ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাঙালী জীবনে সরিষা

বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে হলদে ফুলের নিসর্গ- কত কথা, কত গল্প

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬

বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে হলদে ফুলের নিসর্গ- কত কথা, কত গল্প

সমুদ্র হক ॥ কতই না কথা সরিষাকে নিয়ে। বাঙালী জীবনে ছোট্ট এক দানা এশিয়ার অন্যতম রবিশস্য। বিশেষ করে এই উপমহাদেশে সরিষার আগমন ঘটায় পর্তুগীজরা। তারা কৃষি ফসলের নানা কিছু খুঁজতে থাকে। এক পর্যায়ে দ্বিবীজপত্রী একবর্ষজীবী প্রজাতির উদ্ভিদ আবিষ্কার করে। এরই একটি সরিষা। শীতের আগমনীতে এর আবাদ। রবিশস্যের আসনে গিয়ে ঠেকেছে। গ্রামীণ জীবনে শীতের মৌসুমে বিস্তীর্ণ মাঠ সরিষার ফুলের হলদে ভূমি যেন অপরূপ এক নিসর্গে পরিণত হয়। সরিষা ফুলের ক্ষেতের জমির আল দিয়ে শিশুদের ছোটাছুটির দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয়। সবচেয়ে ভাল মধুর ফুল এখন সরিষা। এই সরিষাকে নিয়ে কত যে কল্প গল্প আছে! ভূত তাড়াতে সরিষা লাগে (এটা কুসংস্কার)। সরিষার মধ্যেই যদি ভূত থাকে তাহলে ভূত পালাবে কী করে (এটি রূপক অর্থে)। চোখে সরষে ফুল দেখছে (রূপক অর্থে)। কলুর বলদ (খুলু আঞ্চলিক) কথাটি এসেছে সরিষা থেকেই। ঘানিতে বলদকে কাঠের সঙ্গে বেঁধে ঘূর্ণিপাক দিয়ে সরিষা ভেঙ্গে তেল বের করা হতো। দিনমান এই বলদ ঘুরত বলে রূপক অর্থে যিনি সংসারের ঘানি টানেন তাকে বলা হতো কলুর বলদ। যাদের তেলের ঘানি ছিল তাদের বলা হতো খুলু, যার বিশুদ্ধ উচ্চারণ কলু। এমন অনেক কথার সঙ্গে মশা তারাবার উপকরণ হয়ে আছে সরিষার তেল। আজ যারা প্রবীণ ও মধ্য বয়সী তাদের স্মৃতিতে আছে কিভাবে সন্ধ্যার পর সরিষার তেল কাসার থালায় ও প্লেটে মেখে মশা তাড়ানোর ব্যবস্থা করা হতো। ছেলে বেলায় ভূত দেখানোর ম্যাজিক দেখানো হতো সরিষার তেল দিয়ে। অন্ধকারে তেলের মধ্যে পাতিলের কালি গুলিয়ে গায়ে মেখে কি না মজা করা হতো। একটা সময় কাজল বানানো হতো সরিষার তেল দিয়ে। ছোট বাটিতে সরিষার তেল ভরে তাতে সলতে চুবিয়ে আগুন ধরে দেয়ার পর প্রজ্বলনের সঙ্গে যে কালি উদ্গীরিত হতো তা ধরে রাখা হতো কাজল দানিতে। এই কাজলে নবজাতকের কপালের কোনে টিপ দেয়া হতো। পুরানো দিনের লোকজন বলত, কাজলের এই টিপে কারও নজর লাগবে না সুদর্শন হবে (অবশ্য যৌবন তারুণ্যে কারও না কারও নজর পড়া প্রণয়ের আবির্ভাবে)। শীত মৌসুমে শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক রাখতে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর বিষয়টিও রূপক অর্থে এসেছে। চিন্তাবিহীন ঘুমানোর জন্য বলা হয় নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও। একটা সময় গ্রামীণ ও শহুরে জীবনে গোসলের আগে সরিষার তেল মুখে হাতে পায়ে বুকে পিঠে উড়ুতে মেখে রোদে জলচৌকিতে কিছুক্ষণ বসে তাপিয়ে নিয়ে কুয়া বা ইঁদারার পাড়ে গিয়ে রশিতে ছোট বালতি এঁটে পানি তুলে গায়ে ঢেলে গোসল করা হতো। শহুরে জীবনে হস্তচালিত টিউবওয়েলের পানি সরিষার তেল মাখা শরীরে ঢেলে দেয়া হতো। প্রবীণরা বলতেন এভাবে গোসল করলে রোগব্যাধি অনেক কমে যায়। শরীর ঝরঝরে হয়। আগে সরিষার তেল ছাড়া কোন রান্না হয়নি। সরিষার খাঁটি তেল নেয়ার জন্য হাট বাজার থেকে শিশি বোতলে ভরে তেল আনা হতো। সরিষার তেলে আলু ছানা যে কি স্বাদের এই কথা শুনলে ভোজন রসিকদের জিহ্বায় পানি চলে আসে। আগে সয়াবিনের তেলে রান্নার কথা কেউ ভাবেনি। মনে করা হতো সরিষাই খাঁটি ভোজ্য তেল। শুকনো মুড়ি না খেয়ে তাতে কয়েক ফোঁটা সরিষার তেল পিঁয়াজ মরিচ মিশিয়ে ঝাল মুড়ি খাওয়া হয় এখনও। সরিষার এত কথার সঙ্গে বর্তমানে সরিষা ফুলের মধু সর্বোত্তম মধু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা মৌমাছিরা সরিষার ফুল থেকে যে মধু সংগ্রহ করে মৌচাক বানায় সেখানেই মেলে উন্নতমানের মধু। খুলনার সুন্দরবনে মৌচাকের বাওয়ালিরা সরিষা ফুলের মধুর মৌচাক খুঁজে বেড়ায়। দেশের প্রতিটি স্থানে সরিষার মৌসুমে কাঠের বিশেষ ধরনের বাক্সে মৌমাছি পালন করে ক্ষেতে রাখা হয়। মৌমাছিরা সরিষার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে ক্ষেতের মধ্যে পেতে রাখা বাক্সগুলোতে বাসা বানায়। এই বাক্সে চাক বানায় মৌমাছিরা। মৌচাক পূর্ণ হয়ে মধুতে ভরে গেলে পাত্রে মধু বের করে নেয়া হয়। বর্তমানে এই মধু দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছেছে। এই মধু এখন কৃষকদের আয়ের বড় পথ হয়েছে। কৃষকদের মৌপালনে প্রশিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে। অনেক গ্রামে সরিষা মৌসুমে প্রশিক্ষিত মৌপালনকারীরা ফসলের মতোই মধু সংগ্রহ করে। দেশে বর্তমানে সরিষার সঙ্গে সয়াবিনের চাষও শুরু হয়েছে। তাই বলে সরিষার তেলের কদর এখনও কমেনি। আধুনিক মেশিনে সরিষা ভেঙ্গে তেল তৈরি করা হয়। তেল তৈরির পর যে বাই প্রোডাক্ট বের হয় তা খৈল। এই খৈল সার ও পশুখাদ্য। সরিষার গাছও ভাল জ্বালানি। গ্রামীণ জীবনে মাটির চুলায় এখন সরিষার গাছ আগুনের প্রজ্বলন বাড়াতে ব্যবহার করা হয়। সরিষার তেলের দাম সয়াবিনের চেয়ে বেশি। ঘরে বিশেষ খাবারের আয়োজন এবং অতিথিদের খাবার তৈরিতে সরিষার তেলের ব্যবহার হয়। বর্তমানে সরিষার খাঁটি তেল মেলা বেশ কঠিন।
×