ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বলেন পার্বতীপুরের মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক

আমাদের পোঁতা মাইন বিস্ফোরণে মরল পাকি মেজর, দেহরক্ষী

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

আমাদের পোঁতা মাইন বিস্ফোরণে মরল পাকি মেজর, দেহরক্ষী

শ.আ.ম হায়দার, পার্বতীপুর ॥ ‘১৫ ডিসেম্বর খবর এলো বিশেষ ট্রেনযোগে বিহারীরা পার্বতীপুর থেকে সৈয়দপুর পালিয়ে যাচ্ছে। আমি সঙ্গীদের নিয়ে সৈয়দপুরগামী রেললাইনের দিকে রওনা দিই। ট্রেনটিকে উড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে রেললাইনে বসানো হয় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মাইন। অতঃপর অপেক্ষায় থাকি কখন ট্রেন আসবে। এ সময় চোখে পড়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে পাক আর্মির একটি জীপ আসছে পার্বতীপুরের দিক থেকে। তৎক্ষনাৎ ওই মাইন উঠিয়ে বসানো হয় রাস্তায়। অল্প সময়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে রাস্তার পাশের্^ খেজুর গাছে জীপটি ঝুলতে থাকে। মারা পড়ে এক পাঞ্জাবী মেজর ও তার দেহরক্ষী। পরে তার ড্রাইভারকে এলএমজির ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। সেদিন রাতে পার্শ্ববর্তী ব্রহ্মোত্তর সোনাপুকুর গ্রাম থেকে ধরা হয় রাজাকার নঈম কাজী বাহিনীর ৯ রাজাকারকে। সকাল সাতটায় পার্বতীপুর থেকে রেলপথে সৈয়দপুর যাওয়ার পথে ধরা পড়ে আরও ১৪ রাজাকার। এদের সবাইকে করতোয়া নদীর পাড়ে হত্যা করে পুঁতে রাখা হয়’Ñ বলছিলেন পার্বতীপুরের মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে থেকে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে লড়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ কাজ করতে গিয়ে বহুবার তাদের জালে আটকা পড়েছেন। তবে অকুতোভয় এ মুক্তিযোদ্ধা সাহস, বুদ্ধি ও কৌশল খাটিয়ে ওদের বেড়াজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে এসেছেন। শত্রুকে পর্যুদস্ত করেছেন। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নে তার গ্রামের বাড়ি। বর্তমান ঠিকানা পার্বতীপুর পৌরসভার আমিরগঞ্জে। যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে রমজানের প্রথমদিকে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার ভূষিরবন্দরে রাস্তার ব্রিজ বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে গভীর রাতে নিকটস্থ কামারপাড়া গ্রামের জনশূন্য বাড়ির একটি চাটির ঘরে আশ্রয় নিই। সঙ্গে ছিল সহযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার আবু এহিয়া, হাফিজউদ্দিন আহমেদ, মফলেউদ্দিন, আঃ হামিদ ও আঃ বারী। কিছুক্ষণ পরে সেখানে শহীদুল ও সাখাওয়াতের নেতৃত্বে আরেকটি গ্রুপ এসে অন্য একটি ঘরে উঠে। ক্লান্তিতে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাইরে ফিসফাস শব্দে ঘুম ভাঙ্গলে চাটির ফাঁক দিয়ে দেখি আনুমানিক ৫শ’ খান সেনাসহ রাজাকার আমাদের ঘেরাও করেছে। এক পাঞ্জাবী সৈন্য দরজার সামনে এসে ডাক দেয়। উর্দুতে বলে ‘দরওয়াজা খোল, নাইতো স্যুট করদেঙ্গে।’ এ সময় আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। তবে সাহস হারাইনি। হাতিয়ারে গুলি লোড করি। আবারও বিকট উর্দু কণ্ঠ ভেসে আসে। ফায়ার ওপেন করলে ঘর উড়িয়ে দেয়া হবে। একপর্যায়ে লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে বুকের সামনে চায়নিজ রাইফেল তাক করে। আমিও হাতিয়ার উঁচিয়ে ধরলে সৈন্যটি কিছুটা পিছু হটে। তবে মোস্তফা ধরা পড়ে। সুযোগ বুঝে আঃ বারী বেড়া ফাঁক করে ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড় মারে। তাকে ধরতে সৈন্যরা পেছনে দৌড় দেয়। মোস্তফাও ধস্তাধস্তি ও ধাক্কায় ফেলে দিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দেয়। আমি উপস্থিত বুদ্ধি খাটাই। বেয়োনেট না থাকলেও যুদ্ধের কৌশলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিকট আওয়াজ করি। সৈন্যটি ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এরপর নিজেই পাকিস্তানী অফিসার সেজে সেনাবাহিনী কমান্ডে বলিÑ পজিশন, ফায়ার স্টপ। ওরা তাদের কমান্ডিং নির্দেশ মনে করে হানাদার বাহিনী ও রাজাকার সবাই পজিশনে যায়। আবারও উর্দুতে বলিÑ ‘জোয়ান পিছু হটো’। তখন রাস্তা খালি হলে ফাঁক বুঝে আমরা বেরিয়ে আসি। সাহসী এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ক্রলিং করে জঙ্গল ও বাঁশঝাড় পেরিয়ে নদীর ধারে আসি। এখানে শহীদুলের সঙ্গে দেখা হয়। ভরাট নদী সাঁতরে ওপারে যাই। সেখানে চোখে পড়ে খান সেনারা কিছু মহিলাকে রাস্তায় বসিয়ে রেখেছে। সেখানেও তাদের আনুমানিক আধাঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পরে তারা পালিয়ে যায়। তখন সবাই মিলে এসএলআরের ফাঁকা ফায়ার দিতে দিতে যমুনা পার হয়ে খানসামা-চিরিরবন্দর সীমানার ঝানঝিরা ঘাটে পৌঁছাই। সেখানে দেখা মেলে এক ডাক্তারের। তাকে সঙ্গে নিয়ে আরও ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলসহ পুনরায় কামারপাড়ায় ফিরে এসে আঃ হামিদকে পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখতে পাই। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় মফলেউদ্দিন ও আঃ বারীকে। সেদিন কমপক্ষে ৫০ নিরীহ গ্রামবাসীকে খান সেনারা হত্যা করে। এ ঘটনায় আমার ডান পায়ে আঘাত পাই, যা এখনও সেরে উঠেনি। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার ১৫ দিন আগে পার্বতীপুরের অদূরে মন্মথপুর রেলস্টেশন দখলে নিই। এখানকার রেলব্রিজের নিচে বাঙ্কারে থাকত রাজাকারসহ ১৫ পাকি সৈন্য। অতর্কিতে হামলা চালিয়ে তাদের ধরে ফেলি। মন্মথপুর স্টেশনে উড়ানো হয় জয়বাংলার পতাকা। মুক্ত হয় ওই এলাকা। বিজয়ের শেষ মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করে জহুরুল হক বলেন, ১৫ ডিসেম্বর খবর পাওয়া যায় বিশেষ ট্রেনযোগে বিহারীরা পার্বতীপুর থেকে সৈয়দপুর পালিয়ে যাচ্ছে। এখানে এক অপারেশনে মারা পড়ে এক পাঞ্জাবী মেজর ও তার দেহরক্ষী। ওই রাতে পাশর্^বর্তী ব্রহ্মোত্তর সোনাপুকুর গ্রাম থেকে ধরা হয় রাজাকার নঈম কাজী বাহিনীর ৯ রাজাকার। সকাল সাতটায় পার্বতীপুর থেকে সৈয়দপুরগামী রেলপথ দিয়ে সৈয়দপুর যাওয়ার পথে ধরা পড়ে আরও ১৪ রাজাকার। এদের সবাইকে করতোয়া নদীর পাড়ে হত্যা করে পুঁতে রাখা হয়। ১৬ ডিসেম্বর বেলা এগারোটায় পাশর্^বর্তী বদরগঞ্জ উপজেলার গুপীনাথপুর কাছারির ডাঙ্গায় ধরা পড়ে জীপসহ ৯ পাকি সেনা অফিসার। তাদের হত্যার পর জীপটি বিএডিসির ড্রাইভার আঃ লতিফকে দিয়ে চালিয়ে এনে জমা দেয়া হয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসে। তিনি বলেন, ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুরের পতিরাম ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দেই। পার্বতীপুরের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ মুহিউদ্দিন আহমেদ (প্রয়াত) ৪০ যুবক বাছাই করে এ ক্যাম্পের সূচনা করেন। পরে ক্যাম্পটি বড় আকার ধারণ করে। এখানে ছিল আলফা, ব্রেভো ও চার্লি কোম্পানি। পরে পাবনার অধ্যাপক আবু সাইয়িদের (সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী) ডেল্টা কোম্পানি এখানে যোগ দেয়। ক্যাম্পের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন শিরহী। এখানে ট্রেনিং শেষে হায়ার (উচ্চতর) ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় পানিঘাটা ও শিলিগুড়িতে। কোর্স শেষে পাঠানো হয় বড়াহার অপারেশন ক্যাম্পে। এই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন এসএস বাত ও শ্রী শরন সিং। সেখানে ৫০ জনের একটি টিম গঠন করা হয়। প্রথম অপারেশনে বাংলাদেশের জলপাইতলী ক্যাম্পে এসমাইল, আব্বাস ও ময়েজ আমার সঙ্গীয় তিন মুক্তিযোদ্ধা মারা যায় ভুল নির্দেশনায়। পরবর্তীতে ৫০ মুক্তিযোদ্ধার একটি টিম নিয়ে আমি হরিহরপুর, খাজাপুর, উলিপুরে অপারেশন চালাই। রাজাকার অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে ৫০ এলএমজি দিয়ে আক্রমণ করা হয়। বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণে রাজাকাররা গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, বিজয়ের মাসে আমি গর্বিত, আনন্দিত। তবে যুদ্ধ না করেও আজ অনেকে মুক্তিযোদ্ধা। তারা রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। এরা মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য ও মর্যাদাকে ম্লান করে দিয়েছে। এ লজ্জা আমরা রাখব কোথায়?
×