ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য

স্বামীদের চাপে এ পথে নামতে বাধ্য হয়েছে নারী জঙ্গীরা

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬

স্বামীদের চাপে এ পথে নামতে বাধ্য হয়েছে নারী জঙ্গীরা

শংকর কুমার দে ॥ সারাদেশে দেড় সহস্রাধিক নারী জঙ্গীর তালিকা তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। নব্য জেএমবি, পুরাতন জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), হিযবুত তাহরীর, হরকাত উল জিহাদ (হুজি), আল্লাহর দলসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সক্রিয় সদস্য তারা। এর মধ্যে আত্মঘাতী দলের (সুইসাইডাল স্কোয়াড) সদস্যও আছে। জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নারী শাখা ইসলামী ছাত্রী সংস্থার কর্মীরাও এই উগ্রবাদী তৎপরতায় জড়ানোর তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। গত এক বছরে ১০৮ জন নারী জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সর্বশেষ রাজধানীর আশকোনা সূর্য ভিলা বাড়ির জঙ্গী আস্তানায় আত্মসমর্পণ করার পর গ্রেফতার করা হয়েছে দুই নারী জঙ্গী জেবুন্নাহার শীলা ও তৃষামণি তৃষ্ণাকে। তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। বিয়ের পর স্বামীকে বিশ্বাস করে ভালবেসে সংসার টিকিয়ে রাখতে ধর্মের অপব্যাখা মানতে বাধ্য হয়ে জঙ্গী হওয়ার পথ বেছে নিয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে নারী জঙ্গীরা। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া, টঙ্গী, গাজীপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলে নারী জঙ্গীদের তৎপরতা বেশি। তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে সংগঠনের সদস্য বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। অতীতে নারী জঙ্গীদের বেশি ব্যবহার করা হয় সংগঠনের বার্তা আদান-প্রদানের কাজে ব্যবহার করলেও সম্প্রতি আত্মঘাতী দলের সদস্য হিসেবেও ব্যবহার করার প্রবণতা বাড়ছে। জঙ্গীবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের মুখে পুরুষ সদস্যরা আড়ালে চলে গিয়ে নারীদের দিয়েই সাংগঠনিক কাজে সক্রিয় রাখছে। পরিবারের সদস্য বিশেষ করে স্বামী জঙ্গী তৎপরতায় যুক্ত হওয়ার পর স্ত্রীকেও এই পথে দীক্ষিত করার ঘটনাই সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া ভাই, বাবা, বোনজামাই বা বন্ধুদের মাধ্যমেও নারীদের উগ্রপন্থায় ঝোঁকার ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। গত কয়েক মাসে রাজধানী ঢাকা টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্নস্থান থেকে প্রায় বিশজন নারী জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার মধ্যে কয়েকজন আত্মঘাতী দলের সদস্য বলে দাবি করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর আগে গত ২৪ জুলাই সিরাজগঞ্জের মাছুমপুর মহল্লার উত্তরপাড়ায় হুকুম আলীর ভাড়া বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে নাদিরা তাবাসুম রানী, রুনা বেগম, হাবিবা আক্তার মিশু ও রুমানা আক্তার রুমাকে। তাদের কাছ থেকে ছয়টি হাতবোমা, গ্রেনেডের চারটি খোল, নয়টি জিহাদী বই, ডেটোনেটর, সুইচ ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। সম্প্রতি রাজধানীর ইডেন কলেজ ক্যাম্পাস থেকে জঙ্গী সন্দেহে লিপি আক্তার, নাজমা সুলতানা, নাসরিন সুলতানা ও নুরুননাহার নামে হিযবুত তাহরীরের চার নারী সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এদের মধ্যে নুরুননাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও ভূগোল বিভাগ থেকে পড়ালেখা শেষ করেছে। তার স্বামী মনিরুল ইসলাম একই বিভাগ থেকে শিক্ষা শেষ করেছে। তাদের নেতৃত্বে রাজধানীতে নারী জঙ্গীদের আলাদা একটি ইউনিট রয়েছে। তারা সবাই বিভিন্ন বেসরকারী ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বস্তির ছিন্নমূল নারীরাও আছে। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে তারা পুরুষ জঙ্গীদের সহযোগিতা করছে। গত ৭ জুলাই টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় জেএমবি সন্দেহে তিন নারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা হলেন রোজিনা বেগম, সাজিদা আক্তার ও জান্নাতী ওরফে জেমি। এদের কাছ থেকে দুটি চাপাতি, একটি ছোরা, জবাই করার জিহাদী ভিডিও ও বোমা তৈরির কলাকৌশল লেখা একটি খাতা উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত ২৭ জুলাই জঙ্গী সন্দেহে ইডেন কলেজের রসায়ন বিভাগের সাবিহা আফরিন সীমা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মোসাম্মৎ উম্মে সালমা রুমা, সমাজকর্ম বিভাগের মাকসুদা খাতুন, ইংরেজী বিভাগের নাসরিন সুলতানা এবং ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রী ফৌজি আক্তারকে গ্রেফতার করা হয়। গত ১৬ আগস্ট রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) চার নারী সদস্যের মধ্যে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক। বাকি তিনজন মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী। টাঈাইল জেলার কালিহাতী গ্রামে গত ৪ জুলাই রোজিনা সাজিদা বেগমকে গ্রেফতারের পর তার দেয়া তথ্যানুযায়ী গত ২৪ জুলাই সিরাজগঞ্জ থেকে জেএমবির নাদিয়া তাবাসুম রানী, হাবিবা আক্তার রুমা, রুমানা আক্তার রুমা ও বিজয়ের স্ত্রী রুমা খাতুনসহ চার নারী জঙ্গীকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর মধ্যে সাজিদার স্বামী নজরুল ইসলাম ওরফে হাসান ওরফে বাইক নজরুল ভয়ঙ্কর এক জঙ্গী। এই নজরুল পঞ্চগড়ের পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর রায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী, রংপুরে জাপানী নাগরিক হোশি কুনিও ও মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যাকা-ে জড়িত। তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তিন নারীই স্বীকার করেছে, তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জেএমবির মহিলা শাখার সক্রিয় সদস্য। তাদের স্বামীরাও একই সংগঠন করে। স্বামীরাই এদের এ পথে এনেছে। ফাতেমার জবানবন্দী ॥ তানভীর কাদেরীর স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা জিজ্ঞাসাবাদে ও জবানবন্দীতে বলেছে, স্বামীর চাপে জঙ্গীবাদে জড়িয়েছে সে। তার একটা সুন্দর জীবন ছিল। স্বামী ভাল চাকরি করত। স্বামী জঙ্গী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হবার পর তার কারণেই এই নারী জঙ্গী দলে ভিড়তে বাধ্য হয়। ফাতেমা জবানবন্দীতে বলেছেন, স্বামী তানভীর কাদেরী এক সময় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং শাখার কর্মকর্তা ছিল। আর তার স্ত্রী ছিলেন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘সেইভ দ্য চিলড্রেন’-এর কর্মকর্তা। মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা বলে তারা চাকরি ছাড়ার কয়েক মাস পর তাদের সন্ধান পাওয়া যায় আজিমপুরের জঙ্গী আস্তানায়। ফাতেমা বলেছেন, তার যেহেতু দুটি সন্তান রয়েছে, স্বামী জঙ্গীবাদে জড়িয়েছে খবর পেলে সামাজিকভাবে ছোট হয়ে যেতে হতো। আত্মীয়-স্বজনরা তাকে কখনই মেনে নিত না। তাই অনেকটা মনের বিরুদ্ধে তাকে স্বামীর সঙ্গে থাকতে হয়েছে। প্রিয়তির জবানবন্দী ॥ আজিমপুরে ফাতেমার সঙ্গে পুলিশের হাতে আটক প্রিয়তিও তার স্বামী জঙ্গী নেতা নুরুল ইসলাম মারজানকে অত্যন্ত স্বৈরাচারী মেজাজের লোক হিসেবে বর্ণনা করেছে প্রিয়তি। সে বলেছেন, নিজের সব ইচ্ছা সে স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দিত। প্রিয়তি তার মামার বাড়িতে বড় হয়েছে। লেখাপড়াও তেমন জানা নেই, চাকরি নেই। তাকে দেখার মতো কেউ ছিল না। জঙ্গী মতাদর্শে না গেলে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যাবে- এমন ভয় কাজ করত। শাকিরা যেভাবে আত্মঘাতী হন ॥ জঙ্গী সুমনের স্ত্রী শাকিরার আত্মঘাতী হামলায় অংশ নিয়েছে রাজধানীর আশকোনার সূর্য ভিলা নামের জঙ্গী আস্তানায়। তার আগের স্বামী ইকবাল ক্যান্সারে মারা গেছেন। বর্তমান স্বামী সুমনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে এমন খবর রয়েছে। ওই নারী হতাশায় ভুগছিলেন। সেখান থেকেই আত্মঘাতী হামলার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পুলিশ কর্মকর্তা যা বলেছেন ॥ পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, নব্য জেএমবির যে কয়জন নারী সদস্য এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন বা আত্মসমর্পণ করেছে, তারা সবাই স্বামীর চাপে বা সামাজিক কারণে ওই পথে গেছেন বলে ধারণা পেয়েছে পুলিশ। রাজধানীর আশকোনায় জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের মধ্যে সন্তান নিয়ে জেবুন্নাহার শীলা ও তৃষামণি দুই নারী জঙ্গীর আত্মসমর্পণ এবং গ্রেনেড ফাটিয়ে এক নারীর আত্মাহুতির ঘটনার তিন দিন পর বুধবার সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, নব্য জেএমবিতে এমন কোনো নারী নেই যিনি নিজের ইচ্ছায় জঙ্গীবাদে জড়িয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার, আত্মসমর্পণ করে রিমান্ডে থাকা নারীদের কাছে পাওয়া প্রাথমিক তথ্য এবং বিভিন্ন অভিযানে পাওয়া আলামত থেকে জানা গেছে সামাজিক কারণে, আত্মীয় স্বজনদের বিরাজভাজন হওয়ার ভয়ে এবং স্বামীদের চাপে তারা জঙ্গীবাদে যুক্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, দুই নারীই বলেছেন, তারা মন থেকে কখনই জঙ্গী মতাদর্শে বিশ্বাস করেন না। এই মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে যারা মানুষের ক্ষতি করে তাদের আদর্শকে তারা কোনদিন সমর্থন করেন না। তারপরও স্বামীর চাপে বাধ্য হয়ে তারা জঙ্গীদের সঙ্গে ছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল বলেন, জঙ্গী নেতারা তাদের সন্তানদেরও জঙ্গী মতাদর্শে বিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে চাইতো। তারা মনে করতো সন্তানের মাকে তাদের মতাদর্শে আনা গেলে তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে। এজন্য তারা স্ত্রীদের জঙ্গী মতাদর্শে বিশ্বাসী হিসেবে গড়ে উঠতে চাপ দিতেন। রাজধানীর আশকোনার জঙ্গী আস্তানা সূর্য ভিলা থেকে আত্মসমর্পণকারী দুই নারী জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর সাত দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে নারী ও পুরুষ জঙ্গীসহ জঙ্গী তৎপতার নেপথ্যের অনেক অজানা কাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের হয়ে আসছে বলে জানা গেছে।
×