ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ধীর গতির কারণে ২৬ কিলোমিটারে মাসে ক্ষতি ২শ’ ২৭ কোটি

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬

ধীর গতির কারণে ২৬ কিলোমিটারে মাসে ক্ষতি ২শ’ ২৭ কোটি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকার বিমানবন্দর থেকে পোস্তগোলা ভায়া গুলশান, মহাখালী, গুলিস্তান এবং বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার সড়কে অপেক্ষাকৃত কম ব্যস্ত সময়ে গাড়ির গতিসীমা থাকে ২২ কিলোমিটার। তা ব্যস্ত সময়ে থাকে ৯ কিলোমিটার। গাড়ির এ ধীরগতির কারণে প্রতিমাসে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২২৭ কোটি টাকা। অথবা প্রতিবার যাতায়াত করতে একজন যাত্রীকে বাড়তি সময় ব্যয় করতে হয়, যার আর্থিক মূল্য গড়ে জনপ্রতি ৫৩ টাকা। এটা গাড়ি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ের অতিরিক্ত খরচ। ২০০৪ সালে ঢাকায় গাড়ি চলাচলের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। ২০১৫ সালে এই গতি নেমেছে ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটারে। মঙ্গলবার মহাখালী ব্র্যাক সেন্টার ইন-এ অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। ‘নগর পরিস্থিতি ২০১৬ : ঢাকা মহানগরে যানজট-শাসন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গবর্ন্যান্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইডিজি)। অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগরীর যানজট নিয়ে একটি গবেষণাপত্র উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে নগর বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট সেক্টরের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। গবেষণাপত্রে কর্মঘণ্টা অপচয়, পরিবেশ দূষণ, জ্বালানি অপচয়সহ বিভিন্ন খাতে যানজটের প্রভাব তুলে ধরা হয়। গবেষণাপত্রে রাজধানীর যানজটের প্রধান কারণ হিসেবে রাস্তার অপর্যাপ্ততা, রাস্তার অপরিকল্পিত নকশা, অধিক জনসংখ্যার ঘনত্ব, প্রাইভেটকারের সংখ্যা বৃদ্ধি সর্বোপরি অপরিকল্পিত কার পার্কিংকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়াও ঢাকার দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থাপনা, সরকার ও পরিবহন সংস্থাগুলোর মধ্যে দুর্বল সমন্বয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিদিন প্রায় ৮ দশমিক ১৬ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে শুধু যানজটের কারণে। আর এর মধ্যে ৩ দশমিক ২০ মিলিয়ন ঘণ্টা অর্থাৎ ৪০ শতাংশ নষ্ট হচ্ছে ব্যবসায়িক কর্মঘণ্টা। অনুষ্ঠানে সাবেক ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার নাইদ আহমেদ বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাস্তার চেয়ে ফুটপাথ অনেক বড়। রাজধানীতে প্রয়োজনে রাস্তা ছোট করে মানুষের চলাচলের জন্য ফুটপাথ বড় করতে হবে। সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এমন চালক ও গাড়ির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়ে সাবেক এই পুলিশ কমিশনার বলেন, আমাদের সড়কে পার্কিং রাখার বিষয়টি অবহেলা করা হচ্ছে। পথচারীদের অবশ্যই ট্রাফিক আইনে আনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, রাস্তা পরাপারে প্রয়োজন ফুটওভারব্রিজ বাড়ানো। আরটিসির মতামতকে উপেক্ষা করে অনেক সময় লাভজনক রুটগুলোতে বাস নামানো হচ্ছে। অথচ নিয়ম হলো ফাঁকা রুটগুলোতে গাড়ি নামানো। যা পুরোপুরি আরটিসি অনুমোদন দিয়ে থাকে। সেফটি সেন্স ও প্রশিক্ষণ চালকদের সবচেয়ে বেশি জরুরী উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান ট্রাফিক ব্যবস্থায় অটো সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব নয়। সকলের সচেতন হওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, আগে যেখানে যানজট হতো না এখন সেখানেও হচ্ছে। তাই আমাদের গভীরভাবে বিষয়গুলো চিন্তা করে এর সমাধান করতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও যানজট নিরসনে পরিকল্পনা সমস্যা রয়েছে উল্লেখ করে গুলশান ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তা নুসরাত জাহান মুক্তা প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেন, নগরীর অন্যান্য এলাকার মতো গুলশানেও পার্কিংয়ের জায়গা নেই। ভবন নির্মাণের সময় তিন থেকে চারটি পার্কিং ফ্লোর দেখানো হয়। অথচ বাস্তবে তা পাওয়া যায় না। এগুলো তদারকি করারও কেউ নেই। বাস্তবতা হলো ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। কিন্তু সমাধান আমাদের হাতে নেই। আমরা আশা করব সকল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে দায়িত্ব পালন করবে। রাজধানীতে ট্রাফিক ও ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাপনা জরুরী উল্লেখ করে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ৩০ ভাগের বেশি মানুষ এখন নগরীতে পায়ে হেঁটে চলেন। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা নেই। যাও আছে এর বেশিরভাগই দখলে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩৬০ কিলো আয়তনের মধ্যে প্রায় এক কোটি মানুষের বসবাস উল্লেখ করে এই নগর বিশেষজ্ঞ বলেন, উপযুক্ত বিকল্প ছাড়া রাস্তা থেকে রিক্সা/হকার সহ কোনটিই উচ্ছেদ করা ঠিক হবে না। যানজটের জন্য বেড প্ল্যান, বেড ব্যবস্থাপনা ও বেড এ্যানফোর্সমেন্ড দায়ী বলেও মন্তব্য করেন তিনি। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ সাদ আন্দালিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. সুলতান হাফেজ রহমান। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন গবেষক দলের প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ফেলো ড. মোঃ শাহনেওয়াজ হোসেন। গবেষণায় যানজটের অন্তর্নিহিত বিষয় চিহ্নিত করার হয়েছে। এতে বলা হয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন সিটির সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ৩০টিরও বেশি সংস্থা সম্পৃক্ত যা সমন্বয় প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধান পরিবহন সমন্বয় সংস্থায় (ডিটিসিএ) জনবল সঙ্কট রয়েছে এবং ক্ষমতারও সীমাবদ্ধতা আছে। একইভাবে, অধিকাংশ প্রধান প্রধান সংস্থাগুলোর অভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যা, যেমন দক্ষতার অভাব (দক্ষ জনবলের অভাব), সীমিত উপকরণ, অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা ও স্বছতা দুর্বল চিত্র গবেষণায উঠে আসে। এছাড়া ঢাকার যানবাহন ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত প্রধান চারটি প্রতিষ্ঠান হলো : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (পুলিশ), স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়(সিটি কর্পোরেশন), সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় (ডিটিসিএ ও বিআরটিএ) এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় (রাজউক)। এসব সংস্থার সঙ্গে ডিটিসিএ’র দায়দায়িত্ব বণ্টনের দুর্বলতা, ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় সমন্বয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। গবেষণায় দেখা যায় যে, সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহন সংক্রান্ত অনেক আইনের বিদ্যমানতা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বহু আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও ড্রাইভার ও পথচারীরা প্রায়শই ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করেন। অপরদিকে গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা আইনের স্বল্পতা এবং তা প্রয়োগের দুর্বলতার কথাও তুলে ধরেছেন। এছাড়া ট্রাফিক আইন বিষয়ে জনগণের সচেতনতা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, পার্কিং নিয়ম, গতিসীমা এবং গাড়ি চালানোর সময় কি কি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে রাখতে হয় সেই সম্পর্কে অর্ধেকেরও কম উত্তরদাতা অবহিত। ট্রাফিক আইন না মানার মূল কারণ হলো, সড়কে বাস চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মানসিকতা ও আইনের দুর্বল প্রয়োগ। বিআরটিএ-তে চালক ও গাড়ির লাইসেন্স ব্যবস্থাপনা ‘দালাল’ দ্বারা প্রভাবিত, যারা টাকার বিনিময়ে, এমনকি পরীক্ষা ছাড়াই লাইসেন্স সরবরাহ করে। ২০১৫ সালে ২০ লাখ ভুয়া সনদ প্রদান করা হয় গবেষণায় এ তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, অনেক কার্যক্রম থাকা সত্ত্বেও আইন প্রয়োগে দুর্বলতা ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় প্রধান চ্যালেঞ্জ। ঢাকায় বাস নামানো অত্যন্ত কঠিন কাজ এবং এজন্য রাজনৈতিক যোগাযোগ থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছেÑ যা সুস্থ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে। যখন একটি বাস সার্ভিস চালু করা হয় তখন তা চালু রাখতে অনেক জায়গায় বাড়তি অর্থ দিতে হয়। ঢাকার সড়কে প্রায় ২ দশমিক ৬ লাখ হকার ব্যবসা করে, যারা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও গ্রুপকে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট হারে অবৈধ অর্থ দিয়ে থাকে। বছরে হকারদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ, প্রায় এক হাজার ৮শ’ ২৫ কোটি টাকা, যা ২০১৫/১৬ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মোট বাজেটের কাছাকাছি। ঢাকার ফুটপাথের এ অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার ভুক্তভোগী কমবেশি সকলেই। সাধারণ জনগণ জনবহুল ফুটপাটে হাঁটার ক্ষেত্রে চরম ভোগান্তির শিকার হন। একইসঙ্গে তা যানজট বাড়ায়। অপরদিকে হকাররা অধিক অর্থ প্রদান করেও প্রাত্যহিক নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন। আর নগর কর্তৃপক্ষ অনেক রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়।
×