ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুই খুদে কারাতেকা বোনের সাফল্য

প্রকাশিত: ০৬:২১, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬

দুই খুদে কারাতেকা বোনের সাফল্য

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জিমনেশিয়াম বুধবার। বিজয় দিবস কারাতে প্রতিযোগিতার একটি ইভেন্টের ফাইনাল খেলায় মুখোমুখি দুই খুদে কারাতেকা কন্যা। এক পর্যায়ে প্রতিপক্ষের আঘাতে নাক ফেটে রক্ত ঝরা শুরু করল একজনের। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে খেলা চালিয়ে গেল সে। এবং জিতে গেল স্বর্ণপদকও। বিজয়িনীর নাম লাইমা সিকদার কারাতেকা। বয়স ১০। মাদ্রাসায় ক্লাস ফোরে পড়ে। তার ছোট বোনও কারাতেকা, মায়মুনা সিকদার। বয়স মাত্র সাড়ে চার। তারা তিন বোন, এক ভাই। লাইমা দ্বিতীয়, মায়মুনা তৃতীয়। দুজনেই যাকে বলে পিঠাপিঠি। আরেক বোনের খবর কী? সেও কী কারাতেকা? ‘আরে না!’ হেসে ফেললেন ওদের বাবা আবদুল শুক্কুর আলী সিকদার, ‘ওদের ছোট বোন চাইলেও এখন কারাতে খেলতে পারবে না, কারণ ওর বয়স মাত্র সাত মাস!’ বরিশালের কোতোয়ালির চরমোনাইরের সন্তান শুক্কুর আলীর অনেক পরিচয় আছে। তিনি মূলত ক্যামেরা ও মোবাইল এক্সেসরিসের ব্যবসা করেন। স্ত্রী খাদিজা বেগম গৃহিণী। এত খেলা থাকতে নিজের দুই ফুটফুটে কন্যাকে কারাতে খেলায় আনলেন কেন? শুক্কুর আলীর জবাব, ‘মারামারির খেলা হলেও এটি অনেক সুশৃঙ্খলিত খেলা। ড্রেসআপ থেকে শুরু করে কারাতেকারা অনেক নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে। এটি খেললে আত্মবিশ^াস বহুলাংশে বাড়ে। তাছাড়া বখাটে ও ইভটিজার ছেলেদের শায়েস্তা করতে এবং আত্মরক্ষা করতেও এই খেলার কোন জুড়ি নেই। এ কারণেই মেয়েদের কারাতে খেলায় দিয়েছি।’ তবে এগুলোর বাইরেও আরেকটি কারণ আছে দুই মেয়েকে কারাতেতে সম্পৃক্ত করানোর। সেটি হচ্ছে ৪০ বছর বয়সী শুক্কুর আলী নিজেই একসময় ছিলেন কারাতেকা। ১৯৮৯ সালে বাগেরহাট কারাতে ক্লাবে ভর্তি হন। এক বছর পর খুলনায় গিয়ে আরেকটি ক্লাব যোগ দিয়ে কারাতে শেখা অব্যাহত রাখেন। ১৯৯৬ সালে প্রতিযোগিতামূলক আসরে প্রথম অংশ নিয়েই ৪০ কেজি ওজন শ্রেণীতে কুমিতে স্বর্ণ জেতেন। সেটা ছিল কনফেডারেশন কাপ কারাতে প্রতিযোগিতা। এছাড়া ১৯৯৭ সালে জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতায়ও স্বর্ণ জেতেন মাইনাস ৪৫ কেজিতে, একই ইভেন্টে। জীবিকার কারণে কারাতে খেলা ছেড়ে দেন ১৯৯৯ সালে। ছেড়ে দিলেও কারাতে তাকে কিন্তু ছাড়েনি। ব্যবসার পাশাপাশি কারাতে ক্লাব চালান তিনি। ঢাকার রামপুরায় অবস্থিত বাংলাদেশ ওয়াদোকায় কারাতে-দো ক্লাব। তার দুই মেয়েই খেলে এই ক্লাবে। ২০০০ সালে স্থাপিত ক্লাবটির তিনিই প্রধান প্রশিক্ষক এবং সাধারণ সম্পাদকও বটে। সারাদেশে এই ক্লাবের ১৯ শাখায় ছেলেমেয়ে মিলে এক হাজারেরও বেশি কারাতেকা কারাতে শিখে থাকে। আপনার দুই মেয়ে তো তাহলে এই ক্লাবে ফ্রি ট্রেনিং নেয়, তাই না? জবাবে হেসে ফেললেন শুক্কুর আলী। সেই সঙ্গে তার দুই মেয়েও! এছাড়া বাংলাদেশে টেলিভিশনে ২০১৪ সাল থেকে প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ রবিবারে প্রচারিত হওয়া কারাতে শিক্ষার অনুষ্ঠান ‘কারাতো-দো’র পরিকল্পক ও উপস্থাপকও হচ্ছেন শুক্কুর। সেই সঙ্গে কারাতে ফেডারেশনের ইনস্ট্রাক্টর এবং রেফারিও তিনি। দুই বোনের মধ্যে কারাতে খেলা আগে শুরু করে লাইমাই, ২০১১ সাল থেকে। তখন তার বয়স পাঁচ (ঘুরে বেড়ানোর দারুণ শখ তার)। আর মায়মুনা শুরু করে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকে। গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে লাইমা স্বর্ণপদক জিতেছে চারটি। এর মধ্যে এবারের বিজয় দিবস কারাতেতে জিতেছে একটি, ৩৫ কেজি ওজন শ্রেণীতে কুমি বিভাগে (অনুর্ধ ৮-১০ বছর বয়সী গ্রুপে)। এ বছরই ক্লাব কারাতে প্রতিযোগিতায়ও একক কাতায় তাম্রপদক জেতে মায়মুনা। মোট পদকসংখ্যায় বড় বোনের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও ছোট বোন মায়মুনা আবার এবারের বিজয় দিবস কারাতে প্রতিযোগিতায় বেশি পদক জিতেছে। তার অর্জিত পদক দুটি। দুটোই ব্রোঞ্জ (গ্রুপ কাতা এবং একক কাতায়)। মজার বিষয়Ñ সেও খেলেছে অনুর্ধ ৮-১০ বছর বয়সী গ্রুপে! এর কারণ একটিইÑ এই প্রতিযোগিতায় এর নিচে আর কোন বয়সী ইভেন্ট ছিল না! লাইমা জানায়, ‘এবারের বিজয় দিবস কারাতেতে স্বর্ণ জিতে খুব খুশি লাগছে।’ মায়মুনার ইভেন্টটি মূলত মারামারির খেলার ইভেন্ট নয়। তবে সে বড় হয়ে বড় বোনের মতো ‘ফাইট’ করে স্বর্ণ জেতার ঘোষণাও দিল সগর্বে! মাদ্রাসায় পড়তে গেলে লাইমাকে অনেক সমীহ করে তার সহপাঠীরা। ‘সবাই আমাকে কারাতের বিভিন্ন পোজ দেখাতে বলে, কবে খেলা জানতে চায়।’ এই আসরে অংশ নিতে দুই বোন অনুশীলন করেছে সপ্তাহ দুয়েকের মতো। শুক্কুর আলীই তাদের কোচিং করান। লাইমা জানালো, প্র্যাকটিসে ভুল করলে তার বাবা অনেক বকা দেয়! তবে বাড়িতে আবার অনেক আদর করে। ঘাড় নেড়ে একমত পোষণ করল এখনও স্কুলে ভর্তি না হওয়া মায়মুনাও। সে আবার দিল দারুণ গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য, ‘মায়ের চেয়ে বাসায় বাবাই বেশি আদর করে!’ কারাতে নিয়ে দুই সহোদরার ভবিষ্যত লক্ষ্য অভিন্ন, ‘অনেক বড় ও ভাল খেলোয়াড় হতে চাই। দেশের এক নম্বর কারাতেকা হতে চাই।’ এজন্য তো অনেক পরিশ্রম করতে হবে, পারবে? ‘হ্যাঁ, পারব।’
×