ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আজ শিল্পাচার্যের জন্মদিন

রুচির দুর্ভিক্ষ সরিয়ে ক্যানভাসে চিন্তার অকপট প্রকাশ

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬

রুচির দুর্ভিক্ষ সরিয়ে ক্যানভাসে চিন্তার অকপট প্রকাশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শিল্পের মুখ্য শর্ত হচ্ছে সারল্য। শিল্প হবে চিন্তার অকপট প্রকাশ। এমন ভাবনায় ক্যানভাস রাঙিয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন শিল্পের আবেদন। রুচির দুর্ভিক্ষকে সরিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন শিল্পের পথরেখা। তাঁর রং-তুলির আঁচড়েই এদেশের চারুকলার যাত্রা শুরু হয়েছিল। আপন মনন ও সৃজনশীলতার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিকশিত করেছেন বাংলার চিত্রকলার ভুবনকে। অনন্য সব শিল্প সৃষ্টি করে বিশ্বসভায় তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের শিল্প ও সংস্কৃতি। আলোকবর্তিকা হয়ে শিল্পের সীমানা দেখিয়েছেন প্রকৃতি ও মানুষের ছবি আঁকা এই চিত্রকর। শুধু তাই নয়, বাংলার চারুশিল্প আন্দোলনেও রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। আজ বৃহস্পতিবার এই কিংবদন্তি শিল্পীর ১০২তম জন্মবার্ষিকী ও ১০৩তম জন্মদিন। ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এই পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী। শিল্পাচার্যের জন্মজয়ন্তী উদ্্যাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ জয়নুল উৎসবের আয়োজন করেছে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টায় চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় উদ্বোধনী সঙ্গীতের মাধ্যমে শুরু হবে শিল্পাচার্যকে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা নিবেদনের এ আয়োজন। উৎসবে ‘জয়নুল সম্মাননা-২০১৬’ গ্রহণ করবেন বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রখ্যাত শিল্পী অধ্যাপক হাশেম খান এবং অধ্যাপক যোগেন চৌধুরী। সকাল সাড়ে দশটায় জয়নুল মেলা উদ্বোধন করবেন অতিথিরা। উন্মোচন করা হবে তারক গড়াই নির্মিত ভাস্কর্য। থাকবে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পাচার্যের সহধর্মিণী জাহানারা আবেদিন। সভাপতিত্ব করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। বাংলাদেশে চারুকলা চর্চা ও আন্দোলনের পথের দিশারী বিরল প্রতিভার অধিকারী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলায় জš§গ্রহণ করেন। বাবা তমিজউদ্দীন আহমেদ ও মা জয়নাবুন্নেছা। বেড়ে উঠেছেন ব্রহ্মপুত্র নদের প্লাবন অববাহিকার শান্ত, সুনিবিড় ও রূপময় প্রাকৃতিক পরিবেশে। শৈশব থেকেই ছবি আঁকার প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক। রং-তুলির খেলায় ফুল-ফল, বৃক্ষ, লতাপাতা, মাছ, পাখিসহ নানা বিষয় মেলে ধরতেন ক্যানভাসে। আর এই ছবি আঁকার টানেই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। আশ্রয় পাতেন কলকাতায়। সেখানে ভর্তি হন গবর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এখানেই চলে শিল্পাচার্যের চারুশিক্ষার দীক্ষা। ১৯৩৮ সালে ড্রইং এ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে প্রথম প্রেণীতে প্রথম হয়ে অর্জন করেন স্নাতক ডিগ্রী। ততদিনে শিল্পী হিসেবেও শিল্পরসিকদের স্বীকৃতি অর্জন করে নিয়েছেন। স্থান করে নেন মুষ্টিমেয় আধুনিক ভারতীয় শিল্পীর তালিকায়। এরপর তিনি কলকাতা থেকে চলে আসেন ঢাকায়। এ দেশের শিল্পের ভিত রচনায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জয়নুল আবেদিন। তাঁর হাত ধরেই বিকশিত হয় এদেশের চারুশিল্প মাধ্যম। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা আর্ট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ)। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক আধুনিক শিল্পচর্চার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। আর শুধু আধুনিক শিল্পচর্চার বিকাশসাধন নয়, তিনি চেয়েছিলেন এ দেশের লোকশিল্পের উন্নয়ন ও তার সঙ্গে আধুনিক শিল্পের মেলবন্ধন। সেই আকাক্সক্ষায় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় প্রতিষ্ঠা করেন লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর অন্যতম উপদেষ্টা মনোনীত হন। যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার কংগ্রেস ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। শিল্পীজীবনে রং-তুলির ছোঁয়ায় জয়নুল আবেদিন ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে এঁকেছেন দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র। ১৯৬৯ সালে তাঁর ক্যানভাসে উঠে এসেছে গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট। ১৯৭০ সালে এঁকেছেন ৬৫ ফুট দীর্ঘ বিখ্যাত চিত্রকর্ম নবান্ন। একই বছরে মনপুরা নামে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের হƒদয়স্পর্শী চিত্র সৃজন করেছেন। শিল্পীর এসব কালজয়ী শিল্পকর্ম দেশের সীমা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লে পেয়েছে ব্যাপক প্রশংসা ও স্বীকৃতি। শিল্পীর আঁকা দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা ছাড়াও বিদ্রোহী, মুক্তিযোদ্ধা, গুনটানা, সাঁওতাল রমণী, সংগ্রাম, গ্রামীণ নারীর চিত্রমালা শীর্ষক ভাস্কর্য শিল্পকলায় অক্ষয় হয়ে আছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলার প্রকৃতি, জীবনাচার, প্রাচুর্য, দারিদ্র্য এবং বাঙালীর স্বাধীনতার স্পৃহা তাঁর তুলি আর ক্যানভাসে মূর্ত করে তুলেছিলেন। শিল্পকলার সুবাদে বাঙালী সংস্কৃতিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্ব দরবারে। একইসঙ্গে আমৃত্যু সমাজ থেকে রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করে সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত করার সাধনায় নিমজ্জিত রেখেছিলেন নিজেকে। ১৯৪৬ সালে জয়নুল আবেদিন ঢাকা নিবাসী তৈয়ব উদ্দিন আহমদের মেয়ে জাহানারা বেগমকে বিয়ে করেন। জাহানারা বেগম পরবর্তীতে জাহানারা আবেদিন নামে নিজেকে পরিচিত করেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবনের ফসল তিন ছেলে। তাঁরা হলেন সাইফুল আবেদিন, খায়রুল আবেদিন ও মঈনুল আবেদিন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ৬১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন জয়নুল আবেদিন।
×