ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

লাওসের লাল থেকে গোলাপী নিয়ে দুর্ভাবনা

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

বিএনপি যে একটি জগাখিচুড়ি দল এবং মূলত আদর্শ বর্জিত সেটা তারা জানলেও মানে না। এতদিন ধরে তারা বলে আসছিল এই সরকার ভোটারবিহীন নির্বাচনের সরকার। এরা অবৈধ। আর এই কথিত অবৈধ সরকারকে হটানোর জন্য আপোসহীন নেত্রী করেননি হেন কোন কাজ নেই। মতিঝিলে শাপলা চত্বরের ঘটনার আগের দিন তিনি জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন যারা ঢাকা আসবে তাদের দেখভাল করবে বিএনপি। সন্ত্রাস মারামারি বা দাঙ্গা ফ্যাসাদ যেভাবেই হোক তাঁর ভাষায় ‘মৌলভী’দের সঙ্গে থাকবেন তারা। এদের উস্কে দিয়ে ঠিক সময়ে পগারপার বিএনপি নেতাদের টিকিটিরও দেখা মেলেনি সে রাতে। তারপর চলল আগুনের পালা। আগুন নিয়ে খেলার ফলে কত মানুষ যে জ্যান্ত রোস্ট হয়েছিলেন, কত মানুষের আহাজারিতে ভরে উঠেছিল বার্ন ইউনিট তার হিসাব রাখা কঠিন। তাদের এক কথা দেশে গণতন্ত্র নেই। অবৈধ সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বা সংলাপের প্রশ্নই ওঠে না। ফলে জনগণকে মেরে হলেও এই সরকার হটাতে হবে। কিশোরীর চোখ গেল, বৃদ্ধের কপাল পুড়ল, পুলিশের মাথা থেঁতলে দেয়া হলো, মানুষকে কাবাব বানানো হলো; কিন্তু বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল না। সে বিড়াল এখন আর দুধের বাটির লোভ সামলে রাখতে নারাজ। সব জেদ অভিমান রাগ ভুলে সুড়সুড় করে ঢুকে পড়তে চাইছে গর্তে। যার প্রমাণ দেখা গেল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিএনপি নেতাদের হাসি হাসিমার্কা মুখের ছবিতে। খেয়াল করবেন, তারা কতটা প্রস্তুত হয়ে এসেছিলেন। মওদুদ আহমদ থেকে গয়েশ্বর রায় সবার মুখে হাসি। প্রায় সবাই স্যুট ও টাই পরিহিত। কেমন যেন একটা উৎসব উৎসব ভাব। এ কারণেই সমাজে তাদের এক ধরনের পপুলারিটি আছে। কারণ আমাদের সমাজ এখন ককটেলনির্ভর, স্যালাইনের মতো এক চিমটি মুক্তিযুদ্ধ, এক চামচ রাজাকারী, এক খাবলা পাকিপ্রেম আর ভারতীয় সালাদ। এই পরিবেশনে বিএনপি এগিয়ে বলে তাদের প্রতি মৌন সমর্থন আছে মানুষের। এর বাইরে যদি তাদের আসলেই আদর্শবোধ থাকত তারা এই সরকারের রাষ্ট্রপতির কাছে মুখ দেখাতে যেত না। সংলাপে কি হয় সে আমাদের অজানা নয়। কোন সংলাপ মানুষের মৃত্যু ডেকে আনে, কোনটা এক এগারো জাতীয় শাসন। কোন আলাপ রাজপথে লাশ ফেলে, কোনটা গদির লোভে আপোস। এতে জনগণের কোন লাভ নেই। বিএনপি এতদিন পর এই দেখা করার নাটকে মানুষের মন মজাতে পারবে না জেনেও কেন গেল তা হলে? হঠাৎ করে সবাই মিলে রাষ্ট্রপতির কাছে ধর্ণা দেয়ার কারণ যদি জাতীয় রাজনীতিতে বেগ আনে তবে এটা ধরে নিতে হবে কোথাও কিছু একটা ঘটছে। আওয়ামী লীগ ঠিকমতো শাসনভার চালাতে পারছে কিনা এ নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে। খালেদা জিয়া এমন কোন সিগন্যাল পেলেন যার কারণে সুড়সুড় করে আদালতেও হাজির হতে রাজি হয়ে যাচ্ছেন? বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি আগাগোড়াই একটা বিষয়ে সবার চাইতে এগিয়ে। ষড়যন্ত্র আর জনগণের মাথায় হাত বোলানোর এই দল এতদিন বাহিনী ও এজেন্টগুলোর অকারণ আশীর্বাদ লাভ করত। তাদের নেতা থাকতেনও সেখানে। সেসব খুব দূর অতীতের কথা নয়। অনেক কষ্টে সে চক্রের দুর্গে আঘাত হেনেছে আওয়ামী লীগ। যতটা না দল তার চেয়ে অনেক বেশি একা শেখ হাসিনাই লড়েছেন। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারে এমনকিছু কা- ঘটেছে, যা একদিন সময় তার সোনার আখরে লিখে তুলে রাখবে ইতিহাসের পাতায়। এদেশে কোনদিন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে এটা যেমন ভাবা যায়নি, তেমনি ভাবা যায়নি তাদের শাস্তিও হতে পারে এ সমাজে। আমার ধারণা এই কঠিন কাজটি একদিকে যেমন অতুলনীয় আরেক দিকে এটাই ভয়ের। কারণ এদেশের পাল্টে যাওয়া মানুষের মনে জামায়াতের প্রভাব ভুলে গেলে চলবে না। এরা এখন সব হারিয়ে দিশেহারা। বিএনপিকে আর একবার সামনে এনে তারা যদি পটপরিবর্তন করতে পারে সুশীল কুশীল কারও অস্তিত্ব থাকবে না। এমনকি বিএনপিও ছাড় পাবে না। তারা ভুলে যাবে না বিএনপি দুঃসময়ে কোন ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাদের টপ নেতাদের বিচার ও শাস্তির সময় খালেদা জিয়া ও তাঁর দল ছিল কবরের নিস্তব্ধতায় চুপ। এটা তারা কিছুতেই ছাড় দেবে না। আমরা তাই বুঝতে চাইছি কোন্ অঙ্গুলিহেলনে আজ বাতাস কিছুটা অন্যদিকে বইতে চাইছে? ধরে নিচ্ছি এখনও তেমন কিছু ঘটেনি। কিন্তু হঠাৎ করে কর্নেল অলির দলও নির্বাচনের জন্য পাগল হয়ে উঠছে কেন? এই ভদ্রলোক তাঁর পুরোজীবনে একবারের জন্যও বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিজের আনুগত্য বা দেশের ইতিহাসের প্রতি সম্মানসূচক কিছু করেননি। অথচ তিনি একজন বীর বিক্রম। তাঁর চাটগাঁর আসনটি ধরে রাখা ছাড়া আর কী অবদান আছে রাজনীতিতে? আমাদের যৌবনে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির বিরুদ্ধে এক দেয়াল। আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের শক্তির ত্রাস। এমন লোকরা হঠাৎ কেন আজ সংবাদ শিরোনাম? কোন্ গণতন্ত্রের কথা বলবেন এঁরা? হয় কোন নতুন আশা, নয় কোন মুরব্বির দোয়া বা ভরসা নয় তো লেজে জান ঠেকে যাওয়া। যেটাই হোক আপাতত শিকে ছিঁড়বে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের প্রতি একপেশে হবার কোন কারণ নেই। তাদের নিয়ে খুশি হবারও কিছু দেখি না। তবু শেখ হাসিনার বিকল্প নেই এখনও। যতদিন জামায়াত-বিএনপি একজোট, যতদিন বিজিতরা বিজয়ীকে খোলা দিলে না মানছে, যতদিন এদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ সবার নীতি না হয়ে উঠছে ততদিন শেখ হাসিনার বাইরে গেলে কেউই নিরাপদ থাকবে না। তাই সংলাপ রাজনীতির জন্য ভাল হলেও জনগণের জন্য মূল দরজা এখনও অনেক দূর। এই লেখাটি যখন লিখছি তখন আমি ভিয়েনটিয়েন শহরে। কটেজের পাশে সুইমিংপুলের ধারে। দিনভর প্রখর রোদে ঘুরে বেড়ানোর সব ক্লান্তি দূর করে দিয়েছে লাওদের আতিথেয়তা আর নম্রতা। এরাও আমাদের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষ। পাশে থাকা কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম কেউ ছাড় দেয়নি। ফরাসী কলোনি থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রাম করেছে এরা। জান দিয়েছে। কিন্তু ইংরেজ কলোনি ছিল না বলে দেশ এখনও একক আর অটুট। আর পাশের সব দেশের সঙ্গে আজ তারা বন্ধুতায় নিবিড়। কারণ তারা ঐক্যবদ্ধ। খালেদা জিয়ার মতো নেতারা এগুলো জানেন না মানেন না, বোঝেনও না। তাই হতাশা আর ভয় নিয়ে মেকংয়ের তীর থেকেও লিখতে হয় আমাদেরÑ জাতি তুমি শেখ হাসিনার বাইরে পা ফেলে নতুন বিপদ টেনে এনো না।
×