ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী সৈয়দ হকের জন্মদিন আজ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬

সব্যসাচী সৈয়দ হকের  জন্মদিন  আজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আমি জন্মেছি বাংলায় আমি বাংলায় কথা বলি/আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি/চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে ...। এভাবেই কবিতার আশ্রয়ে বাংলার মা ও মাটির সঙ্গে নিজের সংযোগ ঘটিয়েছিলেন সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক। বাংলার আলপথ ধরে চলা এই কবি হৃৎকলমের টানে মেলে ধরেছিলেন স্বদেশের মুখটি। ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণকারী এই কবি ও কথাশিল্পীর ৮২তম জন্মদিন ও ৮১তম জন্মবার্ষিকী আজ মঙ্গলবার। এই প্রথমবারের মতো কবিকে ছাড়াই উদ্্যাপিত হবে তাঁর জন্মদিন। গত বছরে এই দিনটিতেও তাঁকে নিয়ে জন্মাবার্ষিকীর আয়োজন ছিল বাংলা একাডেমিসহ আরও কয়েকটি স্থানে। বাংলা একাডেমিতে জন্মদিনের আয়োজনে তিনি ‘মহাত্মা লালনে’র দিকে চেয়ে আছেন বলে উল্লেখ করেছিলেন। কারণ লালন বেঁচে ছিলেন ১১৮ বছর। কিন্তু সব্যসাচীর সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। ক্যান্সার নামক দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে এ বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। আজ মঙ্গলবার সৈয়দ হকের গুলশানের বাসভবনে পরিবারের সদস্যরা অনেকটা নীরবেই উদ্যাপন করবে কবির জন্মদিন। এ প্রসঙ্গে কবিপুত্র দ্বিতীয় সৈয়দ হক বলেন, ‘একটি ফাঁকা চেয়ার থাকবে, বাবার স্মরণে। আর সবাই আসুন, আসলে মা খুশি হবেন।’ গোটা ছয়টি দশক ধরে কবিতা, গান, নাটক, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, গল্প-উপন্যাসসহ সাহিত্য ও শিল্পের ভুবনে অবিরাম বিচরণ করেছেন বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ শামসুল হক। সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল বিচরণের সক্ষমতাই সৈয়দ হককে দিয়েছে সব্যসাচী উপাধি। তাঁর সেই সৃজনশীল পথচলা থেমে যায় এ বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর। শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনকে স্তব্ধ করে দিয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে গত এপ্রিল মাসে কবির শরীরে ধরা পড়ে মরণব্যাধি ফুসফুসের ক্যান্সার। দেশের প্রাথমিক চিকিৎসার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ছুটে যান লন্ডনের রয়েল মার্সডেন হাসপাতালে। মাস চারেক চিকিৎসা চলে সেখানেই। লন্ডনের চিকিৎসকরাই আশা জাগিয়েছিলেন লেখক আরও ছয় মাস বাঁচতে পারেন। কিন্তু সে আশাও পরিণত হয় নিরাশায়। লন্ডনের চিকিৎসকরাই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তেমন কিছুই করার নেই। ১ সেপ্টেম্বর তিনি দেশে ফেরেন। এরপর থেকে ইউনাইটেড হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কবির ইচ্ছামাফিক তাঁর জন্মভূমি কুড়িগ্রামের সরকারী কলেজের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। সাহিত্যের সকল শাখায় বিচরণকারী সৈয়দ হক বেঁচেছিলেন ৮১ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে দু’হাত ভরে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ও গান লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। কাব্যনাট্য রচনায় ঈর্ষণীয় সফলতা পাওয়া সৈয়দ হক ‘নুরলদীনের সারাজীবন’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘গণনায়ক’, ‘ঈর্ষা’ ইত্যাদি নাটকে রেখেছেন মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। লিখেছেন ৫০টির বেশি উপন্যাস। যার মধ্যে ‘আয়না বিবির পালা’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’ ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’ ও ‘মৃগয়ার কালক্ষেপ’ অন্যতম। পাঠক আলোড়িত করা কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’ ও ‘পরাণের গহীন ভিতর’। ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে আমৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। সাহিত্য-শিল্পের নানা শাখা-প্রশাখায় বিচরণকারী সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ছিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আর মা গৃহিণী হালিমা খাতুন। ১৯৫৩ সালে ‘একদা এক রাজ্যে’ কাব্য দিয়ে তার যাত্রা শুরু হলেও ‘তাস’ নামের গ্রন্থটি আরও আগেই প্রকাশিত হয়। দু’হাত ভরে লিখেছেন তিনি। তার রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরাণের গহীন ভিতর, নাভিমূলে ভস্মাধার, আমার শহর ঢাকা, বেজান শহরের জন্য কেরাম, বৃষ্টি ও জলের কবিতা। ষাট, সত্তর ও আশির দশকে অনেক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রের জন্য গানও লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘অনেক সাধের ময়না আমার’, ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাহিয়া’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’র মতো বহু গান মানুষের মুখে মুখে। তাঁর নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাস অবলম্বনে গেরিলা নামের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। গায়ক এন্ড্রু কিশোরের জন্য কবি চারটি গান লিখে গেছেন। শেষ বিদায়ের আগে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে-বসে চালিয়ে গেছেন লেখালেখি। জানা গেছে চিকিৎসাধীন ছয় মাসে তিনি প্রায় ২০০ কবিতা, উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’র পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ও আটটি ছোটগল্প লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন সব্যসাচী এই লেখক। জন্মজয়ন্তীর কর্মসূচী ॥ সৈয়দ শামসুল হকের জয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও জাতীয় কবিতা পরিষদ পৃথক দুটি আয়োজন করেছে। আজ সন্ধ্যা ছয়টায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় এ আয়োজনে সৈয়দ শামসুল হকের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করবেন এমিরেটাস অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, আতাউর রহমান, কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা প্রমুখ। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য এ আয়োজনে সৈয়দ হকের কবিতা আবৃত্তি, নাটকের অংশবিশেষ পাঠ, রচিত গানের পরিবেশন ও নৃত্য। বেলা ১১টায় বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে কবিতা পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে থাকবে আলোচনা, সৈয়দ হকের কবিতা পাঠ ও স্বরচিত কবিতা পাঠ।
×