ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শীতে এসেছে পরিযায়ী পাখি

আকাশজুড়ে দারুণ ওড়াউড়ি, অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্য

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬

আকাশজুড়ে দারুণ ওড়াউড়ি, অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্য

মোরসালিন মিজান ॥ শীত এসেছে। এসেছে যে, নানাভাবে বোঝা যায়। তবে পরিযায়ী পাখিদের কথা আলাদা করে বলতে হয়। এরই মাঝে দূর-দূরান্তের দেশ থেকে আসতে শুরু করেছে বিভিন্ন জাতের পাখি। এদের ওড়াওড়ি শীতের কালটিকে বিশেষভাবে দৃশ্যমান করছে। সারা দেশেই কমবেশি পাখি দেখা যায়। দেখা যাচ্ছে। তবে কিছু অঞ্চলে পরিযায়ী পাখিদের যেন মিলনমেলা! মুক্ত বিহঙ্গ ডানা মেলে উড়ছে। অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্য। দেখে মন ভরে যায়। মন পাখি তুই থাকরে খাঁচায় বন্দী...। শিল্পীর এই আহ্বান না, পাখিরা শুনে না। খাবার ও বেঁচে থাকার অনুকূল পরিবেশ খুঁজে এই দেশ ওই দেশ ঘুরে বেড়ায়। ঘুরে বেড়ানোর অংশ হিসেবে শীতে আসে বাংলাদেশে। শীতকালে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বলে অনেকেই এদের শীতের পাখি বলে জানেন। শীত শেষে চলে যায় বলে অতিথি পাখি বলেও চিহ্নিত করা হয়। আসলে পরিযায়ী পাখি। পাখি নিয়ে যারা কাজ করেন তারা ‘পরিযায়ী’ শব্দটি ব্যবহার করেন। পাখিপ্রেমী ও বিশিষ্ট গবেষক ইনাম আল হকের মতে, কোন পাখি যে দেশে নিয়মিতভাবে বসবাস করে, সেটি সেই দেশের পাখি বলে গণ্য হয়। একটি পাখি একইসঙ্গে একাধিক দেশের হতে পারে। বাংলাদেশের আছে ৬৫৩ প্রজাতির পাখি। এগুলোর মধ্যে ৩০০ প্রজাতির পাখি এই দেশে সারা বছর থাকে না। গ্রীষ্মে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলে যায়। শীতে ফিরে আসে। এদের তাই অতিথি বলা যাবে না। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, শীতে বাংলাদেশে আসে ২৫ জাতের হাঁস। তার পর ৫ থেকে ৬ মাস থাকে। এদের তাই অতিথি বলা যায় না। আমাদের পাখি। বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখিদের সবচেয়ে বড় ঠিকানা সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়। দুই উপজেলা তাহিরপুর ও ধর্মপাশার উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে বিস্তৃত হয়েছে এই হাওড়। পুরো হাওড় এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ২,৮০,২৩৬ হেক্টর জলাভূমি। জল ও স্থল উভয় অংশেই এখন পাখি আর পাখি। পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লেউচ্ছামারা ও বেরবেড়িয়ার বিলের। অন্য বিলগুলোতেও প্রচুর পাখি উড়ছে। জানা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওড়ে প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখির বাস। আর শীতে প্রতি বছর ২০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসে। খুব চোখে পড়ছে পানকৌরি। বড় পানকৌরি। ছোট পানকৌরি। আছে ছোট ডুবুরি। বড় খোপা ডুবুরি। বকের মধ্যে আছে বড় বক, ছোট বক, ধুপনি বক, বেগুনি বক। হাঁসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মেটে রাজহাঁস, চখাচখি, লেনজা হাঁস, খুনতে হাঁস, পাটারি হাঁস, ফুলুরি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, সিঁথি হাঁস, পাতি হাঁস, বালি হাঁস, লাল ঝুটি ভুতি হাঁস ও পাতি ভুতিহাঁস। আছে ছোট সরালি, বড় সরালি। পান্তা ঝিলি, মেটেবুক ঝিলি। জল মোরগ, লালবুক গুরগুরি, নেউ পিপি, কায়েম, দলপিপি, কুট, লাল ঢেঙ্গা, মেটেমাথা টিটি, কুরা, বড় চিত্রা ইত্যাদিও দারুণ উৎসবে মেতেছে। রাজধানী ঢাকার আশপাশের এলাকায়ও দেখা যাচ্ছে পরিযায়ী পাখি। খুব কাছে মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় এখন দলবেঁধে উড়ছে বিভিন্ন নামের পাখি। মিরপুর মাজার রোড ধরে হেঁটে এগুলেই হলো। বেড়িবাঁধে পৌঁছে যাওয়া যায়। এখান থেকে বাঁদিকে তাকালে নিচু জমি। জলাশয়। আর ওপরে তাকালে কেবল পাখি। মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে। একটু দূরে হওয়ায় পাখির নাম ধাম চট করে অনুমান করা যায় না। ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ হয়। খুব কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় বিচিত্র কিচির-মিচির কানে আসে। এ যেন স্বাগত সঙ্গীত! বেড়িবাঁধ থেকে উত্তরার দিকে যাওয়ার পুরোটা রাস্তা সঙ্গীত শুনতে শুনতে অতিক্রম করা যায়। সকাল ও সন্ধ্যায় পাখিদের উপস্থিতি বেশি চোখে পড়ে। বহু জাতের পাখি এখানে। সংখ্যায় এগিয়ে সরালি। হাঁসের মতো দেখতে। জলমগ্ন ধানক্ষেত ও জলাশয়ের আশপাশে দলবদ্ধ হয়ে বিচরণ করে। সতর্ক পায়ে হাঁটে। উড়তে পারে প্রচুর। তখন আর বড় মনে হয় না। যেন আর সব পাখির মতোই। ছোট। পানকৌড়ির দল উড়াল দিলে আকাশের নীল কিছুটা যেন ঢেকে যায়। ডানার কালো রঙে নতুন ছবি এঁকে দেয় ছোট্ট পাখি। জলেও লম্বা সময় ডুব দিয়ে থাকতে পারে পানকৌড়ি। দুর্দান্ত সাঁতারু পাখি। যখন দৃশ্যমান হয় ঠোঁটে ধরা থাকে মাছ। সঙ্গত কারণেই ডানায় পানি জমে থাকে। পানি শুকোতে সূর্যের উল্টো দিকে ডানা মেলে বসে থাকতেও দেখা যায়। দৃশ্যটা সত্যি উপভোগ্য। আর বকের কথা তো না বললেই নয়, এ তো দেখা। তবু সুন্দর। তবু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। নীল আকাশে দলবেঁধে ওড়ার সময় মনে হয় শিল্পী হাসেম খানের আঁকা কোন বিখ্যাত চিত্রকর্ম! কখনও এরা নিচু জমির সীমানা নির্ধারণকারী পিলারের ওপরে বসে থাকে। কখনও শুকনো মরা বাঁশ বা কঞ্চির ওপর বসে নিচের জলের দিকে তীক্ষè দৃষ্টি দেয়। হ্যাঁ, এই তপস্যা মাছ শিকারের জন্য। দেখে সেই ছড়ার কথা মনে পড়ে যায়- পুঁটি মাছ পাই না/ একটা যদি পাই/ অমনি ধরে গাপ্পুস গুপ্পুস খাই। ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পরিযায়ী পাখিদের কথা সবার জানা।
×