ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দুই নারী জঙ্গী অনুতপ্ত

মুসার নির্দেশে শাকিরা আত্মঘাতী হলেও তৃষা আত্মসমর্পণ করে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬

মুসার নির্দেশে শাকিরা আত্মঘাতী হলেও তৃষা আত্মসমর্পণ করে

শংকর কুমার দে ॥ বিদেশীদের হত্যার উদ্দেশে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলার ছক কষে তিন নারী জঙ্গীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছিল মোস্ট ওয়ান্টেড শীর্ষ জঙ্গী মাঈনুল ওরফে মুসা। মুসার নির্দেশেই আত্মঘাতী হয়ে নিহত হয় নারী জঙ্গী শাকিরা। পুলিশ অভিযানের সময়ে মুসা তার স্ত্রী তৃষা মনিকে আত্মঘাতী হওয়ার নির্দেশ দিলেও সে নির্দেশ অমান্য করে আত্মসমর্পণ করে। তাকে অনুসরণ করে আত্মসমর্পণ করে জেবুন্নাহার শিলাও। আশকোনার সূর্য ভিলা নামের জঙ্গী আস্তানা থেকে যেভাবে, যার কথায় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে জিজ্ঞাসাবাদে তার নেপথ্য বর্ণনা করেছে দুই নারী জঙ্গী Ñজেবুন্নাহার শিলা ও তৃষা মনি। তৃষা মনির স্বামী মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসাই আজিমপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে আশকোনার জঙ্গী আস্তানায় নিয়ে আসে নিহত মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলাকে। স্ত্রী তৃষা মনিকে রেখেই জেবুন্নাহার শিলাকে বিয়ে করতে চেয়েছে মুসা। জেএমবির ছিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের হাত ধরে নব্য জেএমবির হাল ধরা শীর্ষ জঙ্গীদের মধ্যে মুসাই এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সবচেয়ে বেশি মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গী । দুই নারী জঙ্গী জেবুন্নাহার শিলা ও তৃষা মনিকে সাত দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, ধর্মের অপব্যাখ্যা করে ভুল বুঝিয়ে জঙ্গীর পথে আনার পর এখন বুঝতে পারার পর অনুশোচনা করছি, অনুতপ্ত। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট জিজ্ঞাসাবাদ করছে দুই নারী জঙ্গী শিলা ও তৃষাকে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রিমান্ডে থাকা জঙ্গী মুসার স্ত্রী তৃষা মনি জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, শুক্রবার রাতে যখন আশকোনার সূর্য ভিলা নামের তিন তলা বাড়ির নিচতলার জঙ্গী আস্তানাটি পুলিশ ঘিরে ফেলে তখন সে মোবাইলে ফোন করেছিল রাজশাহীর গ্রামের বাড়ি তার বাবা সামাদকে। শুক্রবার রাত তখন প্রায় সাড়ে তিনটা। বাবা সামাদ অজ্ঞাত মোবাইল ফোন থেকে পাওয়া নম্বরে আবার ফোন করলে শুনতে পান মেয়ে তৃষার কণ্ঠ। কাঁদো সুরে তৃষা তার বাবাকে বলতে থাকে, বাবা Ñআমার বিপদ, পুলিশ আমাদের বাসা ঘিরে ফেলেছে। তখন বাবা সামাদ তার মেয়ে তৃষাকে বলেন, পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ কর। বাবার কথায় মেয়ে তৃষা রাতেই আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে পুলিশের উদেশে রাত থেকে শনিবার দুপুরে আত্মসমর্পণ করার আগ পর্যন্ত প্রায় ১১টি চিরকুট পাঠাতে থাকে। জঙ্গী আস্তানা থেকে জানালা দিয়ে পুলিশের উদেশে পাঠানো সেই চিরকুটেও আত্মসমর্পণ করার কথা বলে; জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে তৃষা। তারপরই কোলের সন্তানসহ তৃষা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। অপরদিকে নিহত মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা আত্মসমর্পণ না কারার ব্যাপারে অনঢ় ছিল। কিন্তু পুলিশ তার মা জোহরাকে নিয়ে যায় জঙ্গী আস্তানার সামনে। পুলিশের দেয়া হ্যান্ডমাইকে মা জোহরা তার মেয়ে শিলাকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিষয়টি তিনিই দেখবেন বলে হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা করে আত্মসমর্পণ করার জন্য বলতে থাকলে তৃষার আত্মসমর্পণের পথ ধরে সন্তানকে কোলে নিয়ে শিলাও পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আশকোনার জঙ্গী আস্তানায় স্ত্রী তৃষা ও নিহত মেজর জাহিদের স্ত্রী শিলাকে নিয়ে আসে মাঈনুল ইসলাম মুসাই। গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে রূপনগরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাবেক মেজর ও জঙ্গী সংগঠন জেএমবির সামরিক শাখার অন্যতম শীর্ষ নেতা জাহিদুল ইসলাম। স্বামী জাহিদ নিহত হওয়ার আগে স্ত্রী শিলা, মুসার স্ত্রী তৃষাসহ জঙ্গীদের পরিবার থাকত মিরপুরের রূপনগরের জঙ্গী আস্তানায়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় দুই সহযোগী জঙ্গীসহ নব্য জেএমবির কথিত প্রধান তামিম আহমেদ চৌধুরী নিহত হওয়ার পর তারা মিরপুর রূপনগর থেকে শিলা, তৃষাসহ অন্যরা আজিমপুর জঙ্গী আস্তানায় গিয়ে ওঠে। আজিমপুর জঙ্গী আস্তানায় থাকাকালে মিরপুরের রূপনগরে মেজর জাহিদ নিহত হলে তার স্ত্রী শিলাকে আশকোনায় নিয়ে যায় জঙ্গী মুসা। তখন আশকোনায় সন্তানসম্ভবা ছিল মুসার স্ত্রী তৃষা। শিলাকে আজিমপুর থেকে আশকোনায় নিয়ে যাওয়ার চার দিনের মাথায় আজিমপুরে পুলিশ অভিযান চালায়। তখন শিলার বড় মেয়ে, নিহত তানভির কাদেরীর এক যমজ ছেলে, স্ত্রী, জঙ্গী বাশারুজ্জামানের স্ত্রী, জঙ্গী মারজানের স্ত্রীকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়। শিলা অভিযানের চারদিন আগে আশকোনায় চলে যাওয়ায় সেই যাত্রায় গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হলেও গত শনিবারের অভিযানে আত্মসমর্পণ করার পর গ্রেফতার হয়। জিজ্ঞাসাবাদে শিলা জানায়, স্বামী মেজর জাহিদ নিহত হওয়ার পর জঙ্গী মুসার চোখ পড়ে তার ওপর। তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় মুসা। নব্য জেএমবি জঙ্গী সংগঠনের নিয়ম অনুযায়ী ৩ থেকে ৪ মাস ইদ্দতকালীন শেষ হওয়ার পর তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা ছিল। শিলার প্রতি আকর্ষণের বিষয়টি জানার পর মুসার ওপর চরম ক্ষুব্ধ ছিল তার স্ত্রী তৃষা মনি। পুলিশ রিমান্ডে এই নারী জঙ্গী মুসার এসব অপকীর্তির কথা অকপটে বলে দিয়েছে শিলা ও তৃষা দুজনই। জিজ্ঞাসাবাদে তৃষা মনি পুলিশকে বলেছে, মুসার প্ররোচনাতেই এক সময় জঙ্গীবাদে নিজেকে জড়াতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যখন বুঝলেন জঙ্গীপনা ভুলপথ তখন এই রাস্তা থেকে বের হতে অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মৃত্যুভয়ের কারণে কখনও আস্তানা থেকে বেরোতে পারেননি তিনি। আশকোনার আস্তানায় পুলিশের অভিযান তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথ করে দিয়েছে। পুলিশী অভিযানের সময় বাইরে থেকে ফোনে মুসা তাকে বার বার আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করেছে। কিন্তু সে আত্মহত্যার পথ বেছে না নিয়ে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তৃষা মনি জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, পুলিশ অভিযানের রাতে পূর্ব আশকোনার সূর্য ভিলার তিনতলা বাড়িতে জঙ্গী আস্তানার খোঁজে গেলে তৃষা মনি জানালা দিয়ে তাদের ইশারা করে কাছে ডাকে পুলিশ সদস্যদের। তারপর সে নিচুস্বরে বলে, তাদের বাসাটিই জঙ্গী আস্তানা। এখানে ৩ জঙ্গী পাশের রুমে আছে বলে জানায় সে। এরপর সারারাত মোট ৯টি চিরকুট পুলিশের কাছে দিয়েছে। এটা যে জঙ্গী আস্তানা, এই জঙ্গী আস্তানায় ক’জন জঙ্গী আছে, গোলাবারুদ কি পরিমাণ আছে তা চিরকুটের মাধ্যমে তৃষা মনিই পুলিশকে প্রথম জানায়। যেসব চিরকুট লেখে তার মধ্যে একটি চিরকুটে লেখে, ‘আমি মরতে চাই না। বাঁচতে চাই। আপনারা আমাকে বাঁচান।’ চিরকুটগুলো এখন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট হেফাজতে। অপরদিকে আত্মসমর্পণকারী আরেক নারী জঙ্গী নিহত জাহিদের স্ত্রী শিলাও চিরকুট লিখেছিল। তার একটি চিরকুট লিখেছিল তার মায়ের কাছে থাকা বড় মেয়ের উদ্দেশে। তাতে তিনি মেয়েকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন তার অবর্তমানে কীভাবে চলতে হবে, জীবনযাপন করতে হবে। চিরকুটে মেয়েকে বার বার ধর্মীয় নানা বিষয় মেনে চলারও পরামর্শ দিয়েছিলেন শিলা। মেয়েকে জঙ্গীবাদের দীক্ষাও দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মা জোহরার হ্যান্ডমাইকে আত্মসপর্মণ করার কথায় আত্মসমর্পণ করে শিলা। মোস্টওয়ান্টেড মুসা ॥ আশকোনার সূর্য ভিলা নামের জঙ্গী আস্তানায় রাতেরবেলায় এসে স্ত্রী তৃষা ও শিলার সঙ্গে রাত কাটাত জঙ্গী মুসা। কিন্তু যেই রাতে পুলিশ অভিযান চালায় সেই রাতে অজ্ঞাত কারণে মুসা আসেনি আশকোনার জঙ্গী আস্তানায়। নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা বাংলা ভাই নামে পরিচিত সিদ্দিকুল ইসলামের হাত ধরে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে এক যুগের বেশি সময় আগে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারে আসার পর ২০০৪ সালে পুরনো জেএমবি রাজশাহীর বাগমারা, নওগাঁর আত্রাই, রানীনগর ও নাটোরের নলডাঙ্গার বিস্তৃত অঞ্চলে ত্রাস ছড়িয়ে জঙ্গী নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করে। ওই সময়ের মাঈনুলই এখনকার মুসা যিনি তখন তাহেরপুর ডিগ্রী কলেজে একাদশ শ্রেণীর ছাত্র জেএমজেবির সঙ্গে জড়ায়। বাগমারা উপজেলার গণিপুর ইউনিয়নের বজ্রকোলা গ্রামের মসজিদের সদ্যপ্রয়াত মুয়াজ্জিন আবুল কালাম মোল্লার ছেলে মাঈনুল ইসলাম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে সিদ্দিকুল ইসলামের মতো আত্মগোপনে চলে যায় মাঈনুলও। আত্মগোপনে থেকে রাজশাহী কলেজে এসে ভর্তি হন তিনি। তারপর সেখান থেকে ঢাকা কলেজে পড়াশোনা করেন। চলতি বছরের শুরুতে উত্তরার একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। গত সেপ্টেম্বরে ঢাকার মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত নব্য জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলামের মেয়ে ওই স্কুলেই পড়ত।
×