ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সমাজ ভাবনা ॥ বিষয় ॥ গার্মেন্টসে সঙ্কট : ক্ষতি কার?

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬

সমাজ ভাবনা ॥ বিষয় ॥ গার্মেন্টসে সঙ্কট : ক্ষতি কার?

সবার ক্ষতি শাহনূর ইসলাম শাহীন ॥ গার্মেন্টস সঙ্কটে মূলত মালিক শ্রমিক কারোরই লাভবান হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের গার্মেন্টস শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গার্মেন্টস শিল্পের ভূমিকা অনন্য। একশ্রেণীর সুবিধাবাদী লোক নিজেদের অনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বার বার বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সুবিধাবাদীদের অবৈধ হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিতে যতটা না শ্রমিকরা দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী মালিকপক্ষ। অধিকাংশ সময় বিভিন্ন উৎসব পার্বণে শ্রমিকদের বেতন বোনাস প্রদানে মালিক পক্ষের অস্বীকৃতি এবং গড়িমসি করার কারণেই মূলত শ্রমিক অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। আর্থিক কারণ ছাড়াও গার্মেন্টস সঙ্কটের নানান কারণ রয়েছে। বিভিন্ন ঘটনায় শ্রমিকদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়ে একসময় তার বিস্ফোরণ ঘটে। গত নবেম্বরের শুরুর দিকে সাভারের একটি ৭ তলা গার্মেন্টসে উপরে শ্রমিকরা কাজ করছে এমন অবস্থায় গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ ভবনের পিলার মোটা করে পুনর্নির্মাণের জন্য পূর্বের চিকন পিলার ভাঙতে শুরু করলে শ্রমিকদের মনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ফলে বাধ্য হয়ে দুপুরের বিরতির পর শ্রমিকদের কেউই সেদিন আর কাজে যায়নি। সেই ঘটনায়ই হোক কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক ডিসেম্বরে মালিক পক্ষ সময়মতো বেতন না দেয়ায় শ্রমিক অসন্তোষ একসময় ভাঙচুরে রূপ নেয়। পরবর্তীকালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষ পুলিশ মোতায়েন করে। এভাবে শ্রমিক অসন্তোষের ফলে মূলত কেউই লাভবান হচ্ছে না। বরং মালিক শ্রমিক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি দীর্ঘমেয়াদী অস্থিরতার কারণে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। একটা প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য মালিক শ্রমিক উভয়েরই আন্তরিকতা প্রয়োজন। উভয় পক্ষের দায়িত্ববোধ, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা যে কোন প্রতিষ্ঠানকে মডেল রুপে উপস্থাপন সক্ষম। সম্প্রতি পরিবেশবান্ধব ও মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের দিক থেকে বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানও সেরা দশে জায়গা করে নিয়েছে। এটা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য গৌরবের। আর এটা অর্জন হয়ছে মালিক শ্রমিক উভয় পক্ষের সহযোগিতার মাধ্যমেই। সুতরাং গার্মেন্টস শিল্প রক্ষায় মালিক শ্রমিক উভয় পক্ষকে আন্তরিক হতে হবে। শ্রমিক অসন্তোষকে পুঁজি করে কেউ যেন অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করতে না পারে সংশ্লিষ্ট মহলকে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। গোসাইরহাট, শরীয়তপুর থেকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে... আশফাক আহমেদ ॥ দেশে সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে। এক কোটিরও বেশি মানুষ এই শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। অনেক বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশে এই খাতটি দ্রুত এগিয়ে চলেছে। সে কারণেই খাতটি অনেকের ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠেতে পারে। অতীতেও কোন কোন মহল বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতকে অস্থিতিশীল করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করেছে। ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসের পর ওই বছরের ২৭ জুন জিএসপি স্থগিত করেছিল আমেরিকা। সম্প্রতি আশুলিয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হলেও জটিলতা পুরোপুরি কাটেনি। সঠিকভাবে মোকাবেলা করা না গেলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। এই খাতে কোন বিপর্যয় সৃষ্টি হলে তা সারাদেশের অর্থনীতিকেই বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। তাই গার্মেন্টস খাতের এই শ্রমিক অসন্তোষকে যৌক্তিকভাবে ও নমনীয়তার সঙ্গেই মোকাবেলা করতে হবে। অতীতে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতে বিশৃঙ্খলা বা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির নানা অপচেষ্টা দেখা গেছে। তাতে দেশি-বিদেশী অনেকের সংস্রবও পাওয়া গেছে। তাই এই খাতের নিয়ন্ত্রকদের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। অনেক অসন্তোষ ও আন্দোলন-সংগ্রামের পর এই খাতে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছিল তিন বছর আগে। পাঁচ বছর পর আবার নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হবেÑ এটাই আইনস্বীকৃত। শ্রমিকরা বলছে, প্রয়োজন বিবেচনায় তিন বছর পরও বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি পর্যালোচনা করা যেতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে আশুলিয়ার শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর যে দাবি জানিয়েছে, তাকে অযৌক্তিক বলার কোন সুযোগ নেই। ক্রমাগত জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। তিন বছরে অন্য খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনও কিছু বেড়েছে। তাই তারা এমন দাবি করতেই পারে। কিন্তু যেভাবে তারা কিছু কারখানায় কাজ বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলনে নেমেছে, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকরা যে বেতনে কাজ করছে, তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও খুবই কম। তাই বিকাশমান খাতটির মালিকপক্ষকে বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে। রাজবাড়ী থেকে ক্ষুদ্র কারখানার সঙ্কট শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ ॥ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, গত আড়াই বছরে বন্ধ হয়ে গেছে অন্তত ৫৩০টি গার্মেন্টস কারখানা। জানা গেছে, শ্রম আইনের কিছু ফাঁকের সুযোগ নিয়ে মালিকপক্ষ অনেক সময় কৌশল হিসেবে তাদের কারখানা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেন এবং পরবর্তী সময়ে সুবিধা অনুযায়ী আবারও চালু করেন। ৫৩০টি গার্মেন্টস কারখানার ব্যাপারেও প্রথমে সে রকম অনুমানই করা হয়েছিল। কিন্তু অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আশঙ্কাজনক তথ্য। এমন অবস্থার পেছনে মালিকপক্ষের কোন কৌশল বা কারসাজি নেই, কারখানাগুলো আসলেও বন্ধ হয়ে গেছে। বড় কথা, এসবের কোনো একটিও আর চালু হয়নি, চালু হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে কাজ বা অর্ডার না থাকা, মূলধনের অভাব ও যথেষ্ট পরিমাণে ব্যাংক ঋণ না পাওয়া, ব্যাংকের দায় শোধ করতে না পারা, আর্থিক লোকসান, সময়মতো গ্যাস সংযোগ না পাওয়া ও নিয়মিত গ্যাস সঙ্কট, কর্মপরিবেশ না থাকা এবং অগ্নিকা-সহ দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ ও ধর্মঘট এবং মালিকপক্ষের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতও এসেছে একটি কারণ হিসেবে। তবে অর্ডার বা কাজ না পাওয়ার বিষয়টিকেই সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া ৫৩০টি কারখানার মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি এমন অনেক কারখানা রয়েছে, যেগুলো বড় বড় কারখানার সঙ্গে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করত। এসব কারখানার মালিকরা বিজিএমইএ বা অন্য কোন সংগঠনের সদস্য নন। কিন্তু বিশেষ করে রানা প্লাজা ধ্বংসের পর থেকে ক্রেতা দেশগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কারখানার কর্মপরিবেশ এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকারের প্রশ্নে চাপের সৃষ্টি করলে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করা ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো একের পর এক বন্ধ হতে থাকে। সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত হিসাবে এগুলোর সংখ্যা ৫৩০ বলা হলেও বাস্তবে আরও বেশিসংখ্যক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলে অভিজ্ঞ মহল অনুমান করছেন। এর ফলে বেকার হয়েছে প্রায় তিন লাখ শ্রমিক। জিএসপি সুবিধা না পাওয়া এবং কারখানার কর্মপরিবেশসহ বিভিন্ন কারণে প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও গার্মেন্টস তথা তৈরি পোশাকের রফতানি থেকেই এখনও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশ আয় হয়। পোশাকের গুণগতমান ভাল হওয়ায় এবং ক্রেতা দেশগুলোর সঙ্গে মালিকপক্ষ সুসম্পর্ক বজায় রাখায় গার্মেন্টস রফতানিতে বাংলাদেশ দ্রুত সাফল্যের পথে এগিয়ে চলছিল। এই সাফল্যকে অব্যাহত রাখা গেলে কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রফতানিতে সকল প্রতিযোগী রাষ্ট্রকে টপকে যেতে পারত। এমন এক সম্ভাবনার মুখে এসে দরকার যখন ছিল কারখানার সংখ্যা এবং উৎপাদন ও রফতানির পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ানো, ঠিক তেমন এক সময়ে দেশ শিকার হয়েছে উল্টো পরিস্থিতির। সরকারের দায়িত্ব হবে এমন সুদূরপ্রসারী পকিল্পনার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া, যাতে কোন গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ না হয় এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোও যাতে আবার চালু হতে ও নতুন করে উৎপাদনে যেতে পারে। রফতানি আয়সহ জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থেই গার্মেন্টের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া দরকার। রমনা, ঢাকা থেকে তথ্য ১ থেকে ১০ মানস বাড়ৈ ॥ ১. আশির দশক থেকে শুরু করে ২০০৫ পর্যন্ত গোটা গার্মেন্টস শিল্প সরকারকে কোন ট্যাক্স দেয়নি। ২. ২০০৫ সালের পর প্রথম বসানো হলো কর্পোরেট ট্যাক্স। ১০ পার্সেন্ট। ভারত-পাকিস্তানে গার্মেন্টস শিল্পে কর্পোরেট ট্যাক্স ৩০-৩৫ পার্সেন্ট। ৩. ২০১৫ তে কর্পোরেট ট্যাক্স বাড়িয়ে করা হলো ৩৫ পার্সেন্ট। কিন্তু বিজিএমই মানলো না। ৩৫% থেকে ২০% করা হলো কর্পোরেট ট্যাক্স। কিন্তু মালিকরা ১০ পার্সেন্টের বেশি ট্যাক্স দেবে না। এ বছর কমার্স মিনিস্টার ঘোষণা দিয়েছে গার্মেন্টস শিল্পে কর্পোরেট ট্যাক্স আবার ১০ পার্সেন্ট করা হবে। (এবং জানা যায় এই ১০% ট্যাক্সও তারা নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে এড়িয়ে যায়।) ৪. ২০০৫ সালের পর উৎস কর বসানো হলো ০.২৫ পার্সেন্ট। ২০১৪ পর্যন্ত কয়েক দফায় উৎস কর বাড়ানো হলো ০.৮ পার্সেন্ট। মালিকরা মানবে না। তারা হুমকি দিল। সরকার উৎসে কর কমিয়ে আনল ০.৩ পার্সেন্টে। ৫. এনবিআর একটা স্টাডিতে দেখিয়েছিল, উৎসে কর কমিয়ে আনায় সরকারের বাৎসরিক ক্ষতি হচ্ছে ২০০০ কোটি টাকা। ৬. এদেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা শুরু করে জিরো ক্যাপিটাল দিয়ে। স্টেইট ব্যাংক থেকে ঋণ পায়, ব্যাক টু ব্যাক এলসি পায়, বন্ড সুবিধা পায়, এক্সপোর্ট ক্রেডিট পায়। ৭. ২০১৫ সালের একটা রিপোর্ট বলছে, গত পাঁচ বছরে আরএমজি মালিকরা সরকার থেকে নগদ সাহায্য পেয়েছে প্রায় ৪ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। ৮. বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, ২০১৩ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো সবমিলিয়ে মোট ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে গার্মেন্টস শিল্পকে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক একাই ঋণ দিয়েছে ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ৯. এদেশের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫ হাজার টাকা। এটা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হিসাবে অলমোস্ট পভার্টি লাইন। দশ বছর আগে মেয়েরা ২ মাইল হেঁটে কাজে যেত, তারা এখনও হাঁটে। ১০ বছর আগে মেয়েরা ধারদেনা করে চলত, এখনও তাই চলে। অথচ গার্মেন্টস মালিকদের গত ১০ বছরের ওয়েলথ কার্ভ দেখেন। তাদের গাড়ির মডেল, তাদের হলিডে বুকিং, তাদের বাথরুমের টাইলস, তাদের শপিং ডেস্টিনেশন ... ১০. ঊনসত্তরে ১১ দফার ৭ নম্বর পয়েন্টটা ছিল, ‘শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা এবং শ্রমিক আন্দোলনে অধিকার দান।’ পাকিস্তান আমলে শ্রমিকরা যে দাবিতে রাস্তায় ছিল, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসেও আশুলিয়ার শ্রমিকরা সেই দাবিতেই রাস্তায় নেমেছে। মোহাম্মদপুর, ঢাকা থেকে শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা খন্দকার মাহ্বুবুল আলম ॥ অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় যখন জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা গতিশীল বা ত্বরান্বিত, ঠিক তখনই চলছে গার্মেন্টস সঙ্কট। যে কারণে খানিকটা হলেও দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে সংশ্লিষ্টদের। পোশাক শিল্পের মাধ্যমে আমাদের প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। যা জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে বিশেষভাবে ত্বরান্বিত করেছে। অত্যন্ত দুঃখজনক যে, গত ক’দিন আশুলিয়ায় অর্ধশতাধিকের মতো পোশাক কারখানা গার্মেন্টস শিল্প) বন্ধ ছিল। মজুরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার প্রেক্ষিতে এ অঞ্চলে (আশুলিয়া) শ্রমিক অসন্তোষ চলছিল। ফলে পোশাক প্রস্তুতকারী ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়। শ্রমিক অসন্তোষ বা ধর্মঘট কালে-কালে, যুগে-যুগে ছিল। যে কোন দেশের উন্নয়নের চাকাকে ঘুরাতে শ্রমিকদের গায়ের ঘাম ও কোন দুর্ঘটনাবশত রক্ত ঝরানোর নির্মম ইতিহাস তো আছেই। আমাদের দেশে সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনা এবং তাজরিন ফ্যাশনের অগ্নিকা- তারই নির্মম সাক্ষী। তবুও শ্রমিকদের হাত স্থায়ীভাবে থেমে নেই। শ্রমিকদের এই কর্মমুখর হাতগুলোই আমাদের সমূহ উন্নয়নের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, বহু মালিক গোষ্ঠী শ্রমিকদের শোষণ করে নিজেদের ধন ভা-ার বহুগুণ সমৃদ্ধ করেছে; কিন্তু সেই শ্রমিকদের অনেকের ঘরে ঠিকমতো ভাতের হাঁড়িটি উনুনে চড়াতে পারে না। তাদের ছেলেমেয়েদের ভাল স্কুলে লেখাপড়া করাতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে রোগে-শোকে চিকিৎসা ব্যয় মিটাতে পারে না। অনেকের ছেলেমেয়েদের গায়ে ঠিকমতো বস্ত্র ওঠে না। তবুও শ্রম বন্ধ নেই ওদের। উন্নয়নের চাকা তাদের হাতে অবিরাম ঘুরছেই। পোশাক শিল্পের এই অস্থিরতা স্থায়ীভাবে নিরসন না ঘটলে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে শ্রমিকরাও কোনভাবে লাভবান হবে না। এমন ঘোলা পানিতে হয়ত মাছ শিকারের চেষ্টা চলবে অন্যদের। এ ব্যাপারে মালিক-শ্রমিক ও সরকার মিলে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিলেও এই মানামানি শ্রমিকদের মধ্যে কার্যকর হয়নি। তবে কেন? যে কারণে অনেকেই অন্য কোন শক্তির ষড়যন্ত্রের আভাস খুঁজে পাচ্ছেন। যদি এমনটি হয়ে থাকে তা কোন পক্ষের জন্য কখনও শুভ হবে না। দেশ এবং দেশের জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে এ পরিস্থিতির যৌক্তিক নিরসন জরুরী। মধ্যম হালিশহর, চট্টগ্রাম থেকে কিছুটা তুমি ছাড়, কিছুটা আমি এম মনসুর আলী আমাদের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় ও প্রধান খাত পোশাক শিল্প। দেশের অন্যতম প্রধান রফতানি আয়ের এই খাতে শ্রমিক আন্দোলন খুবই ভাবনার বিষয়। এই শিল্পে লাখ লাখ নারী পুরুষ চাকরি করে। আর এদের বেতনের টাকায় চলে দেশের জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ। এ খাত বন্ধ হয়ে গেলে দেশের লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। সংঘাতময় শ্রমিক আন্দোলন পরিস্থিতি এড়াতে ৫৫টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছিল মালিকপক্ষ। কারখানা বন্ধ থাকলে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে স্থবিরতা নেমে এলে এ ক্ষতি কার? এ ক্ষতি দেশের মানুষের, এ ক্ষতি প্রতিষ্ঠানের, এ ক্ষতি শ্রমিকের, এ ক্ষতি দেশের অর্থনীতির। কারখানা বন্ধ করা, শ্রমিক আন্দোলন করা, এগুলো কি সমস্যা সমাধানের পথ? সবাই জানে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ও বাসাভাড়া যেভাবে বেড়েছে, তাতে মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। বছর বছর বাড়ি ভাড়া ও পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধিসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পরিপ্রেক্ষিতে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পুনর্বিবেচনা করতে হবে মালিকপক্ষকে। শ্রমিক আন্দোলনের নামে দেশের অন্যতম প্রধান রফতানি আয়ের এই গার্মেন্টস খাত যাতে নতুন করে সমস্যার মধ্যে না পড়ে, এ খাতে যাতে অচলাবস্থা বিরাজ না করে সেজন্য কারখানা বন্ধ না করে শ্রমিকদের সঙ্গে দ্রুত আলোচনা শুরু করা দরকার। এজন্য মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষ উভয়কেই ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। কবির ভাষায় বলতে গেলে বলতে হবে- ‘কিছুটা তুমি ছাড়, কিছুটা আমি, এভাবে মিলেমিশে সুখ ডেকে আনি।’ সরাইল বাজার, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া থেকে দেশের স্বার্থে শিল্প বাঁচাতে হবে কাজী সিরাজুল ইসলাম ॥ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম গার্মেন্টস শিল্প। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্প দীর্ঘ কয়েক দশক যাবৎ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এ দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রাণ গার্মেন্টস শিল্প। অবশ্য দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে চিংড়ি শিল্প, চা শিল্প এবং চামড়া শিল্প বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করে চলেছে। অতীতের যে কোন সময় অপেক্ষা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। বিশ্ব ব্যবস্থায় বাংলাদেশ যতগুলো বিষয়ে বিশেষভাবে আলোচিত এবং পরিচিত তার মধ্যে অন্যতম গার্মেন্টস শিল্প। বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের মান কেবল মানসম্মত তা নয়, এদেশের তৈরি পোশাকের কদর রয়েছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অর্থনীতিকে সুদৃঢ়করণের ক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্প বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। সম্ভাবনাময় গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা মাঝে মধ্যে নিজেদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিক্ষোভ মিছিলসহ সভা সমাবেশ করে থাকে। এক শ্রেণীর শ্রমিক নামধারী কথায় কথায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ নানামুখী অপতৎপরতায় জড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের চলমান উত্থান এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এদেশের গার্মেন্টস সামগ্রীর চাহিদার কারণে এদেশের গার্মেন্টস শিল্পের বিরুদ্ধে নানামুখী চক্রান্ত এবং ষড়যন্ত্র থেমে নেই। অগ্রসরমান গার্মেন্টস শিল্পের ক্রমবর্ধমান এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার বিকল্প নেই। নানা আন্দোলনের ফলে গার্মেন্টস শিল্প তার উৎপাদনের গতিশীলতা হারিয়ে ফেলছে। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মালিকদের যেমন চিন্তা করতে হবে, শ্রমিক ব্যতীত তারা তাদের কারখানা চালিয়ে রাখতে পারবে না, তেমনি শ্রমিকদেরও চিন্তা করতে হবে মালিক ব্যতীত তারাও বেকারত্বের মধ্যে পড়ে যাবে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরে এসে যদি উভয় পক্ষ অন্যের অবস্থানে দাঁড়িয়ে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবে তাহলে সমাধান সহজ হয়। সাধারণ মানুষ চায় মালিক শ্রমিক ও সরকার সম্মিলিতভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন অসন্তোষের সমাধান খুঁজে বের করা। যাতে ভবিষ্যতে এই শিল্প আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে এবং দেশের অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করে গড়ে তুলতে পারে। একইভাবে সরকারের উচিত কঠিনভাবে সেই সব সন্ত্রাসীকে দমন করা যারা আন্দোলনের নামে সম্পদের ক্ষতি করে থাকে। বৈদেশিক প্রতিযোগিতা আমাদের যে গার্মেন্টস ধ্বংস করতে পারেনি, সে গার্মেন্টস শিল্পকে আজ সংঘাত-সংঘর্ষ বাধিয়ে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে, বিদেশে বদনাম রটিয়ে এবং মার্কেট নষ্ট করে ধ্বংস করতে চায়। তাই সবাইকে সাবধান হতে হবে। আমাদের দেশের স্বার্থেই গার্মেন্টস শিল্পকে বাঁচাতে হবে। ফরিদপুর থেকে
×