ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গৌতম পাণ্ডে

দৃশ্যকাব্যে- আমি ও রবীন্দ্রনাথ

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬

দৃশ্যকাব্যে-  আমি ও রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের একান্ত ভক্ত, পাঠক, অনুসারী যে-ই কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে কিংবা কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে যে গেছে, সে-ই কোন না কোনভাবে যেন কবিগুরুর সাক্ষাত পেয়েছে। তিনি কোথায় বসতেন, কোন্ জায়গায় কখন কোন্ কবিতা লিখেছেন কিংবা তার নদী দেখা এবং গ্রামের আনুষদের বাড়ি ফেরা- ইত্যাদি এমন ভাবনা অনেকের মধ্যে নানাভাবে এসেছে। তার খাট-পালঙ্ক আর ব্যবহৃত অন্য জিনিসপত্র দেখতে দেখতে অনেক সময় অবচেতন মনে তার সঙ্গে কথাও বলেছে অনেকে। কিন্তু কে কী কথা বলেছে কবিগুরুর সঙ্গে, অন্যরা তা জানতে পারিনি। কিন্তু নূনা আফরোজ সেই অসাধ্য কাজটি সাধন করেছেন তার লেখা ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ নাটকে। তিনি গিয়েছেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িতে। কী কী কথাবার্তা, হাসি-ঠাট্টা হয়েছে তার আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। এসব কিছুর ফলাফল, মঞ্চে এলো তার রচনা-নির্দেশনায় ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ।’ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এর আগেও যে কোন নাটক হয়নি তা নয়। মঞ্চ, টিভি এমনটি সিনেমায়ও বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে কবিগুরুকে। কিন্তু ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’ নাটকটি ব্যতিক্রমী এক রূপ নিয়েছে মঞ্চে। একজন গুণমুগ্ধ পাঠকের কল্পনায় রবীন্দ্রসৃজন ও তার ব্যক্তিগত জীবনের নানা বিষয় তুলে আনার চেষ্টা রয়েছে এতে। রবীন্দ্র নাট্যচর্চার সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এ নাটকটি প্রাঙ্গণেমোর নাট্যদলের এ বছরের উল্লেখযোগ্য নিবেদন। পড়ন্ত বিকেল। শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িতে নূনা আফরোজ ওরফে অথৈ। বন্ধুদের সবার যখন সবকিছু দেখা শেষ অথৈর তখন শুরু। রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত এ জায়গার কোনটা ফেলে কোনটা দেখবে তা যেন ঠিক করে উঠতে পারে না অথৈ। তাড়াহুড়ো শুরু হয়ে যায়। স্বল্প সময়ের মধ্যে সব কিছুই দেখতে হবে তার। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে অথৈ। ঠিক এমনই সময় তার সামনে হাজির হন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। মনের ভেতর যেন নেমে আসে মুষলধারায় বৃষ্টি। একে একে চার বয়সী রবীন্দ্রনাথের দেখা পায় সে। ২৯, ৬৯, ২১ আর ৮০ বছরের রবীন্দ্রনাথকে পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত অথৈ যেন এক নিশ্বাসে তার ভেতরে জমে থাকা তাবত অজানারে জেনে নিতে তৎপর হয়। তার বয়সের সঙ্গে অথৈও বদলে যায় ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র ও বয়সে। অসংখ্য প্রশ্নের উদ্রেক হয় নিজের মধ্যে। সে সব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র রবীন্দ্রনাথের মুখ থেকে জানতে পারলেই সে সান্ত¡না পাবে। একেবারেই ব্যক্তিগত কিন্তু রহস্যঘেরা ঘটনাগুলোকে রহস্যমুক্ত করতে উৎসুক হয় অথৈ। বৌঠান কাদম্বরীর সঙ্গে রবিঠাকুরের সম্পর্ক, মৈত্রেয়ী দেবী বা ইন্দিরা দেবীর ব্যাপারে কিছু জেনে নেয়া, এমনকি ঠাকুর পদবির ঐতিহাসিক পটভূমিটাও জানা হয়ে গেল দ্রুত সময়ের মধ্যেই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনটা কাদম্বরীর চেয়ে মেঝ বৌঠানের দিকেই যে বেশি ঝুঁকে থাকত, তাও কৌশলে রবিঠাকুরের মুখ থেকে বের করে আনে অথৈ। রবীন্দ্র ইতিহাসবর্জিত এ নাটকটির পরতে পরতে রয়েছে ক্লাইমেক্স। নাট্যরচনাশৈলীতে দর্শকও যেন অথৈয়ের সঙ্গে ঢুকে পড়েছে প্রশ্নোত্তর পর্বে। প্রায় প্রতিটি প্রশ্ন এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে, উত্তরের পিঠে প্রশ্ন করার ফাঁক থাকাতে। কাদম্বরীর (নতুন বৌঠান) সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কটা কতটা গভীর ছিল বা ছিল না তা নিয়ে অনেক লেখালেখি আছে, আবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর আর মেঝ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনীর পরস্পরের প্রতি দুর্বলতার কথা কম-বেশি অনেকের জানা। কিন্তু নাটক দেখার সময় দর্শকের মনে হয় না যে, এই তথ্যগুলো চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে অথবা জানা কথাই অযথা জানাচ্ছে। যেমন- অথৈ : রবি আমার যে ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে কাদম্বরী দেবী কেন সুইসাইড করল। তুমি ছাড়া সত্যি কথাটা কীভাবে জানব বলো? বলো না রবি কাদম্বরী দেবী কেন আত্মহত্যা করল? রবি (খুব অসহিষ্ণুভাবে): আমি... আমি জানি না। অথৈ : অবাক করলে। তুমিই তো কাদম্বরী দেবীর সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলে। রবি (রবি ধৈর্য ধরে রাখতে পারছে না) : হ্যাঁ আমি ওর কাছের মানুষ ছিলাম, ওর নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী ছিলাম। তার মানে তো এই নয় ওর আত্মহত্যার কারণ আমি জানি? রবি-কাদম্বরীর গল্পের পর মঞ্চে আসে একুশ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ। তখন অথৈ কাদম্বরী হয়ে দর্শককে দু’জনার তথ্যরস দিতে থাকে। কোন এক সময় এটা যেন রিপিটেশন মনে হতে থাকে, মনে হয় এই আলাপগুলোই তো বোধহয় একটু আগে ৬৯ বয়সী রবীন্দ্রনাথ আর অথৈর মুখ থেকে শুনলাম। ২১ বছরের রবীন্দ্রনাথকে আগে আনলে হয়ত এমনটা হতো না। কিন্তু তাতে আবার ২৯-৬৯-২১-৮০ বছরে রবীন্দ্রনাথের আগমনের নাটকীয়তা (ছোট রবি-বড় রবি ছোট রবি-বড় রবি) হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। রূপসজ্জাকর জনি সেন প্রত্যেক বয়সের রবীন্দ্রনাথের গেটাপে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ২৯, ৬৯, ৮০ আর ২১ বছর বয়সী রবিঠাকুরের চরিত্রে যথাক্রমে তৌহিদ বিপ্লব, অনন্ত হিরা, আউয়াল রেজা ও রামিজ রাজু অভিনয় অসাধারণ। নাটকটিতে অথৈয়ের চরিত্রে নূনা আফরোজের অভিনয় দর্শকপ্রাণ ছুঁয়েছে বলা যায়।
×