ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনুপ্রবেশ ঘটাতে বিশেষ মহল ও আরএসও তৎপর

হঠাৎ করে নাফ নদীর একাধিক পয়েন্টে রোহিঙ্গা-স্রোত

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬

হঠাৎ করে নাফ নদীর একাধিক পয়েন্টে রোহিঙ্গা-স্রোত

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ॥ মিয়ানমারে দুই মাস আগের ন্যায় সহিংস ও উত্তপ্ত পরিস্থিতি না থাকলেও টেকনাফ সীমান্তে অপতৎপরতা চালাচ্ছে বিশেষ মহল ও আরএসও। রবি ও সোমবার দুইদিনে পৃথক অভিযানে প্রায় এক হাজার দুইশ’ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। হঠাৎ করে নাফ নদীর একাধিক পয়েন্টে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের স্রোত পরিলক্ষিত হচ্ছে। ছদ্মবেশে ঘুরতে আসা কিছু অপরিচিত লোকের কারণে সীমান্তে এমন অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানান সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা। বিজিবি সূত্র জানায়, সোমবারও নাফ নদীর ৩টি পয়েন্ট দিয়ে ৩৭টি নৌকায় করে দেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে প্রায় ৪ শতাধিক রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ওসব নৌকার প্রত্যেকটিতে ১২-১৩ জন করে মিয়ানমার নাগরিক ছিল বলে জানায় বিজিবি জওয়ানরা। এর আগে রবিবার সকালে ৩৪টি নৌকায় ৪ শতাধিক ও একই দিন সন্ধ্যায় অনুপ্রবেশকৃত ৭৩ পরিবারের ৩৫৭ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে। টেকনাফ থানায় বিজিবির দায়েরকৃত মামলার পলাতক আসামি আরএসও নেতা মোঃ আয়ুব ওরফে আয়ুব মাস্টারসহ কয়েকজন রোহিঙ্গা জঙ্গী আত্মগোপনে থেকে সীমান্তে রোহিঙ্গাদের স্রোত ভিডিও করে বিদেশে পোস্ট করতে অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারে মংডু তিনটি নিরাপত্তা চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলা ও অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটে। এরপর মিয়ানমারের রাখাইনে মংডুর কয়েকটি গ্রামে দেশটির সেনাবাহিনী অত্যাচার চালায় সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর। এরপর থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ শুরু করে। নবেম্বর ও ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কিছু কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করলেও হঠাৎ করে দুইদিন ধরে এর তীব্রতা বেড়েই চলছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে বিজিবি সদস্যরা। অতীতেও রোহিঙ্গা দরদী ওই বিশেষ মহল আরএসওকে কাজে লাগিয়ে রামু বৌদ্ধ বিহারে হামলা ঘটনাসহ একাধিক নাশকতামূলক কা- ঘটিয়েছে। বর্তমানেও তারা দেশে একদিকে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনার ছক অন্যদিকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলানোর অপতৎপরতা চালাচ্ছে বলে অভিজ্ঞজনরা মত প্রকাশ করেছেন। মিয়ানমারে কুশিক্ষা ও কুসংস্কারে গড়ে উঠা রোহিঙ্গাদের ধুয়া তুলসির পাতা বানিয়ে রিপোর্ট করতে সংবাদকর্মীদের বিভিন্নভাবে তদবির করছে আরএসও। সরকার যাতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে বাধা না দেয়, এজন্য কিছু মৌলবাদী সমর্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের পেছনে আরএসও নেতারা মোটা অঙ্কের টাকাও খরচ করছে বলে তথ্য মিলেছে। সূত্র মতে, গত ৯ অক্টোবর ভোর রাতে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা (আরএসও) বিজিপি ঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলা করে পালিয়ে গেছে দেশটির গহীন পাহাড়ে। এদের জন্য গত দুই মাসে অহেতুক দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা যুবকের তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সেদেশে বসবাসকারী নিরীহ রোহিঙ্গারা। কুতুপালং ও নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের একাধিক রোহিঙ্গা জানায়, রোহিঙ্গাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ও আরএসও কাড়ি কাড়ি টাকা আনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। আশ্রিতদের অসহায়ত্বের চিত্র ধারণ করে ইন্টারনেটে বহির্বিশ্বে পাঠায় তারা। বিদেশী অর্থ এনে সামান্যটুকু রোহিঙ্গাদের মধ্যে (ভিডিও ধারণের জন্য) বিলিবণ্টন দেখিয়ে সিংহভাগ অর্থ আত্মসাত করে থাকে আরএসও। তাদের কিছু ক্যাডাররা শরণার্থী ক্যাম্পে আছে ছদ্মবেশে। টেকনাফ থানার রাষ্ট্রদোহ মামলার পলাতক আসামি বর্মী আয়ুব মাস্টার, মৌলভী আবদুর রহমান, জামিনে বেরিয়ে আসা হাফেজ ছলাহুল ইসলাম, ইব্রাহিম, মৌলভী আজিজ ও তার সহোদর মৌলভী রফিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটাতে গোপনে সহায়তা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে মৌলভী আজিজ ও রফিক এ অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেন। এদিকে, মিয়ানমার নাগরিক রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রীয়-সমাজ ও নৈতিকতা বিরোধী অপতৎপরতায় সাগর-নদী, পাহাড়-উপকূল ও সীমান্ত বেষ্টিত উখিয়া এবং টেকনাফ বর্তমানে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভয়াল নেশা ইয়াবার গোড়া পত্তন ও নিয়ন্ত্রণ, অবৈধভাবে সাগর পথে মালয়েশিয়া মানব পাচারসহ সকল অপকর্মে জড়িত এ রোহিঙ্গারা। জেলা পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, জেলায় সংগঠিত অপরাধে ৭৫ ভাগ রোহিঙ্গা জড়িত। স্থানীয়রা জানায়, বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষাবৃত্তির ছদ্মবরণে ঘরবাড়ি, দোকানপাটে ছিঁটকে চুরি, কারেন্ট জাল বসিয়ে সাগর ও নাফ নদীতে চিংড়ির পোনা আহরণ করে বিভিন্ন প্রজাতির পোনা ধ্বংস এবং বিক্রিকল্পে সৈকত থেকে শামুক-ঝিনুক কুড়িয়ে নষ্ট করে দিচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশ। রোহিঙ্গা কিশোরী-যুবতীরা বাসাবাড়িতে ঝিয়ের নামে নিয়োজিত হয়ে অনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে পারিবারিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে থাকে। সরকার শরণার্থীদের জ্বালানির জন্য তুষের লাকড়ি সরবরাহ দিলেও বস্তাভর্তি লাকড়িগুলো বিক্রি করে দেয় ঠিকাদারকে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও সামাজিক বনায়ন থেকে মূল্যবান গাছ কেটে বনাঞ্চল উজাড় করছে রোহিঙ্গারা। পাহাড়, টিলা-উপত্যকা দখল করে স্থাপন করেছে অবৈধ বসতি। বিভিন্ন সড়ক-জনপদ, মেটোপথ, পাহাড়ী ও সৈকত এলাকায় ছিনতাই, পৈশাষিকভাবে খুন ও লোমহর্ষক ডাকাতি করে চলছে। পকেটমারা, অমানবিক লোলুপতায় ধর্ষণ, ধর্মীয় লেবাসে জঙ্গী কানেকশনসহ নানা অপরাধ সংগঠিত করে থাকে আরএসও রোহিঙ্গা জঙ্গীরা। টেকনাফ স্থলবন্দরসহ স্থানীয় শ্রমবাজার রোহিঙ্গারা দখল করে নিয়েছে বললে চলে। সাগরে জলদস্যুতাসহ অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকার পরিবেশ বিষিয়ে তুলেছে রোহিঙ্গারা। অসহায় ও নির্যাতিত শরণার্থী আরাকানি রোহিঙ্গারা বর্তমানে স্থানীয় মানুষের কাছে বিষ ফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। তাদের নানা অপরাধে অতিষ্ঠ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকার লোকজন। এদিকে ইতোপূর্বে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে জামাই আদরে বসবাস করছে মর্মে মিয়ানমারে খবর পৌঁছিয়েছে আরএসও। এ কারণে অতীতের চেয়ে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়ে গেছে। এদেশের জাতীয় সনদ সংগ্রহ করে ইয়াবাসহ বৈধ-অবৈধ বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে রোহিঙ্গা নেতারা। বিভিন্ন নামে ৭টি এনজিও সংস্থা এবং মৌলবাদী গোষ্ঠীর কেন্দ্রীয়, জেলা এবং স্থানীয় নেতাকর্মীদের সহায়তায় রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা দিচ্ছে আরএসও। জানা যায়, টেকনাফ-উখিয়ায় অবস্থিত দুটি শরণার্থী ক্যাম্পে ৩২ হাজার শরণার্থী আশ্রিত আছে। ক্যাম্পের বাইরে উখিয়ার কুতুপালং, টেকনাফের লেদা, বাহারছরা সাগর উপকূলীয় ঝাউবাগান, বিভিন্ন পাহাড় ও বস্তি এলাকায় অন্তত দুই লাখসহ প্রায় ৫ লক্ষাধিক অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বসবাস করছে। এসব রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় নিষিদ্ধ ঘোষিত আরএসও, এআরএনও এবং আন্তর্জাতিক নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাহেরী, আলহারামাইন ও আল্লাহর দলসহ বহু জঙ্গী সংগঠনের গোপন তৎপরতার সঙ্গে লিপ্ত আছে। রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসনের চেয়ে গত দুইদিন ধরে অবৈধ অনুপ্রবেশ গাণিতিক হারে বেড়েই চলেছে দেখে ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন মহলকে।
×