ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের  বিচিত্র কর্মজীবন

অষ্টম অধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানে আমার শেষ কটি আলোড়িত মাস- ১৯৬৮ এবং ১৯৬৯ (গতকালের পর) ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী সাত আট মাস পাকিস্তানের ইতিহাসে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করে। এই সময়ে রাষ্ট্রপতি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তার শাসনের ব্যর্থতা স্বীকার করে পদত্যাগ করেন। যদিও তার ক্ষমতা হস্তান্তর রক্তক্ষয়ী ছিল না কিন্তু জনবিক্ষোভ তখন দেশের দুই অঞ্চলেই ছিল তুঙ্গে। আমি ঢাকা পৌঁছার কয়েকদিন পরেই ছিল রাষ্ট্রপতির ঢাকা ভ্রমণসূচী এবং তখনই রাজনৈতিক পরিবর্তনের সব আলামত পাওয়া যায়। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই আমি বুঝলাম যে, আমাকে আরও কয়েক মাস রাওয়ালপিন্ডিতে থাকতে হবে। তবে আমি ভেবেছিলাম যে, সে হয়ত হবে মাস দুয়েক মাত্র। বাস্তবে সেই অপেক্ষা ছিল ছয় মাসের বেশি। আমাকে পিন্ডিতে প্রত্যাবর্তন করে প্রথমেই বাসস্থান খুঁজতে হলো। আমার বাড়িতে এরই মধ্যে আমার বন্ধু এবং নির্বাচিত পরবর্তী ক্যাবিনেট উপসচিব গোলাম মোস্তফা বসবাস করতে শুরু করেছেন। আমি তার মেহমান হিসেবে ঐ বাড়িতেই থাকলাম। আসলে যে বাড়িতে বিগত তিন বছরের বেশি সময় আমি বসবাস করি সেই বাড়িতে অতিথির কামরায় আমি আশ্রয় নিলাম। আমার গাড়ি তখনও আমার প্রাক্তন বাড়িতে ছিল। বলতে গেলে আমি আমার অভ্যস্ত রুটিন অনুযায়ী আবার পিন্ডিতে জীবন নির্বাহ করতে শুরু করলাম। এই সময়ে জানতে পারলাম যে, পশ্চিম পাকিস্তানী উচ্চপদস্থ আমলারা তাদের রাজনীতিবিদদের আইয়ুবের উদ্যোগের বিষয়টি সম্বন্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন। দেখা গেল যে পশ্চিমের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তখন আগামী দিনের সংবিধান নিয়ে নানা মন্তব্য করতে শুরু করলেন। এমনকি যারা রাজনীতি থেকে বহুদিন আগেই অবসর নিয়েছেন তারাও নানা বক্তব্য প্রদান বা কলাম প্রকাশে মনোনিবেশ করেছেন। সেখানে তাদের সকলেরই আসল কথা ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানে অতিরিক্ত সুযোগ দিতে হবে বটে কিন্তু তাই বলে পশ্চিমে যে উন্নয়নের ধারা বেগবান হয়েছে তাকে স্তিমিত করা সঠিক হবে না। তারা দৃঢ়ভাবে এক ব্যক্তি এক ভোটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। আমার মনে হলো পশ্চিমের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনিক উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা জোট বেঁধে যেন পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাব্য সুযোগ-সুবিধা এবং স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তাদের সন্দেহ হয় যে, গোলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের দাবি খুবই সুস্পষ্ট এবং বৈঠক সফল হলে সেই অঞ্চলকে শোষণের কোন সুযোগ থাকবে না। তারা মনে প্রাণে ছিলেন ছয় দফার বিরোধী এবং সেজন্য বিকল্প প্রস্তাব ক্রমাগতই উপস্থাপন করতে থাকেন। আমার মনে হলো যে, একটি গোলটেবিল বৈঠক হবেই হবে। আমার আরও মনে হলো যে, পশ্চিম পাকিস্তানীরা এক জোটে ছয় দফার বিকল্প নানা ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। আমার আর এক চিন্তা হলো যে, আমাদের বাঙালী নেতৃবৃন্দ হয়তো ছয় দফার অধীনে কী ধরনের রাষ্ট্রযন্ত্র প্রয়োজনীয় এবং কিভাবে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে সে সম্বন্ধে যথাযথভাবে অবহিত নন বা প্রস্তুতি গ্রহণ করেননি। তাই আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করলাম। আমাদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে তখন পিন্ডি ইসলামাবাদ ছিলেন সদ্য নিযুক্ত কতিপয় সচিব যথা সি এস পি কর্মকর্তা সৈয়দ আ. ফ. ম আবদুস সুবহান, সিএসপি কর্মকর্তা এ. কে. এম আহসান, পি. এস. পি কর্মকর্তা সাদেক আহমদ চৌধুরী, বিভাগপূর্ব বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা আবদুর রব, বিচারপতি আমিনুল ইসলাম, পি. এস. পি কর্মকর্তা কে. এন হোসেন। আমি সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা কাউকে আমাদের এই গোপন উদ্যোগে শামিল করার পক্ষে ছিলাম না। আমি ধারণা করি যে তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে হয়ত তাদের পরিচিত রাজনীতিবিদদের উপদেশ দিয়ে থাকতে পারেন। আমি আমার পরিচিত বলয় যুগ্ম ও উপসচিবদের সঙ্গে কাজ করতে পরিকল্পনা করি। আমি আমাদের আসরে পেলাম আইন বিভাগের একজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের ড্রাফটসম্যান আসাদুজ্জামান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব সৈয়দ আবুল খায়ের সিএসপি এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মুফিজুর রহমান সিএসপি। উপসচিব স্তরের বন্ধু-বান্ধব ছিলেন রাজস্ব বোর্ডের হেদায়েত আহমদ এবং আহমদ ফরিদ উদ্দিন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কামাল উদ্দিন চৌধুরী, পরিকল্পনা কমিশনের এবিএম গোলাম মোস্তাফা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এনায়েত করিম। এছাড়াও আমার দুই সহপাঠী আনিসুর রহমান এবং ওয়াহিদুল হক তখন ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছিলেন। আমি তাদের কাছে প্রস্তাব করলাম যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সব রাজনীতিবিদ এবং উচ্চপদস্থ প্রশাসকরা সবাই গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনার জন্য জোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীরা কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষা করা যায় সেই বিষয়ে রাজনীতিবিদদের উপদেশ দিচ্ছেন। আমাদের রাজনীতিবিদদের কিন্তু সে রকম সুযোগ ঢাকায় হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। চলবে...
×