ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এ্যাথলেটিক্স;###;রুমেল খান

শিরিন-লাবনীর ভিন্ন অভিজ্ঞতা

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬

শিরিন-লাবনীর ভিন্ন অভিজ্ঞতা

যবনিকাপাত হলো জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতার ৪০তম আসরের। এতে আলোচিত বিষয় ছিল চারটি। এই প্রতিযোগিতায় ৬৪ জেলা, ৮ বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা বোর্ড, বিকেএসপি ও সব বাহিনীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৬০০ পুরুষ ও মহিলা এ্যাথলেট অংশ নেয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত অংশ নেয় এর অর্ধেক প্রতিযোগী। প্রতিযোগীরা দুই গ্রুপে ৩৬ ইভেন্টে খেলেন (পুরুষদের ২২টি ও মহিলাদের ১৪টি ইভেন্ট)। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে- এগুলোর একটিতেও নতুন কোন জাতীয় রেকর্ড হয়নি! আরও বিস্মকর ব্যাপার হচ্ছে- অতীতে সার্ভিসেস দলগুলোর বাইরে অন্য দলগুলো পদক জিতলেও এবার অন্য দলগুলোর কেউই একটি পদকও জেতেনি (ন্যূনতম একটি তাম্রপদক নয়)! সবশেষ আলোচিত বিষয় ছিল প্রতিবারের মতো এবারও প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে সেই মান্ধাতা আমলের হ্যান্ড টাইমিংয়ে! জাতীয় এ্যাথলেটিক্স মানেই দেশের সেরা এ্যাথলেটদের পরীক্ষার মঞ্চ। অথচ সেই প্রতিযোগিতা মঞ্চে অবতীর্ণ হতে হয় হ্যান্ড টাইমিং পদ্ধতিতে! ২০১০ এসএ গেমসের সময় আনা ইলেক্ট্রনিক্স বোর্ডটি নষ্ট। হ্যান্ড টাইমিংয়ের কারণে এ্যাথলেটরা নিজেদের সঠিক টাইমিং ও অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন ধারণা পান না। কোন রেকর্ড গড়লেও হ্যান্ড টাইমিংয়ের কারণে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকে। তাছাড়া হ্যান্ড টাইমিংয়ের ফলে ‘ফটো ফিনিশ’ নিয়েও যথেষ্ট জটিলতার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলতে গেলে ঝামেলায় পড়তে হয় তাদের। অথচ ২০১২ সালের ‘জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা’ কিন্তু অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইলেক্ট্রনিক্স টাইমিংয়ে। যাহোক, হ্যান্ড টাইমিংয়ে খেলা হওয়ার পরও কোন রেকর্ড ছাড়াই শেষ হয়েছে জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা। এতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তারা ১৯ স্বর্ণ, ১৯ রৌপ্য ও ১৩টি তাম্রসহ মোট ৫১ পদক জিতে শ্রেষ্ঠত্ব দেখায়। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ১১ স্বর্ণ, ১১ রৌপ্য ও ৪ তাম্রসহ ২৬ পদক জিতে রানার্সআপ হয়। ২ স্বর্ণ, ২ রৌপ্য ও ২ তাম্রসহ ৬ পদক জিতে তৃতীয় হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। প্রতিযোগিতার দ্রুততম মানব নৌবাহিনীর মেজবাহ আহমেদ ও মানবী শিরিন আক্তারের হাতে ১০ হাজার টাকা প্রাইজমানি তুলে দেয়া হয়। পরে চ্যাম্পিয়ন সেনাবাহিনী ও রানার্সআপ নৌবাহিনীর হাতে দলীয় ট্রফি তুলে দেয়া হয়। দ্রুততম মানব-মানবীকে বিশেষ পুরস্কার প্রদানও ছিল সমালোচিত। কেননা এতে অন্য ইভেন্টের প্রতিযোগীদের অবমূল্যায়নের বিষয়টিই ফুটে ওঠে। এবারের প্রতিযোগিতায় দুজন নারী এ্যাথলেট বিশেষভাবে নজর কেড়েছেন। একজন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর স্প্রিন্টার শিরিন আক্তার। অন্যজন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) শট পুটার লাবনী আক্তার। একজন শিরোপা ধরে রাখতে সমর্থ হন। অন্যজন নিজ দলের হয়ে শেষবারের মতো জাতীয় প্রতিযোগিদায়অংশ নেন। তবে প্রত্যাশিত স্বর্ণপদক জেতেননি। লাভ করেন তাম্রপদক। তাদের দুজনকে নিয়েই আজকের এই ফিচার। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে অংশ নেয়া শিরিনের ওপর এবার স্বভাবতই যথেষ্ট চাপ ছিল ১০০ মিটার স্প্রিন্টের শিরোপা অক্ষুণœ রাখার ক্ষেত্রে। সেটা ভালমতোই পেরেছেন তিনি। তবে টাইমিংয়ের তেমন উন্নতি ঘটাতে পারেননি (১২.০১ সেকেন্ড)। এ আসরে এ নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো দ্রুততম মানবী হন শিরিন। গত আসরে তার টাইমিং ছিল ১২.২০ সেকেন্ড। ২০১৪ আসরে অংশ নিয়ে টাইমিং করেছিলেন ১১.৮৪ সেকেন্ড। এছাড়া অনুষ্ঠিত সামার জাতীয় এ্যাথলেটিক্সে স্বর্ণজয়ের সময় শিরিনের টাইমিং ছিল ১২.২৪ সেকেন্ড। সে হিসেবে সব ধরনের আসরে টানা চতুর্থবার জিতলেন দেশের দ্রুততম মানবীর খেতাব। শুক্রবার বিজয়ী হবার পর শিরিনের অনুভূতি ছিল এ রকম, ‘সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল এক্সাম চলছে। তাই ভালমতো অনুশীলন করতে পারিনি। পরীক্ষা দিয়ে সকালে চলে আসি। আগের তিনবারের চেয়ে অনেক বেশি ধকল পোহাতে হয়েছে। আমি বিকেএসপির সাবেক ছাত্রী। বিকেএসপির ডিজি স্যার এবং কোচ আবদুল্লাহ্-হেল-কাফিকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ এবং অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা তারা আমাকে অনুশীলন করার সুযোগ দিয়েছেন বলে।’ একই ইভেন্টে আগের দিন নৌবাহিনীর স্প্রিন্টার মেজবাহ আহমেদও স্বর্ণ জেতেন হ্যাটট্রিক বারের মতো। আগের দুবার না হলেও এবার স্বর্ণ জিততে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে মেজবাহকে। সে তুলনায় এবার শিরিনের স্বর্ণজয় ছিল অনেক আয়েশে। এসএ গেমসে মেয়েদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে বাংলাদেশের কেউ আজ পর্যন্ত সোনা জেতেননি। সেই অধরা স্বর্ণজয়ের ইঙ্গিত দিলেন ১৯৯৫ সালের ১২ অক্টোবরে পৃথিবীর আলো দেখা শিরিন। ২০০৬ সালের কথা। তখন ক্লাস সিক্সে পড়েন শিরিন। পড়াশোনায় তেমন আগ্রহ নেই। মন বসে না পড়ার টেবিলে। পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে না পারলেও স্কুলের খেলাগুলোতে ঠিকই সবসময় ফার্স্ট হতেন। শিরিনের প্রথম দৌড় ৬০ মিটার দিয়ে। শুরুটাই হয় প্রথম হয়ে। জাতীয় পর্যায়ে খেলার আগে জুনিয়র মিটে অংশ নিয়ে সেখানেও (২০০৯-২০১২ সাল পর্যন্ত) সাফল্য পেয়েছেন শিরিন। খেলেছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। ২০০৯ সালে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত ইয়ুথ গেমসে ১০০ মিটারে ষোড়শ ও ২০১৩ সালে সাব জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের পুনেতে ১০০ মিটারে (টাইমিং ১২.৭০ সেকেন্ড) ও রাঁচিতে ১০০ মিটারে (টাইমিং ১২.৫৯ সেকেন্ড) অংশ নিয়ে কোন পদক না পেলেও ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে দলগতভাবে তৃতীয় হন। ২০১৩ বাংলাদেশ গেমসে নাজমুন নাহার বিউটিকে ২০০ মিটারে হারিয়েছিলেন (ওই আসরে ১০০ মিটারে ফটোফিনিশে দ্বিতীয় হন শিরিন, প্রথম হন বিউটি)। পরিবারের সবাই আদর করে ডাকে ‘লাবু’। ভাল নাম শারমিন নাহার লাবনী। কিন্তু পাসপোর্টে নাম লেখার সময় সেটা পাকে-চক্রে কিভাবে যেন লাবনী আক্তার হয়ে গেল! শনিবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় মেয়েদের শট পুটে তা¤্রপদক জেতেন লাবনী। নামের মতো চেহারাটাও বেশ লাবণ্যময়ী এই অষ্টাদশী সুর্দশনার। বিকেএসপির শট পুটার। গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের জামিরবাড়িতে। তবে বাবার কর্মস্থলের সুবাদে জন্ম হয়েছে যশোরের কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে। বাবা ফারুক হোসেন ছিলেন সেনাবাহিনীর কর্পোরাল (অবসর নেয়ার পর এখন ব্যবসা করছেন)। মা মিনা পারভীন, গৃহিণী। ২ বোন, ১ ভাই লাবনীরা। লাবনী মেজো। ২০১৩ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হন লাবনী। উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন মানবিক বিষয় নিয়ে। এত খেলা থাকতে শটপুটে কেন? ‘লাবনী মূলত ছিলেন ক্রিকেটার। টপ অর্ডারে ভাল ব্যাটিং করতেন। স্বুল বিভাগীয় পর্যায়েও খেলেছেন। ২০১২ সালে লালমনিরহাটের হয়ে খেলে রানার্সআপ হন। স্থানীয় কিশোরী ক্লাবেও খেলেছেন। এছাড়া স্কুলে পড়ার সময় (লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের করিমউদ্দিন পাবলিক পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়) ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্ট, হাই জাম্প, লং জাম্প, জ্যাভলিন থ্রো এবং সাইক্লিংও খেলেছেন। এগুলো খেলে ২৫টিরও বেশি পদক জিতেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছেÑ স্কুলে পড়তে কখনই শট পুট খেলেননি তিনি!। শট পুট বেছে নেন বিকেএসপিতে ভর্তি হয়ে। জেএসসি পরীক্ষার পর লালমনিরহাটে একটি ট্রায়াল হয় বিকেএসপিতে এ্যাথলেট ভর্তি করার জন্য। ভর্তি হবার পর একদিন অনুশীলনে শট পুটে লাবনীর দক্ষতা দেখে কর্তৃপক্ষই তাকে শট পুট খেলাটি বেছে নিতে বলেন। এতে লাবনীরও আগ্রহ ছিল। বিকেএসপিতে যে বছর ভর্তি হন, সে বছরই জাতীয় জুনিয়র এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় অংশ নেন লাবনী। শট পুটে তিনি অভিষেকেই জেতেন রৌপ্যপদক। এছাড়া অধরা স্বর্ণপদকও জেতেন লাবনী। সেটা এ বছরই অনুষ্ঠিত সামার জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় জুনিয়র বিভাগে রেকর্ড স্কোর গড়ে। সদ্যসমাপ্ত জাতীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় অবশ্য তাম্রপদক জিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে লাবনীকে। এর ব্যাখ্যাও আছে তার কাছে। কোমরে চোট থাকায় এবং মাত্র দেড় মাস অনুশীলনের কারণে ভাল পারফর্ম করতে পারেননি। তাছাড়া শেষের দিকে একটু নার্ভাসও হয়ে পড়েন। সবচেয়ে বড় কথা, বিকেএসপির হয়ে এটাই ছিল তার শেষ বারের মতো জাতীয় পর্যায়ে খেলা। কারণ এইচএসসি পাশের পর স্বাভাবিকভাবেই তাকে বিকেএসপি ছেড়ে যেতে হবে। বিদায়বেলায় স্বর্ণ জিততে পারলে খুশি হতেন লাবনী। রৌপ্য জিতলেও হতো। ব্রোঞ্জ আশা করেননি। কিন্তু অদৃষ্টে যে লেখা ছিল ব্রোঞ্জই জিতবেন! শটপুট নিয়ে ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নিয়ে অন্যদের চেয়ে বেশ ব্যতিক্রমই মনে হয়েছে লাবনীকে। কারণ ‘পড়াশোনা করে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী বলে আপাতত খেলাধুলা আর করবেন না তিনি! তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি সময়-সুযোগ পেলে আবার খেলাতে ফিরে আসতেও পারেন।
×