ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নানিয়ারচরের সম্মুখযুদ্ধের বর্ণনা দিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী

মেশিনগানের গুলিতে পাক সেনাদের লাশ পড়ল একটার পর একটা

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬

মেশিনগানের গুলিতে পাক সেনাদের লাশ পড়ল একটার পর একটা

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ‘সময় তখন এপ্রিলের মাঝামাঝি। খুব সম্ভবত ২০ এপ্রিল। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের নানিয়ারচরের বুড়িঘাট নামক স্থানে অবস্থান নেই। এখানে আমরা ইপিআর’র ৪০ থেকে ৫০ জন সহযোদ্ধা ছিলাম। যার মধ্যে মুন্সী আব্দুর রউফ, শহীদুল ইসলাম ও আমি। অফিসার ইনচার্জের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান। ঠিক যে জায়গায় অবস্থান নেই সেখানে পাশাপাশি ২টি টিলা। এগুলো লম্বায় ৭০ থেকে ৭৫ ফিট, প্রস্থে ১৫ থেকে ২০। টিলার ওপরে ছিল ছোট ছোট গাছ। সেখানে তৈরি করি লতা-পাতার ছাউনি। আর ছাউনির নিচে সেট করি মেশিনগান। চোখের সামনে রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি জলপথের টলমলে পানি। চারদিক শান্ত। হঠাৎ দেখতে পাই খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে পাকবাহিনীর কয়েকটি লঞ্চ ও স্পীডবোট। লঞ্চগুলো আমাদের সামনাসামনি আসার পর আমরা তিনজন মেশিনগান থেকে একযোগে ফায়ার শুরু করি। প্রথম পর্যায়ে আমরা খুব দ্রুত ফায়ার করি। আব্দুর রউফ স্পীডবোট লক্ষ্য করে মেশিনগান থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকলেন। একের পর এক গুলিতে মারা যেতে লাগল পাকবাহিনী। কলাগাছ কাটার মতো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে লাগলো লাশ। ডুবে যেতে লাগল স্পীডবোট। এতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাকসেনারা। তারা চিন্তাও করেনি আমাদের পক্ষ থেকে এমন আক্রমণ হতে পারে।’- মহান বিজয়ের মাসে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়ার স্মৃতি জনকণ্ঠের কাছে এভাবেই তুলে ধরছিলেন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী। তিনি এই জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার নিমাদল গ্রামের বাসিন্দা। বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সহযোদ্ধা তিনি, তাই তার কণ্ঠে ওঠে আসে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকা রউফের বীরত্বগাথা। যুদ্ধপূর্ববর্তী সময়ে তারা ইপিআর-এর ১১ নং উইং চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। মোহাম্মদ আলীর কণ্ঠে ওঠে আসে পার্বত্য চট্টগ্রামের নানিয়ারচরের এই সম্মুখযুদ্ধের বিস্তর বর্ণনা। একান্ত আলাপনে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘এক পর্যায়ে আমাদের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পাকবাহিনী। লঞ্চ থেকেও ছিটকে পড়তে থাকে পাক সেনাদের লাশ। এক পর্যায়ে তাদের পক্ষ থেকে আর কোন গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ পাকবাহিনীর পেছন থেকে একটা স্পীডবোট দ্রুত গতিতে এগিয়ে এসে মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। মর্টার শেলের আঘাতে জঙ্গল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের সহযোদ্ধাদের কয়েকজন পেছনে ফিরে আসে। মুন্সী আব্দুর রউফ, শহীদুল ইসলাম ও আমি তখনও মেশিনগান দিয়ে অবিরাম গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। অন্য কোথাও থেকে আর গুলি না হওয়ায় শত্রু পক্ষ সহজেই আমাদের অবস্থান চিহ্নিত করে ফেলে। তখন তারা মর্টার শেল ব্যবহার করে। আমাদের অবস্থানের খুব কাছে দুই তিনটি বোম পড়ার পর মুন্সী আব্দুর রউফ মেশিনগানের লক খোলার চেষ্টা করেন। চেষ্টারত অবস্থায় তার ডানপাশের বুকের ছাতির ঠিক ওপরে মর্টার শেল আঘাত করে। তিনি মাটি থেকে আড়াই ফিট ওপরের দিকে ছিটকে পড়েন। মাটিতে পড়ার পর বলেন, ‘পানি’। পানি তো হাত দিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। লুঙ্গি ভিজিয়ে যখন পানি দিতে যাব তখন দেখি লঞ্চ একদম কাছে চলে এসেছে। অবস্থা এতটাই বেগতিক ছিল ফিরে আসা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।’ মোহাম্মদ আলীর ভাষ্য- ‘তখন আর আমাদের পেছনে ফিরে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। পানিতে নেমেই ডুব দিই। সাঁতরিয়ে নদী পার হওয়া চেষ্টা করছি। তখনও গুলি চলছে। উঁচু টিলা ক্রস করছি- তখনও চলছে গুলি। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। শেষরাতের দিকে নৌকায় করে মহলাছড়ি পৌঁছাই।’ তিনি বলেন, ‘পরের দিন শুনতে পাই এখানে ২৫০ থেকে ৩০০ পাক সেনা মারা যায়। এটা একটি পাকবাহিনীর কমান্ডো ছিল, যাদের অর্ধেকই মারা গিয়েছিল।’ তিনি একটানে বলে গেলেন। ‘মহালছড়ির দায়িত্বে ছিলেন মেজর সৈকত। আমরা যাওয়ার পর অন্য একটি বাহিনীকে বুড়িরঘাট এলাকায় পাঠানো হয়। তারা তল্লাশি করে শুধু মুন্সী আব্দুর রউফের একটি জামা পায়। জামাতে ছিল অগণিত গুলির আঘাত। তিনি যে বীরত্বপূর্ণ কাজটি করেন তা আমরা মেজর সৈকতকে বলি। তার সাহসিকতার কথাগুলো মেজর সৈকতের কাছে লেখানো হয়। তিনি তা লিখে রাখেন।’ এই যুদ্ধটা ঠিক কোন সময় হয় এমন প্রশ্নে তিনি জানান- ‘ঠিক দুপুরের দিকে। অনুমানিক দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে। রউফ শহীদ হন যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে। তবে যুদ্ধ চলে ঠিক সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। অর্থাৎ ওদের পক্ষ থেকে তখন পর্যন্ত গুলি চলছিল।’ ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর- এর ১৫০ জন সৈনিককে দায়িত্ব দেয়া হয় রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি নৌপথে নিরাপত্তাব্যুহ তৈরির করার। নির্জন পরিবেশের জলপথ দিয়ে পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলে প্রতিরোধ সৃষ্টিই তাদের দায়িত্ব। সে অনুযায়ীই লক্ষ্য নির্ধারিত। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কোম্পানিটি বুড়িঘাট এলাকার চিংড়িখালের দুইপাড়ে অবস্থান নেয়। এই দলে মুন্সী আব্দুর রউফ ছিলেন মাঝারি মেশিনগান ডিপার্টমেন্টের ১ নং মেশিনগান চালক। ইতিহাস বলছে, বুড়িরঘাটে এই যুদ্ধ হয়েছে ৮ এপ্রিল। তাতে রউফের অসীম সাহসিকতা ও নিজের জীবন উৎসর্গ করায় বাদবাকি ১৫০ সহযোদ্ধার জীবন রক্ষা পায়। তবে ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে লক্ষ্য করা গেছে ইতিহাসে রয়েছে তারখিগত বিচ্যুতি । বুড়িরঘাটে যে যুদ্ধটি হয় সব জায়গায় তা ৮ এপ্রিলের কথা বলা হলেও মুন্সী আব্দুর রউফের মৃত্যুর তারিখ হিসেবে অধিকাংশ স্থানে ১৮ এপ্রিল কিংবা ২০ এপ্রিলের কথা উল্লেখ রয়েছে; তবে ইতিহাস বলছে- বুড়িরঘাটের ওই যুদ্ধের দিনই শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট)। আর মোহাম্মদ আলী প্রথম কথোপকথনে এই যুদ্ধের তারিখ ২০ এপ্রিল উল্লেখ করলেও পরবর্তী একাধিক প্রশ্নের উত্তরে জানান- সময়টি এপ্রিলের মাঝামাঝি। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘তখন ইপিআর বাহিনীর ১১নং উইং চট্টগ্রামে কাজ করতাম। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্বে চট্টগ্রামে বিহারি এবং বাঙালীদের মধ্যে মারামারি চলছিল। আমরা অনুমান করলাম পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে। ক্যাম্পে কর্মরত ছিলাম। এখানে অবাঙালী ছিল ৭ থেকে ৮ জন। রেডিওতে ১০ তারিখ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার হয়। আমাদের বেশকিছু করার দরকার হবে। ইনচার্জ সুবেদার আজিজুল হক- তিনি আমাদের সতর্ক করে দিলেন, বিপর্যয় আসতে পারে। ইপিআর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর রফিকুল ইসলাম সাহেব। উনার নির্দেশ ছিল বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটলে অবাঙালীদের মেরে চট্টগ্রাম চলে আসবে। চট্টগ্রাম আসার পর আমরা চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ৩ দিন অবস্থান করি। চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্টের পাশে আমরা প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থায় ছিলাম। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে যখন স্বাধীনতার ঘোষণা হয় ওই বেতার বার্তা আমরা শুনতে পাই। তার দুইদিন পরে কালুরঘাট চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই এলাকায় বেশ কিছুদিন অবস্থান নিয়ে থাকি। এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর চাপ প্রবল হওয়ার কারণে কর্ণফুলী নদীর এক পাশে আমরা অবস্থান নিই। অন্য পাশে পাকবাহিনী। এখানে ছোট খাটো যুদ্ধ হয়। পাক বাহিনী বেশি থাকায় এক পর্যায়ে আমার এখান থেকেও সরে যেতে বাধ্য হই। তখন আমরা বান্দরবন হয়ে কাপ্তাই যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। লঞ্চযোগে কাপ্তাইয়ে মহালছড়ি পৌঁছাই। পুনরায় সংগঠিত হয়ে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হই। আমাদের ওপর বুড়িঘাট এলাকায় দায়িত্ব পড়ে। বুড়িরঘাট এলাকার নানিয়ারচর এলাকায় অবস্থান নেই। এখানে ইপিআরের ৪০ থেকে ৫০ জন ছিল। এখানেই শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ। পাক বাহিনী মারা যায় অন্তত ২৫০ থেকে ৩০০। এটা অবশ্য আমরা নিজেরা দেখিনি। অন্য সহযোদ্ধারা জানিয়েছিলেন। এই যুদ্ধ শেষে মহালছড়ি পৌঁছায়।’ তিনি বলেন, ‘এরপরে মহালছড়ি থেকে রামগড়ের দিকে চলে যাই। রাগমড়ে ৫ থেকে ৭ দিন অবস্থান করি। এখানে আমাদের অবস্থানের সময় পাকবাহিনী রামগড়ে আক্রমণ করে। যখন রামগড় ওদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, আমাদের উপর আদেশ হয় রামগড় বাজার পুড়িয়ে দেয়ার। রাতের অন্ধকারে ফেনী নদী পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিই। ভারতে যাওয়ার পর হরিণগঞ্জ নামক স্থানে সেক্টর ওয়ান গঠিত হয়। কয়েকটি সাব সেক্টরে ভাগ করা হয়। আমি ছিলাম সাব সেক্টর ২ তে। হেডকোয়ার্টার ছিল টংবাড়ি। আমাদের দায়িত্ব ছিল শুভপুর ব্রিজ থেকে ফেনী এলাকা পর্যন্ত পাকবাহিনীকে নাস্তানুবাদ করা। ২ মাস থাকার পর আমাদের একটি গ্রুপকে বেলুনিয়া এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। বেলুনিয়া এলাকায় ১০ থেকে ১৫ দিন যুদ্ধ চলার পর পুনরায় আমাদের ফিরিয়ে আনা হয়। ছোটখাটো অপারেশন অনেক হয়েছে। তারিখ বলতে পারব না।’ তিনি বলেন, ‘বেলুনিয়া ভারতের ভেতরের পকেট। সিপাহী শহীদ, হাবিলদার শফিক ও আমি- এই তিনজন মেশিনগান নিয়ে যাই। এটা নবেম্বরের দিকে। পাকবাহিনীর ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি করে ইন্ডিয়ান আর্টিলারি। প্রচ- বোমাবর্ষণে পাকবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। আমরা বেলুনিয়া থেকে ফিরে ফেনী শহরে আক্রমণ করি। ফেনীতে বড় ধরনের যুদ্ধ হয়নি। হালকা যুদ্ধে পাকবাহিনী পালায়ন করে। ফেনী থেকে মহাসড়ক হয়ে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হই। আনোয়ার জুট মিল নামক স্থানে অবস্থান নেই। সেখান থেকে ফৌজদারহাট এলাকায় আক্রমণ করা হয়। মিত্র বাহিনীর সম্মিলনে। এটা সম্ভবত ডিসেম্বরের ১০ থেকে ১১ তারিখ। ফৌজদারহাট আক্রমণ করার পর আমাদের আর যুদ্ধ করতে হয়নি। পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করছিল। এর মধ্যেই বিজয়ের ঘোষণা আসে। আর সবার মতো মেতে উঠি বিজয়ের উল্লাসে।’ স্বাধীনতার এত বছর পর ঠিক কেমন আছেন, এমন প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী (মুক্তি বার্তা নং-০৫০১০৩০২৬৯, গেজেট নং- ২৯৯৬ ও সনদ নং-ম-১৩৬৯০৬) বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ভাল আছি। সব মিলিয়ে বেশ ভালই আছি। দেশ স্বাধীন না হলে হয়ত এ দেশেও থাকতে পারতাম না।’ কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে পট পরিবর্তনের পর আমাদের খোঁজ আর কেউ রাখেনি। কেউ আমাদের কথাটি জিজ্ঞাসও করেনি। বর্তমানে সব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি।’
×