ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোবাইলে দৈনিক লেনদেন ৭৩১ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬

মোবাইলে দৈনিক লেনদেন ৭৩১ কোটি টাকা

রহিম শেখ ॥ রোকসানা বেগম মিরপুরের একটি গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি করেন। উপার্জিত অর্থের একটি অংশ প্রতিমাসের শুরুতেই বৃদ্ধা মাকে পাঠাতে হয়। আগে দিন কয়েক সময় লাগলেও এখন নিজের মোবাইল থেকে মায়ের মোবাইলে টাকা পাঠান মুহূর্তেই। রোকসানা বেগম জনকণ্ঠকে জানান, কারখানার মালিক বেতন দেন মোবাইলে। পরে নিজের মোবাইল থেকেই মায়ের মোবাইলে টাকা পাঠাই। গ্রামের বাজার থেকে সেই টাকা তুলে নেন রোকসানার বৃদ্ধা মা। দেশে এখন রোকসানা বেগমের মতো মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবধারীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটির কাছাকাছি। পরিসংখ্যান বলছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শুধু নবেম্বর মাসেই দৈনিক গড়ে ৭৩১ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। গত পুরো মাসে লেনদেন হয়েছে ২১ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে নবেম্বর মাসে বেতন দেয়া হয়েছে ৩২২ কোটি টাকা। যা অক্টোবর মাসের তুলনায় ৭৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি। মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন শুধু দেশেই নয়, প্রতিদিন বিদেশ থেকেও অর্থ আসছে। পরিসংখ্যান বলছে, নবেম্বর মাসে প্রায় ৮ কোটি টাকা রেমিটেন্স এসেছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। মুহূর্তেই প্রবাসীদের কষ্টার্জিত পরিশ্রমের অর্থ নিকটাত্মীয়দের কাছে দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বদৌলতে। প্রতিমাসের খরচা মেটাতে সৌদি প্রবাসী স্বামী রমজান আলী স্ত্রীকে টাকা পাঠান মোবাইলে। সেই টাকা তুলতেই মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুরখান বাজারে এসেছিলেন স্ত্রী মাবিয়া সুলতানা। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, আমার স্বামী আগে ২-৩ মাস পর পর ডাকযোগে টাকা পাঠাত। তখন সাংসারিক খরচ মেটাতে সমস্যা হতো। এখন মোবাইল ব্যাংকিং থাকায় প্রতিমাসের টাকা প্রতিমাসেই পাই। গতিশীল, নিরাপদ ও সহজ লেনদেনের সুবিধার ফলে মাবিয়ার মতো মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব মতে, চলতি বছরের নবেম্বর মাস শেষে দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে তিন কোটি ৯৬ লাখ ২০ হাজার দাঁড়িয়েছে, যা আগের মাসের চেয়ে প্রায় ৬ লাখ ৭১ হাজার বেশি। এর আগে ২০১৩ সালে দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক সংখ্যা এক কোটির মাইলফলক অতিক্রম করে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহক সাড়ে ৩ কোটি অতিক্রম করে। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘বিকাশ’ এবং ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ‘রকেট’ মোবাইল ব্যাংকিং এ সেবায় এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, নবেম্বর মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ক্যাশ ইন ট্রানজেকশন হয়েছে ৯ হাজার ২৯৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এ সময়ে ক্যাশ আউট ট্রানজেকশন হয়েছে ৮ হাজার ৫৫৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অক্টোবর মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ক্যাশ ইন ট্রানজেকশন হয়েছে ৮ হাজার ৯৫০ কোটি ৮০ লাখ টাকা ও ক্যাশ আউট ট্রানজেকশন হয়েছে ৭ হাজার ৯৫৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ফলে এক মাসের ব্যবধানে ক্যাশ ইন ও ক্যাশ আউট ট্রানজেশন বেড়েছে ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এ সময়ে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে ট্রানজেকশন হয়েছে ৩ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। যা আগের মাসে ছিল ৩ হাজার ২৬ কোটি টাকা। এক মাসে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে লেনদেন বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্যদিকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নবেম্বর মাসে ৩২২ কোটি ৫১ লাখ টাকার বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। যা আগের মাসের তুলনায় ৭৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি। আগের মাস সেপ্টেম্বরে বেতন পরিশোধ করা হয়েছিল ১৮৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ সময় ইউটিলিটি বিল পরিশোধ প্রায় ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৯৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। আগের মাসে ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করা হয়েছিল ২০২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এছাড়া নবেম্বর মাসে অন্যান্য বিল বাবদ লেনদেন হয়েছে ৩৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। যা আগের মাসে ছিল ৩৬৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, নবেম্বরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সক্রিয় এ্যাকাউন্টের সংখ্যাও কিছুটা বেড়েছে। অক্টোবর পর্যন্ত সক্রিয় এ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ৩৮ লাখ। যা নবেম্বরে বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৫১ লাখ। নিয়ম অনুযায়ী, কোন এ্যাকাউন্ট থেকে টানা তিন মাস কোন ধরনের লেনদেন না হলে তা ইন-এ্যাকটিভ বা নিষ্ক্রিয় এ্যাকাউন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়। আর তিন মাসের মধ্যে একটি লেনদেন হলেও তা সক্রিয় হিসেবে বিবেচিত। অবশ্য বড় কোন অনিয়ম না পাওয়া গেলে এ্যাকাউন্ট বন্ধ করে না ব্যাংক। ব্যাংকগুলো সরাসরি মোবাইল ব্যাংকিং করতে পারে না বিধায় এ কার্যক্রমের জন্য এজেন্ট নিয়োগ করে। নির্ধারিত কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এজেন্ট নিয়োগ দেয় ব্যাংকগুলো। প্রতিবেদন অনুযায়ী, নবেম্বর মাস শেষে ব্যাংকগুলোর মনোনীত এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৯৪ হাজার ৬২৯ জন। অক্টোবর পর্যন্ত এজেন্টের সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৭১ হাজার ৩৩৭ জন। জানা গেছে, দেশে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম প্রথম শুরু করা হয় ২০১০ সালের ৩১ মার্চ। এরপরের বছরে এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত গাইডলাইন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অবশ্য পরবর্তীতে মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনে ঝুঁকি মোকাবেলায় আরও একটি নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেশের ২০টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং করার অনুমোদন পেলেও ১৮টি ব্যাংক বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং চালু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের ‘বিকাশ’, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ‘রকেট’, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ‘মাই ক্যাশ’, ওয়ান ব্যাংকের ‘ওকে ব্যাংকিং’, ব্যাংক এশিয়ার ‘হ্যালো ব্যাংকিং’ যমুনা, কমার্স ও রূপালী ব্যাংকের ‘শিওর ক্যাশ’, আইএফআইসি’র ‘বাংলায় মোবাইল ব্যাংকিং’, প্রাইম ব্যাংকের ‘ইজি ক্যাশ’, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ‘ইউ ক্যাশ’, ইসলামী ব্যাংকের ‘এম ক্যাশ’, এক্সিম ব্যাংকের ‘এক্সিম ক্যাশ’, ট্রাস্ট ব্যাংকের ‘মোবাইল মানি ব্যাংকিং’, সাউথ-ইস্ট ব্যাংকের, ‘টেলিক্যাশ’। এছাড়া আরও কয়েকটি ব্যাংক ব্যাংক মেবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে। জানা গেছে, বর্তমানে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে ৭ ধরনের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এগুলো হলো- ইনওয়ার্ড রেমিটেন্স, ক্যাশ-ইন ট্রানজেকশন, ক্যাশ আউট ট্রানজেকশন, পিটুপি ট্রানজেকশন, বেতন বিতরণ, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ। এছাড়া আরও কিছু সেবা আছে, যেগুলো সরাসরি উল্লেখিত ৬টি ক্যাটাগরির কোনটার অন্তর্ভুক্ত নয়, এই ধরনের সেবাসমূহকে অন্যান্য ক্যাটাগরির আওতায় বিবেচনা করা হয়। যেমন- স্কুল-কলেজের টিউশন ফি পরিশোধ।
×