ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের পরিসর বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গুচ্ছগ্রাম  প্রকল্পের পরিসর  বাড়ছে

আনোয়ার রোজেন ॥ সবার জন্য বাসস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পকে আরও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রকল্পের আওতায় প্রথমে ১০ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করার কথা থাকলেও তা সংশোধন করে ৫০ হাজারে উন্নীত করা হয়েছে। ভূমিহীন এসব পরিবারকে সরকারী খাসজমিতে পুনর্বাসন করা হবে। গুচ্ছগ্রামের সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে কয়েকগুণ। ৩৪০টির পরিবর্তে এখন গুচ্ছগ্রামের সংখ্যা হবে ২ হাজার ৫০০টি। এজন্য সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে প্রায় ৯৪২ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রকল্পের পরিসর বাড়ানো হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার বাইরে ভূমি মন্ত্রণালয় দেশজুড়ে ২০২০ সালের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। পরিকল্পনা কমিশন ও ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, প্রথম পর্যায়ের সাফল্যের পর গুচ্ছগ্রাম ২য় পর্যায় (ক্লাইমেট ভিকটিমস রিহ্যাবিলিটেশন) শিরোনামের এই প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয় গত বছরের অক্টোবর মাসে। তখন এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৫৮ কোটি টাকা। ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য আবাসনের নির্বাচানী অঙ্গীকারের কথা মনে করিয়ে দিয়ে গত ১৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পে ভূমিহীন পরিবার ও গুচ্ছগ্রামের সংখ্যা বাড়ানোর নির্দেশ দেন। সে অনুসারে আরও ৬৮৪ কোটি টাকা প্রাক্কলতি ব্যয় যুক্ত করে প্রকল্পের ১ম সংশোধনীতে সম্প্রতি অনুমোদন দেয় একনেক। সূত্র জানায়, গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের সার্বিক লক্ষ্য হলো জলবায়ু দুর্গত ভূমিহীন পরিবারকে সরকারী খাস জমিতে পুনর্বাসন করা। এজন্য নির্মিত ইকোভিলেজে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের নামে এবং বিধবাদের ক্ষেত্রে একক নামে বসত-ভিটার কবুলিয়াত প্রদান করা হয়। এতে মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠিকানা মিলবার পাশাপাশি ৪ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত জমির নিষ্ককণ্টক মালিকানা, সম্মানের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহ আর সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সুযোগ তৈরি হয়। প্রকল্পের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো- মানব সম্পদ উন্নয়নে পুনর্বাসিত পরিবারসমূহের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণসহ আয়বর্ধক কর্মকা- পরিচালনার মাধ্যমে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন সাধন করা, যা দেশের দারিদ্র্য নিরসনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, এনজিও বিষয়ক ব্যুরো, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডসহ (বিআরডিবি) সরকারের একাধিক সংস্থা সরাসরি এ কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত। সূত্র জানায়, সংশোধিত প্রকল্পের প্রধান প্রধান কার্যক্রম অনুযায়ী নির্মিত গুচ্ছগ্রামের প্রতিটি পরিবারের জন্য ৩০০ বর্গফুট ফ্লোর স্পেস বিশিষ্ট আরসিসি পিলারসহ দুইকক্ষ বিশিষ্ট ঘর এবং ৫ রিং বিশিষ্ট স্যানিটারি ল্যাট্রিন নির্মাণ করা হবে। এছাড়া পুনর্বাসিত প্রতিটি পরিবারকে ১টি করে মোট ৫০ হাজার উন্নত চুলা সরবরাহ করা হবে। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় হবে বসতভিটা উঁচুকরণ, পুকুর খনন, পুনঃখনন, সংযোগ রাস্তা ইত্যাদি নির্মাণ। নিরাপদ সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে স্থাপন করা হবে বিভিন্ন প্রকারের ১০ হাজার গভীর-অগভীর নলকূপ/রিংওয়েল/পন্ডস্যান্ড ফিল্টার ইত্যাদি। এর বাইরে উন্নত জীবনমান সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে গুচ্ছগ্রামগুলোতে নির্মাণ করা হবে ৩৪০টি মাল্টিপারপাস হল, ৩৩৭টি গোসলখানা এবং ২৫০টি ঘাটলা। প্রাথমিকভাবে ৩০০ গুচ্ছগ্রামবাসী পাবেন বিদ্যুত সরবারহ সুবিধা। প্রকল্প সম্পর্কে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পর্যায়ক্রমে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। গৃহহীনদের ঘর তৈরির যত টাকা লাগুক, দেবে সরকার। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের বড় বাধা হলো খাস জমি খুঁজে বের করা। দেশে পর্যাপ্ত খাস জমি রয়েছে। গৃহহীন ও ভূমিহীনের জন্য জায়গা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এমন অজুহাত দেখানো যাবে না। সংশ্লিষ্ট কেউ খাস জমির সঠিক তথ্য দিতে গড়িমসি করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে দারিদ্র নিরসন কর্মসূচীর আওতায় জাপান সরকারের ঋণ মওকুফ তহবিলের (জেডিসিএফ) অর্থায়নে ২০০৯ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জুন ২০০৯ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৫ পর্যন্তÍ সরকার গুচ্ছগ্রাম (ক্লাইমেট ভিকটিমস রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট) প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে দেশের সাতটি বিভাগের ৫৩টি জেলার ১৩১টি উপজেলায় ২৫৩টি গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করেছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে ১০ হাজার ৭০৩টি ভূমিহীন, গৃহহীন, ঠিকানাবিহীন ও নদীভাঙনকবলিত পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের শুরু থেকে নিঃস্ব পরিবারগুলোর কর্মক্ষম সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের জন্য ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে বিআরডিবি, যা দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে। এছাড়া প্রথম পর্যায়ে স্থাপিত প্রতিটি গুচ্ছগ্রামেই পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম, প্রাথমিক শিক্ষার জন্য স্কুলের ব্যবস্থা, প্রাথমিক এবং প্রসূতি স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ও সামাজিক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী চালু রয়েছে। এদিকে জানা গেছে, ভূমিহীন ও দরিদ্র পরিবারের ডেটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে দেশের ৬০ জেলার জেলা প্রশাসককে ওইসব পরিবারের সদস্যদের নাম-পরিচয়সহ বিভিন্ন তথ্যের সফট কপি পাঠাতে বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের প্রবর্তন করেন। ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ততকালীন নোয়াখালী (বর্তমান লক্ষ্মীপুর) জেলার রামগতি থানা পরিদর্শনকালে বঙ্গবন্ধু নদীভাঙা, দুস্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে খাসজমিতে পুনর্বাসন কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। সেই সময় বৃহত্তর নোয়াখালী জেলায় চারটি গুচ্ছগ্রামে এক হাজার ৪৭০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। এরপর সামরিক শাসক এরশাদের আমলে নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত ১০ বছর মেয়াদে নেয়া হয় গুচ্ছগ্রাম (পরে তা আদর্শ গ্রাম নামকরণ হয়) প্রকল্প। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ১৯৯৮ সালের জুলাই থেকে আদর্শ গ্রাম প্রকল্প-২ নামে আবার নতুন প্রকল্প নেয়া হয়। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে প্রকল্পটি গুরুত্ব হারায়। গুচ্ছগ্রাম ও আদর্শগ্রাম প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত মোট ৮১ হাজার ৭৩৫টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে।
×