ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা মাদক বেচাকেনা তবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬

অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা মাদক বেচাকেনা তবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন

মশিউর রহমান ॥ অসংখ্য নতুন পুরাতন সমস্যা ও নতুন নতুন উন্নয়ন কর্মকা- আর সম্ভাবনা নিয়ে বাস করছেন রাজধানীর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ১ নং ওয়ার্ড খিলগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা। রাজধানী তথা দেশের প্রথম পরিকল্পিত পূর্ণাঙ্গ আবাসিক ও পরিচ্ছন্ন আবাসিক এলাকা খিলগাঁও। বিশাল আকারের প্রশস্ত প্রধান রাস্তা ও গলিতেও রাস্তার আয়তনের পাশাপাশি সুন্দর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তাই প্রমাণ করে। নতুন সৃষ্ট অনেক সমস্যার সমাধান হলেও প্রতিনিয়তই সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগের মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধানও করা হচ্ছে। স্থানীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, ঘরোয়া বিচার বৈঠক বসিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান মিলছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার থানা পুলিশের পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থার কার্যক্রমও শক্তিশালী বলে জানা গেছে। নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা থাকলেও জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত ওয়ার্ড কমিশনার ওয়াহিদুল হাসান মিল্টনের মতে, অন্য যে কোন সময়ের চেয়েও ডিএসসিসির যে কোন ওয়ার্ডের তুলনায় এই এক নং ওয়ার্ডটি বর্তমানে অনেক ভাল অবস্থানে রয়েছে। ছিনতাই ও মাদক সেবন বন্ধে সব সড়কে এলইডি বাতি ও নাগরিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে বিভিন্ন স্থানে মোট ১৬৬টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিকে) বসানো এবং তা দিয়ে এক নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা ও একটি আধুনিক কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণসহ সকল সরকারী সেবামূলক অফিস এক জায়গায় করতে নতুন ২০ তলা ভবন নির্মাণের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এটি তৈরি হলে এ ওয়ার্ডের বর্তমান চেহারাই পাল্টে যাবে। তার মতে, নির্দিষ্ট কিছু সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে এ ওয়ার্ডের স্বাভাবিক ছোট ছোট সমস্যার বাইরে আর কোন সমস্যাই থাকবে না। প্রায় তিন লাখ জনসংখ্যার এ খিলগাঁও আবাসিক এলাকার ‘এ ব্লকের’ তারাবাগ, প্রভাতিবাগ, ঝিলপাড়, ইমামবাগ, তিলপাপাড়া, সি ব্লক উত্তর ও দক্ষিণ অংশ, জোড়াপুকুর খেলার মাঠ, আনসার ক্যাম্প রোড, নাদের স্মৃতি সংসদ রোড, খিলগাঁও রোড, গোড়ান রোড, সিপাহীবাগ রোড, নিউ কলোনিসহ আরও কয়েকটি ছোট ছোট এলাকা নিয়ে এ ওয়ার্ডটি গঠিত। ওয়ার্ডটির মোট ভোটার সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। সরেজমিনে নাগরিকদের কাছ থেকে বিভিন্ন সমস্যার কথা জানা গেছে, এর মধ্যে পয়োনিষ্কাশন সমস্যা, বৃষ্টি হলেই নির্দিষ্ট কিছু এলাকার রাস্তায় হাঁটু পানি উঠা, কোন কমিউনিটি সেন্টার না থাকা, চুরি ছিনতাই হওয়া, নির্দিষ্ট সময়ে এ আবাসিক এলাকায় ট্রাফিক জ্যাম থাকা, বড় রাস্তার ধারে দিনের বেলায় ও সন্ধ্যার পর প্রকাশ্যে মাদক সেবন ও বিক্রি করা, বহিরাগতদের অবাধ আনাগোনা, প্রধান সড়কের পাশের বাড়িগুলোতে অবৈধভাবে নিয়ম ভঙ্গ করে ফাস্টফুড দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলা, এসব সড়কে তীব্র যানজট থাকার কথা জানা গেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, খিলগাঁও আবাসিক এলাকার পয়োনিষ্কাশন সংযোগটি প্রায় ১০ বছর ধরে বন্ধ হয়ে রয়েছে। কিন্তু এলাকাবাসী ও কমিশনারের পক্ষ থেকে বার বার দাবি জানিয়ে আসলেও তার তেমন কোন সুরাহা হচ্ছে না। এমনকি তা সংস্কারের কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। পাকিস্তান আমলে এই এলাকায় পয়োনিষ্কাশন লাইন নির্মাণ করলেও আজ পর্যন্ত এটির সংরক্ষণ বা সংস্কার করেনি ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। অথচ তারা এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে সঠিক সময়েই সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়মিত ধার্যকৃত পরিমাণ অর্থ নিচ্ছেন। এর ফলে বর্তমানে পয়োবর্জ্য অপসারণে সড়কের সিটি কর্পোরেশনের দুই পাশে নালাই প্রধান ভরসা। এ নালায় সমস্ত এলাকার পয়োবর্জ্য সরাসরি এসে পড়ে। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই এলাকাবাসী কষ্টের সঙ্গে দুর্গন্ধ সহ্য করেই বসবাস করতে হচ্ছে। তবে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পয়োবর্জ্য লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতে এসব নালার উপর স্থায়ীভাবে ঢালাই দিয়ে নালার মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর ফলে অনেক স্থানে প্রয়োজন সত্ত্বেও ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কারের কোন কাজ করা সম্ভব হয় না। যার প্রভাব সাধারণ নাগরিকদের ওপর পড়ে। এছাড়া নালাগুলোর পয়োবর্জ্যরে কারণে অনেকটা বন্ধ থাকায় প্রায় প্রতিদিন দুপুরে নালায় পানির চাপ বাড়লেই সকল সড়কেই পয়োবর্জ্যে সয়লাব হয়ে যায়। এর ফলে পুরো মহল্লার পরিবেশ নষ্ট হয়ে পড়ে। সি ব্লকের আবুল কাশেম নামের এক বাড়িওয়ালা জনকণ্ঠকে জানান, সামান্য বৃষ্টি হলেই পুরো সি ব্লকের উত্তর ও দক্ষিণ এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এছাড়া ‘এ ব্লকের’ ১৯, ২০,২১ ও ২২ নম্বর সড়কেও সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ফলে এলাকার সকল বাসা থেকে বের হওয়ায় কঠিন হয়ে পড়ে। এর মধ্যে পুরাতন বাড়িগুলোর অবস্থা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। অনুমতি না থাকলেও খিলগাঁও এলাকায় অবৈধভাবে অনেক স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, রেস্টুরেন্টসহ বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সবগুলোই আবাসিক বাড়িগুলোর নিচে ও কোন কোন স্থানে পুরো বাড়িতেই বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এলাকার শহীদ বাকি রোডে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এসব অবৈধ ও অপরিকল্পিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কারণে বহিরাগতরা এসে ভিড় করায় এলাকায় প্রবেশে ও বের হতে গেলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও কোন প্রকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না। নানা সমস্যার মাঝেও বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে, নতুন মেয়র ও কমিশনার নির্বাচিত হওয়ার পর নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে এই এলাকার প্রতিটি সড়কে এলইডি বাতি ও ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে। রাজধানীতে এটিই প্রথম কোন আবাসিক এলাকা ও ওয়ার্ড যেখানে এলইডি বাতি ও ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। এর ফলে বর্তমানে আগের তুলনায় চুরি ডাকাতি ছিনতাই, মাদক সেবন অনেকটা কমে এসেছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া প্রধান সড়কসহ ভাঙ্গা প্রায় সকল রাস্তাই সংস্কার করা হয়েছে। তবে কিছু সড়কের কাজ চলমান রয়েছে। নাগরিকদের দাবি উক্ত এলাকায় সরকারী একটি আধুনিক কমিউনিটি সেন্টার প্রয়োজন। ডিএসসিসির এ ওয়ার্ডে কিন্ডারগার্টেন, স্কুল-কলেজসহ ৩০টির অধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া দুটি খেলার মাঠ রয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, মূল সড়কের কোথাও কোন ময়লা-আবর্জনা চোখে পড়ে না। মূল সড়ক ৭০ থেকে ৮০ ফুট আর অলি গলির সড়কগুলো ২৫ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত। যা ডিএসসিসির কোন এলাকায়ই চোখে পড়ে না। ওয়ার্ডের প্রধান সড়ক হিসেবে পরিচিত শহীদ বাকি সড়কের দুই পাশে রয়েছে সুন্দর চওড়া ফুটপাথ। তবে শহীদ বাকি রোডসহ পুরো খিলগাঁও এলাকায় প্রায় দুই শতাধিক রেস্তরাঁ, চা-কফির দোকান, খাবার দোকান দেখা গেছে। এছাড়া খিলগাঁও মডেল কলেজের সামনের সড়কে ও ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজের সামনে যানজট সবসময়ই লেগেই থাকে। সি ব্লকের কয়েকটি ড্রেনের পয়োবর্জ্য মূল সড়কে ছড়িয়ে পড়েছে। আনসার ক্যাম্প এলাকায় এক সময় সন্ধ্যার পরই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও বর্তমানে সিসি ক্যামেরা ও এলইডি বাতি লাগানোর কারণে তা অনেকটা কমে এসেছে। আনসার ক্যাম্প এলাকার বাসিন্দা কামাল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, এলাকার প্রধান সড়কের পাশে দামী দামী খাবারের রেস্টুরেন্ট ও সুস্বাদু ফাস্ট ফুডের দোকান গড়ে উঠেছে। এর ফলে বহিরাগতরাও এখানে খাবার খেতে আসেন। তবে অনেক তরুণ তরুণীকে এসব স্থানে বসে মাদক সেবন করতেও দেখা যায়। বিশেষ করে মাদক হিসেবে ইয়াবা সেবন ও বিক্রি করতে দেখা যায়। এ বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এছাড়া এলাকায় মশার উৎপাত বন্ধে মাঝে মধ্যে মশার ওষুধ ছিটানো হয় কিন্তু তেমন একটা কাজ করে না। তাই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। ওয়ার্ডের সার্বিক বিষয়ে বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ওয়াহিদুল হাসান মিল্টন জনকণ্ঠকে বলেন, পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা খিলগাঁওয়ের অলিগলিসহ সকল সড়ক পরিষ্কার রাখতে প্রায় ৭৫ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। যারা নিয়মিত তাদের কাজ করে যাচ্ছেন এজন্য রাস্তার ওপর কোন প্রকার আবর্জনা কারও চোখে পড়বে না। এছাড়া সমস্ত এলাকার মশা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হয়। তবে কোন কোন স্থানে এসব ওষুধেও তেমন কাজ হয় না। তিনি বলেন, আমি নির্বাচিত হওয়ার পর গত দেড় বছরে এ ওয়ার্ডে প্রায় ১২ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ করা হয়েছে। খিলগাঁওয়ের প্রতিটি সড়ক ও ফুটপাথ যেগুলো ভাঙ্গা ছিল তা পুনঃসংস্কার করা হয়েছে। নতুন দুটি রাস্তা করার পরিকল্পনা রয়েছে। ছিনতাই ও মাদক সেবন বন্ধে সব সড়কে এলইডি বাতি ও নাগরিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে বিভিন্ন স্থানে মোট ১৬৬টি ক্লাজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিকে) বসানো হয়েছে। এসব ক্যামেরা দিয়ে এক নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা আমার অফিস থেকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়। বর্তমানে খিলগাঁও একটি আধুনিক কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণসহ সকল সরকারী সেবামূলক অফিস এক সঙ্গে করতে নতুন ২০ তলা ভবন নির্মাণের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ শিগগিরই এটি নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করবে। ওয়াহিদুল হাসান বলেন, নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পয়োনিষ্কাশন লাইন সংস্কার করতে ঢাকা ওয়াসাকে আমরা বারবার আবেদন জানালেও তেমন কোন সাড়া পাইনি। বিষয়টি খুবই বিব্রতকর। এছাড়া রাজউকের মাধ্যমে আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে তোলা বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলো সরানো সম্ভব হলে এটি হবে রাজধানীর অন্যতম আবাসিক এলাকা।
×