ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

২০১৬-এর কূটনীতি

আলোচিত ঘটনা চীনের প্রেসিডেন্ট ও কেরির সফর

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬

আলোচিত ঘটনা চীনের প্রেসিডেন্ট ও কেরির সফর

তৌহিদুর রহমান ॥ ২০১৬ সালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য এসেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির ঢাকা সফর ছিল আলোচিত ঘটনা। এছাড়া চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের সময় ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই ছিল সরকারের বড় ধরনের সাফল্য। এছাড়া হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পরে বিদেশীদের নিরাপত্তা জোরদারে সচেষ্ট ছিল সরকার। আর বছরের শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে টানাপোড়েন চলে আসছে। বছরের শেষ দিকে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বাংলাদেশ সফরের সময় ঢাকা-দিল্লীর মধ্যে সামরিক সহযোগিতার প্রস্তাবও ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। চলতি বছরের শেষভাগে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিষয়টি তুলে ধরে সরকার। এছাড়া গত ৮-১০ ডিসেম্বর ঢাকায় আন্তর্জাতিক অভিবাসন সম্মেলন (জিএফএমডি) শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন ছিল আলোচিত ঘটনা। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চলতি বছরের ১৪ অক্টোবর ঢাকা সফর করেন। সে সময় দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ, সমুদ্রসীমা রক্ষায় ঢাকা-বেজিং একযোগে কাজ করবে। বাংলাদেশ ও চীন দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতা জোরদার করবে। বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ‘গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার’ বলে মনে করে চীন। দেশটিকে ‘এক চীন নীতি’তে বাংলাদেশ জোরালো সমর্থন দেয়। এছাড়া উপকূলীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণসহ অবকাঠামো উন্নয়ন ও সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই করে ঢাকা-বেজিং। চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে ঢাকা-বেজিং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গতি পায়। বিশেষ করে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও বেড়েছে। ২০১৫ সালে ঢাকা-বেজিং কূটনৈতিক সম্পর্কের চল্লিশ বছর পূর্তি হয়। দুই দেশের মধ্যে ৪০ বছর কূটনৈতিক সম্পর্ক পূর্তি উপলক্ষে গত বছরই ঢাকায় আসার কথা ছিল চীনা প্রেসিডেন্টের। তবে বিভিন্ন কারণে তিনি সে সময় আসতে না পেরে চলতি বছর ঢাকা সফর করেন শি জিন পিং। চলতি বছরের ২৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জন কেরি বাংলাদেশ সফরে আসেন। সে সময় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে জন কেরি জানান, সন্ত্রাস ও জঙ্গী প্রতিরোধে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে কাজ করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্ক ও কোটা মুক্ত পণ্য প্রবেশ নিশ্চিত করা হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনীকে ফেরত দেয়ার বিষয়ে উদ্যোগ নেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন মার্কিন সরকার বিরোধিতা করলেও মার্কিন জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে। পহেলা জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পরে বিদেশী কূটনীতিক ও নাগরিকদের নিরাপত্তার ইস্যুটি সামনে চলে আসে। সে সময় বিদেশী কূটনীতিক ও নাগরিকদের নিরাপত্তা জোরদার করে সরকার। বিদেশীদের নিরাপত্তা নিয়ে সরকারের পদক্ষেপ জানাতে কূটনীতিকদের ব্রিফও করা হয়। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে গত বছরের মতো চলতি বছরেও ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে টানাপোড়েন চলে আসছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামী নেতা মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- ঘিরে ইসলামাবাদের প্রতিক্রিয়ার কড়া প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। চলতি বছর ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সামিনা মেহতাবকে তলব করে জানিয়ে দেয়া হয়, যুদ্ধাপরাধের বিচার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে কারণে বাংলাদেশের এ একান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে নিষেধ করা হয় পাকিস্তানকে। দেশটির এই আচরণকে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রতি বড় আঘাত বলেও অভিহিত করে বাংলাদেশ। আর যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে পাকিস্তান নাক গলানোর প্রেক্ষিতে ইসলামাবাদে আয়োজিত ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবে না বলে ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ। যদিও পরবর্তীতে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়। যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- কার্যকর করার পর চলতি বছর ৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, মীর কাশেমের ফাঁসি কার্যকর করায় ইসলামাবাদ গভীরভাবে মর্মাহত। মীর কাশেমের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে পাকিস্তানের বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের আগে সংঘটিত কথিত অপরাধের অভিযোগে ত্রুটিপূর্ণ বিচার প্রক্রিয়ায় মীর কাশেমের মৃত্যুদ- কার্যকর করায় পাকিস্তান গভীরভাবে মর্মাহত। সে প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সামিনা মেহতাবকে তলব করে সরকার। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা জোরদারের বার্তা দিতে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর গোপালকৃষ্ণ প্রভু পারিকর গত ৩০ নবেম্বর ঢাকা সফর করেন। ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পারিকর ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়। সেসব আলোচনার মধ্যে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা জোরদারের বিষয়টি পাধান্য পায়। এছাড়া ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে নতুন প্রস্তাব দেন। সে প্রস্তাব অনুযায়ী দুই দেশের সামরিক বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন পারিকর। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন বাস্তবায়নে ভারত সমর্থন দেবে বলেও জানান ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। চলতি বছর ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের তিনটি সীমান্ত পোস্টে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলার প্রেক্ষিতে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত জেলাগুলোয় শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। সেনাবাহিনীর অভিযানে রাখাইন প্রদেশে ১২শ’র বেশি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এ সহিংসতায় ৮৬ জনের মৃত্যুর খবর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করলেও নিহতদের মধ্যে ৬৯ জনকে সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দাবি করে তারা। দমন অভিযানের মুখে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এ ঘটনায় ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিও মিন্ট থানকে তলবের পরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকার। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে চাপ দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়। সে উদ্যোগ সফলও হয়। এদিকে বিশ্বজুড়ে নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে চলতি বছর ৮-১০ ডিসেম্বর তিন দিনব্যাপী ঢাকায় নবম আন্তর্জাতিক অভিবাসন সম্মেলন (জিএফএমডি) অনুষ্ঠিত হয়। ১২৫টি দেশের প্রতিনিধি এবং জাতিসংঘের ৩০টিরও অধিক সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, গ্লোবাল সিভিল সোসাইটি এবং ব্যবসায়ী সংস্থার প্রায় সাড়ে ৫শ’ প্রতিনিধি জিএফএমডি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। চলতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস টোকিও যাওয়ার পথে ঘণ্টাখানেকের জন্য ঢাকায় যাত্রাবিরতি করেন। সে সময় ফিলিস্তিনকে অব্যাহতভাবে সমর্থন করায় বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। এছাড়াও চলতি বছর ঢাকা সফর করেন চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী চেং ওয়ানকুয়ান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাণিজ্য বিষয়ক দূত রুশনারা আলী এমপি, ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর, ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো এলপি মারসুদি প্রমুখ।
×