধিক মুনাফার আশায় সর্বস্বান্ত হওয়ার চেয়ে অল্প মুনাফা করা ভাল হবে বলে পরামর্শ। এই অবস্থায় কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন শেয়ারবাজার নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর চেয়ে বেশি আশাবাদী। একইসঙ্গে মূল্যসূচক বেড়ে ১০ হাজার হলেও কোন সমস্যা নাই বলে মনে করেন। আর শেয়ারবাজারের মাধ্যমে আগামী কয়েক বছরে দেশে কয়েকটি পদ্মা সেতু তৈরির অর্থায়ন করা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএএম মাজেদুর রহমান জানান, শেয়ারবাজারে প্রতিদিন উন্নয়ন হচ্ছে। যা দেখে বিদেশীরা বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে। একইসঙ্গে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এদিকে ২০১৬ সালে শেয়ারবাজারের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারেনি শেয়ারবাজার-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। বিচারিক মামলা না থাকায় প্রায় পুরো বছর ট্রাইব্যুনালের অলস সময় কেটেছে। তবে বছরের শেষ দিকে ১টি মামলা মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছে। যাতে মাত্র ১টি মামলা নিয়ে বিচারকার্য চালিয়ে যাচ্ছে বিশেষ ট্রাইব্যুনালটি। যদিও এ সংশ্লিষ্ট ৫৩৫টি মামলা রয়েছে। তবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর হয়েছে মাত্র ২৫টি। এর মধ্যে ৬টি মামলার রায় হয়েছে। বিচারিক ক্ষমতা না থাকায় ২টি মামলা মহানগর দায়রা জজ আদালতে ফেরত পাঠানো হয়েছে ও ১৬টি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। শেয়ারবাজারের উন্নয়নে নতুন নতুন কোম্পানি আনা হলেও তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। কারণ অর্ধেক কোম্পানি শেয়ারবাজারে এসে মূল্যসূচকে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। চলতি বছরে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ১৫টি কোম্পানির মধ্যে ৭টি বা ৪৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম অন্তর্ভুক্তিকালীন সময়ের তুলনায় নিচে নেমে এসেছে। যা ডিএসইএক্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিভিন্ন কোম্পানির পাশাপাশি ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও বিনিয়োগকারীদের মাঝে ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। সম্প্রতি ইউএফএস প্যাসিফিক ডেনিমস ও ফরচুন সুজের আর্থিক অবস্থা নিয়ে বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিএসইসি। এছাড়া প্রগতি লাইফ ইউনিট ফান্ড নিয়ে ভুল বিজ্ঞপ্তি দেয়। এতে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা থাকলেও ভুলকে স্বাভাবিক বলে দাবি এই নিয়ন্ত্রক সংস্থার। বছরজুড়ে স্টক এক্সচেঞ্জের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার (কৌশলগত বিনিয়োগকারী) খুঁজে বের করা। যদিও তা সম্ভব হয়নি। এছাড়া বর্তমান সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জ এই বিনিয়োগকারীর কাছে শেয়ার বিক্রয় করলে লোকসান হওয়ার আশঙ্কা ছিল। দেখা গেছে, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছর শেষে ডিএসইর প্রতিটি শেয়ারে সম্পদ (এনএভিপিএস) মূল্য দাঁড়ায় ১১ টাকা ৬৮ পয়সা। এ অর্থবছরে কোম্পানিটি প্রতিটি শেয়ারে আয় (ইপিএস) করে ৭৫ পয়সা। আর সর্বশেষ অর্থবছর (২০১৫-১৬) শেষে শেয়ার প্রতি আয় আরও কমেছে। এ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ৭০ পয়সার মতো। এতে করে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিটি শেয়ারে সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ৩০ টাকা পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই দামে শেয়ার বিক্রি করলে বড় ধরনের লোকসান হবে ট্রেকহোল্ডারদের। কারণ বর্তমানে ডিএসইর পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১ হাজার ৮০৩ কোটি ৭৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এর বিপরীতে শেয়ার রয়েছে ১৮০ কোটি ৩৭ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০টি। আর এই শেয়ারের মালিকানায় আছেন ২৫০ জন। এ হিসাবে প্রত্যেক ট্রেকহোল্ডার (শেয়ারের মালিক) ৭২ লাখ ১৫ হাজার ১০৬টি করে শেয়ার পাবে। এতে প্রতিটি শেয়ার ২৫ টাকা করে বিক্রি করলে একজন ট্রেকহোল্ডারের সব শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ১৮ কোটি ৪ লাখ টাকা। অথচ ৪ বছর আগে একটি সদস্য পদ কিনতে ৩২ কোটি টাকার ওপরে খরচ করতে হয়েছে। ২০১৫ সালে রাইট অনুমোদন শূন্য থাকলেও ২০১৬ সালে তা লাঘব হয়েছে। এ বছর সামিট এ্যালায়েন্স পোর্ট, জিপিএইচ ইস্পাত ও বিডি থাই এ্যালুমিনিয়াম রাইট শেয়ারের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করেছে। এই ৩ কোম্পানি রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৩৬৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছে। ২০১৬ সাল রাইট শেয়ারে এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে পড়েছে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও)। এ বছর ১১টি কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করেছে। যার পরিমাণ আগের বছর ছিল ১২ কোম্পানি। তবে টাকার অংকে চলতি বছরে বেশি সংগ্রহ করা হয়েছে। আগের বছরের ৮৩০ কোটি ৭২ লাখ টাকার বিপরীতে এ বছর ৮৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। আর উভয় বছরে ৩টি মিউচুয়াল ফান্ড শেয়ারবাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করেছে। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের (মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথকীকরণ) মাধ্যমে স্টক এক্সচেঞ্জে ব্রোকার মালিকদের ক্ষমতার খর্ব হয়। ফলে স্টক এক্সচেঞ্জের বাইরে একত্রিত হয়ে কাজ করার লক্ষ্যে একটি সংগঠন তৈরি করা জরুরী উপলব্ধি করে ডিএসইর ব্রোকাররা। এরই আলোকে ২০১৫ সালে ডিএসই বোকার্স এ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) নামে একটি সংগঠন করা হয়। যা চলতি বছরের ২০ নবেম্বরে নির্বাচনের মাধ্যমে ১৫ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়। ২ বছর মেয়াদী এই পর্ষদে ১ম বছরের জন্য সভাপতি হিসেবে রশিদ ইনভেস্টমেন্ট সার্ভিস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ রশিদ লালী, জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি হিসেবে ইনভেস্টমেন্ট এ্যান্ড প্রমোশন সার্ভিসেস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোশতাক আহমেদ সাদেক এবং সহ-সভাপতি হিসেবে মডার্ন সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই-নাহরিন নির্বাচিত হয়েছেন।
×