ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জেলা পরিষদ নির্বাচনের ফলতামামি

১৩ জেলায় সরকার সমর্থক প্রার্থীর ভরাডুবির নেপথ্যে-

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

১৩ জেলায় সরকার সমর্থক প্রার্থীর ভরাডুবির নেপথ্যে-

শাহীন রহমান ॥ দলীয় কোন্দল, প্রার্থীর অযোগ্যতা, কালো টাকার লেনদেন, জামায়াত-বিএনপি ভোট ফ্যাক্টর এবং সাম্প্রদায়িক স্লোগানের কারণে জেলা পরিষদ নির্বাচনে ১৩ জেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর ভরাডুবি ঘটেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব জেলায় দলের নেতাকর্মীরা দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করে গোপনে বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন যুগিয়েছেন। এছাড়া জামায়াত-বিএনপি ভোটাররাও বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে নিজেদের ভোট বিক্রি করেছেন। অনেকক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থীর জনপ্রিয়তা এবং দলীয় প্রার্থীর প্রচারে সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব ছিল। এ কারণে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পরও তারা বিজয়ী হতে পারেননি। গত বুধবার সারাদেশে ৬১ জেলা পরিষদের প্রথমবারের মতো ভোট গ্রহণ হয়েছে। তবে আগেই ২১ জেলায় সরকার সমর্থক প্রার্থীরা জয়লাভ করায় এসব জেলায় চেয়ারম্যান পদে ভোট হয়নি। ভোটের আগ মুহূর্তে আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে কুষ্টিয়া ও বগুড়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন স্থগিত করা হয়। ফলে ৩৮ জেলায় ৩৮ চেয়ারম্যান পদসহ সব পদেই এবং ২১ জেলায় শুধু সদস্য পদে ভোট গ্রহণ করা হয়। নির্বাচন শেষে ৩৮ জেলায় চেয়ারম্যান পদের মধ্যে ২৫ জেলায় সরকার সমর্থক প্রার্থী জয়ী হলেও বাকি ১৩ জেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়লাভ করে। যেহেতু এ নির্বাচনে অন্যকোন রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি এ কারণে এত বেশি বিদ্রোহী প্রার্থীর জয়ের বিষয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা শুরু হয়েছে। এ নির্বাচনে স্থানীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত দলীয় জনপ্রতিনিধি না থাকায় বিএনপি বর্জন করে। তবে উপজেলায় পরিষদের বিএনপি ও জামায়াতের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের ভোটাররা মূলত আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। আবার কোথাও তারা টাকার বিনিময়ে তাদের ভোট বিক্রি করে দিয়েছেন। যার কাছ থেকে বেশি টাকা পেয়েছেন ভোট শুধু তাকেই দিয়েছেন। এছাড়া দলীয় কোন্দল ও প্রার্থী বাছাইয়ে ভুলের কারণে এসব জটিলতায় এলাকায় সরকারদলীয় প্রার্থীর ভরাডুবি ঘটেছে। রাজশাহী জেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সমর্থন জানানো হয় মাহবুব জামান ভুলুকে। তিনি এর আগেও জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তিনি প্রার্থী হিসেবে যেমন ভোটারদের কাছে অযোগ্য ছিলেন তেমনি ভোটাররা তার প্রতি প্রচ- ক্ষুব্ধ ছিল। এ কারণে জেলায় সব কেন্দ্রেই তিনি পরাজিত হয়েছেন। দলের একটি অংশ গোপনে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। শুধু রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন, দলের কয়েক এমপি দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। এমনকি নির্বাচনী প্রচারে দলীয় প্রার্থী সরবও ছিলেন না। তিনি ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাননি। জনপ্রতিনিধিদের কাছে ডেকে ভোট চেয়েই দায় সেরেছেন। জানা গেছে, মাহবুব জামান ভুলু জেলা প্রশাসক থাকাকালীন সরকারী সাহায্য বণ্টন করেছেন এককভাবে। এমনকি প্রশাসক থাকাকালে কোন জনপ্রতিনিধি তার দরজার কাছেও ভিড়তে পারেনি। এ কারণে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা তার ওপর প্রচ- ক্ষুব্ধ ছিল। ফলে তারা কেউ সরকারদলীয় প্রার্থীকে ভোট দেননি। অপরদিকে বিজয়ী বিদ্রোহী প্রার্থী মোহাম্মাদ আলী এ সুযোগ ভালভাবে কাজে লাগিয়েছেন। প্রতিটি ভোটারের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তিনি ভোট প্রার্থনা করেছেন। এমনি তার বিরুদ্ধে কালো টাকা ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর ভোট তিনি কিনে নিয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারে তার সরব উপস্থিতি ছিল। ফলে সুযোগ কাজে লাগিয়ে সহজেই তিনি নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছেন। শেরপুরে দলীয় প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে মূলত দলের ভেতরে কোন্দল। নির্বাচনে নেতাকর্মীদের সমন্বয়ের অভাব ছিল। এ জেলায় চেয়ারম্যান পদে সরকারদলীয় সমর্থক চন্দন পালের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সেøাগানকে কাজে লাগানো হয়েছে। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক হওয়ার হাওয়া ছড়িয়ে নির্বাচনে সেøাগান তোলা হয়েছিল ‘সালাম, না আদাব।’ জানা গেছে দলের প্রভাবশালী একটি গ্রুপও তার পক্ষে কাজ করেনি। শেরপুরের তিনটি নির্বাচনী এলাকার মধ্যে মাত্র একটি নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মীরা মূলত সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে ছিলেন। এ ছাড়া এ নির্বাচনে কালো টাকার লেনদেন হয়েছে ব্যাপক। বিজয়ী বিদ্রোহী প্রার্থী হুমায়ন কবীর এক সময় মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। গত নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেয়া না হলে দলের কমিটিতে তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবেও পদোন্নতি পাওয়ায় তার জনপ্রিয়তা ছিল বেশ। ফলে সরকার সমর্থিত প্রার্থীর ভরাডুবি নিশ্চিত হয়েছে। অপরদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় দলের প্রার্থীর পরাজয়ের পেছনে দলীয় কোন্দল মূলত দায়ী। জানা গেছে, দলীয় প্রার্থীর সঙ্গে বর্তমান কমিটির বিরোধ চরমে। এছাড়া সরকারদলীয় প্রার্থী এ্যাডভোকেট সৈয়দ একেএম এমদাদুল বারী প্রার্থী হিসেবে বয়স্ক হওয়ায় দলের নেতাকর্মী তাকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। বিদ্রোহী প্রার্থী শফিকুল আলম এমএসসি সাবেক কমিটির সহসভাপতিও ছিলেন। দলের ভেতরে তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে । এ কারণে তিনি সহজেই জয়ী হতে পেরেছেন। সাতক্ষীরা জেলায় সরকারদলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক থাকাকালীন ব্যাপক দুর্নীতি-অভিযোগ রয়েছে স্থানীয়দের। ফলে জনপ্রতিনিধিরা তাকে পছন্দ করেনি। দলের বড় একটি অংশ তার পক্ষে কাজ করেনি। খোঁজ নিয়েছে জানা গেছে, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম দীর্ঘদিন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। গত সংসদ নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হন। এর পর উপজেলায় নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাননি। এমনকি জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলের পক্ষে মনোনয়নেও তাকে বঞ্চিত করা হয়। এই বঞ্চনার ক্ষোভ থেকেই মূলত তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। সরকারদলীয় প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনসুর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং সাধারণ সম্পাদকের মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় নেতাকর্মীরা তার প্রতি সহানুভূতি ছিল। এ কারণে তিনি সরকারদলীয় প্রাথীর বিরুদ্ধে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। অপরদিকে পঞ্চগড় জেলা পরিষদে বিদ্রোহী প্রার্থীর জয়ের পেছনে তার বিপুল অর্থ ব্যয় কাজ করেছে। জয়ী বিদ্রোহী প্রার্থী আমানুল্লাহ বাচ্চু এর আগে সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে হেরে গেছে। অথচ তিনি জেলা পরিষদে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেছেন। খোঁজ নিয়েছে জানা গেছে, এ জেলায় দলীয় প্রার্থী সাবেক জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এ্যাডভোকেট আবু বকর সিদ্দিক মানুষ হিসেবে ভাল হলেও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে তার কোন যোগাযোগ ছিল না। ফলে দলের নেতাকর্মীরা টাকার কাছে নতি স্বীকার করেছেন। দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি। গত ২০ নবেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশন দেশে প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। এ নির্বাচন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভোটে হওয়ার কারণে অন্য কোন রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। বিশেষ করে এ নির্বাচনে ৬৩ হাজার ভোটারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদে। গত জুন পর্যন্ত পর্যন্ত সারাদেশে দলীয় ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনে অধিকাংশ আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী জয়লাভ করে। এর বাইরে সাড়ে চার হাজার ইউপির মধ্যে মাত্র ৬শ’ বিএনপি প্রার্থী নির্বাচনে জয়লাভ করে। তবে এ নির্বাচনে সহিংসতার কারণে সারাদেশে সমালোচনা কম হয়নি। বিএনপির সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় পরিষদের পর্যাপ্ত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকায় তারা এ নির্বাচন বর্জন করে। একই কারণে অন্য কোন দল এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তবে জেলা পরিষদ নির্বাচন নির্দলীয় হলেও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতি জেলায় একজন করে দলীয় প্রার্থীর সমর্থন দেয়া হয়। কিন্তু মনোনয়নপত্র জমার শেষদিনে দলীয় নমিনেশন পাওয়ার বাইরেও দলে আরও একাধিক প্রার্থী নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়। কিছু বাছাই ২১ জেলায় চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করলেও বাকি জেলায় দলের একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন হওয়া ৩৮ জেলার মধ্যে দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী ২ থেকে শুরু করে ৭ পর্যন্ত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী ফলে দলের ২৫ প্রার্থী জয়লাভ করলেও ১৩ বিদ্রোহী প্রার্র্থী জয়লাভ করেন। সারদেশে জেলা পরিষদের বিধান অনেক আগ থেকে চালু থাকলেও বর্তমার সরকার ক্ষমতায় আসার পর জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য আইন পাস করে। এর আগে এরশাদ আমলে জেলা পরিষদের প্রশাসক পদে নিয়োগ দেয়া হলেও তখন নির্বাচনের কোন বিধান ছিল না। বর্তমান সরকার জেলায় নির্বাচনের জন্য আইন তৈরি করে ২০১১ সালে। আইন অনুযায়ী দেশের তিন পার্বত্য জেলা বাদে ৬১ জেলায় প্রশাসক নিয়োগের জন্য নির্বাচনের বিধান রাখা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, নির্বাচনের আগ সরকার নিযুক্ত একজন প্রশাসক জেলা পলিষদের কার্যাবলী সম্পাদন করবেন। তবে ওই সময় আইন করা হলে কোন বিধি না থাকায় নির্বাচনের আয়োজন করেনি কমিশন। গত ২৮ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো ৬১ জেলা পরিষদে নির্বাচন করা হয়। জানা গেছে, আইন অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলা বাদে ৬১ জেলায় নির্বাচনের বিধান রাখা হয়েছে। পার্বত্য তিন জেলায় পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের অধীনে হওয়ায় সেখানে আলাদাভাবে প্রশাসক নিয়োগের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন রাজশাহী থেকে মামুন-অর-রশিদ, পঞ্চগড় থেকে এ রহমান মুকুল, সাতক্ষীরা থেকে মিজানুর রহমান, শেরপুর থেকে রফিকুল ইসলাম আধার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে রিয়াজউদ্দিন জামি।
×