ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচদিন পর পাঠ্যপুস্তক উৎসব

৩৬ কোটি ২১ লাখ নতুন পাঠ্যবই প্রস্তুত

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬

৩৬ কোটি ২১ লাখ নতুন পাঠ্যবই প্রস্তুত

বিভাষ বাড়ৈ ॥ আর মাত্র পাঁচদিন। দেশব্যাপী পাঠ্যপুস্তক উৎসব পালনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের চার কোটি ২৬ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য ৩৬ কোটি ২১ লাখ নতুন ঝকঝকে পাঠ্যবইও প্রায় প্রস্তুত। ইতোমধ্যেই উপজেলা ও স্কুল পর্যায়ে পৌঁছে গেছে মোট বইয়ের ৯১ শতাংশ। মাধ্যমিক, ইবতেদায়ী, দাখিল, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের ব্রেইল বই উপজেলা বিদ্যালয়ে পৌঁছে গেছে প্রায় শতভাগ। তবে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও প্রথমবারের মতো পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষার পাঠ্যবই এখনও উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছেছে ৮০ ভাগেরও কম। যদিও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, উদ্বেগের কিছু নেই। ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রতিটি স্কুলে পৌঁছে যাবে বাকি বই। জানা গেছে, বছরের প্রথম দিন দেশব্যাপী পাঠ্যপুস্তক উৎসব দিবস পালনের জন্য শেষ মুহূর্তের কাজ করছে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ১ জানুয়ারি থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত থাকবে এই উৎসবের আমেজ। এই সময়ে প্রতিটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উৎসরের মধ্য দিয়ে এ স্তরের প্রতিটি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হবে নতুন পাঠ্যবই। এর আগে আগামী ৩০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কর্মসূচীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। ১ জানুয়ারি আজিমপুর সরকারী গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজে পাঠ্যপুস্তক উৎসবের শুরু করবেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। বরাবরের মতো প্রতিষ্ঠানটিকে উৎসবের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এদিকে উৎসব আয়োজন নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থান নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। স্কুলের শিশুদের পাঠ্যপুস্তক উৎসবকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে আয়োজন করা, অনাকাক্সিক্ষত সব খাত তৈরি করে উৎসবের নামে ৩০ লাখেরও বেশি টাকা ব্যয় দেখানোকে কেন্দ্র করে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। সোমবার বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো হুলুস্থুল বাঁধিয়ে ফেলেন কয়েক কর্মকর্তা। কর্মকর্তাদের মধ্যেই ঘটনা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। এক পক্ষ ইতোমধ্যেই অভিযোগ তুলেছেন, পাঠ্যবই উৎসবের নামে সরকারের অর্থের যথেচ্ছ ব্যবহারের আয়োজন করা হয়েছে। ১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে পাঠ্যবই উৎসব পালনের জন্য ৩০ লাখ তিন হাজার ৫০০ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করেছে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ ঢাকায় আজিমপুর গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজে সর্বোচ্চ ৭ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে পাঠ্যপুস্তক উৎসবের আয়োজন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, আমরা বই বিতরণ করব প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের কাছে। কিন্তু উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে। যা কখনই করা হয়নি। এটা সরকারী অর্থের অপচয় করা ছাড়া আর কিছু নয়। মন্ত্রণালয়ের পাঠ্যবই উৎসব খাতে এবার মোট ৩০ লাখ তিন হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ রেখেছে। এর মধ্যে মঞ্চ ও মাঠ সজ্জায় এক লাখ ৫ হাজার টাকা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য এক লাখ ৫০ হাজার ৭৫০ টাকা, আমন্ত্রণপত্র ছাপানো ও বিতরণের জন্য ৫৫ হাজার টাকা, আপ্যায়ন ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ব্যয় ৯ লাখ ৪ হাজার ১০০ টাকা, সেলিব্রেটি উপস্থিতি ও সম্মানী দুই লাখ টাকা, ডকুমেন্টারি তৈরিতে চার লাখ ৪৯ হাজার ৬৫০ টাকা, মিডিয়া প্রচার ও অন্যান্য তথ্য যোগাযোগ খাতে দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। পাঠ্যবই উৎসবের জন্য এতো টাকা ব্যয় নির্ধারণের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এ বিষয়ে কোন কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে এ গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, আসলে একটি অনুষ্ঠানের ডেকোরেশন, মাঠ সাজানো ও এ সংক্রান্ত কাজে ৩০ লাখ টাকা কোন টাকাই না। পরে অবশ্য তিনি দাবি করেন, এই টাকা সারাদেশের ৪৮৪টি উপজেলায় বিতরণ করা হবে। কিন্তু গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উপজেলা পর্যায়ে পাঠ্যবই উৎসবের জন্য আমরা কাউকে কোন খরচ দেই না। এই ৩০ লাখ টাকা ঢাকায় অনুষ্ঠানের জন্যই বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গিয়াস উদ্দিন আহমেদ জানান, পিইডিপি-৩ প্রকল্প থেকে ৩০ লাখ টাকার সংস্থান করা হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বই উৎসবের জন্য সাত লাখ টাকার সংস্থান করা হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড এবং শিক্ষা অধিদফতর থেকে। এদিকে আয়োজন নিয়ে নানামুখী সমালোচনা শুরু হলেও সারাদেশে পাঠ্যবই বিতরণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে বলে জানিয়েছে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। গেল বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও ভালভাবে বই বিতরণ নিশ্চিত করতে ছাপা হয়েছে চাহিদার তুলনায় অন্তত ৫ শতাংশ বেশি বই। অতিরিক্ত এই বই বাফা স্টক হিসেবে (কোথাও জরুরী প্রয়োজনের জন্য) থাকবে। এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, এখন পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৯৭ শতাংশ এবং প্রাথমিক স্তরের ৯০ ভাগের বেশি বই সারাদেশের স্কুল পর্যায়ে বিতরণ করা হয়েছে। তবে যেসব জেলায় এখনও সব বই পৌঁছেনি, সেগুলোতে আগামী দু’তিন দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় বই পৌঁছে যাবে। বই নিয়ে চিন্তার কিছুই নেই। চেয়ারম্যান বলেন, চলতি বছরের তুলনায় আগামী বছরের বই ৩ কোটি কোপিরও বেশি। তবে বই একটু বেশি হলেও এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। বই ছাপা ও সরবরাহের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। বছরের প্রথমদিনই দেশের সব ছাত্রছাত্রী নতুন চকচকে বই পাবে বিনামূল্যে। এবারও উৎসবমুখর পরিবেশে বই বিতরণ করা হবে। এ উৎসব চলবে নতুন বছরের শুরু থেকে সপ্তাহব্যাপী। দেশের স্বার্থে সরকারের এই পরিকল্পনা সফল করতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড জানিয়েছে, নতুন বছরের জন্য মোট পাঠ্যবই ছাপানো হচ্ছে ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার কপি। শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই সারাদেশের মোট চার কোটি ২৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯২৯ জন ছাত্রছাত্রী বিনামূল্যে পাবে নতুন বই। মোট বইয়ের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকের ৩২ লাখ ৬২ হাজার ৮৬৪ জন শিশুর জন্য এক কোটি পাঁচ লাখ পাঁচ হাজার ৮৩২ কপি বই, প্রাথমিকের দুই কোটি ১৭ লাখ ২১ হাজার ১২৯ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য দশ কোটি ৫২ লাখ ৮৮ হাজার ৩২৭ কপি বই, মাধ্যমিক (ইংরেজী ভার্সনসহ) এবং এসএসসি ভোকেশনাল স্তরের এক কোটি ২০ লাখ ৫৮ হাজার ৩৬৮ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১৭ কোটি ৬৮ লাখ ৩০ হাজার ৩৬৮ কপি বই এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালের (ট্রেড বই) দুই লাখ দশ হাজার ৭৭৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৯ লাখ ২১ হাজার ১১০ কপি বই ছাপানো হয়েছে। মাদ্রাসার ইবতেদায়ী ও দাখিলের ৫৩ লাখ ৫৭ হাজার ২১ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য পাঁচ কোটি ৭১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮৫ কপি বই, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এক হাজার ২৩১ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৯ হাজার ৭০৩ কপি বই, প্রাথমিকের শিক্ষক নির্দেশিকা ৬০ লাখ এক হাজার ৭২৪ কপি এবং মাধ্যমিকের শিক্ষক শিক্ষাক্রম নির্দেশিকা ছাপানো হচ্ছে ৪৬ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬৪ কপি বই প্রস্তুত হচ্ছে। এছাড়াও পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ২৪ হাজার ৬৪১ জন শিশুর জন্য প্রাক-প্রাথমিক স্তরের ৫১ হাজার ৭৮২ কপি বই মুদ্রণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে মারমা, চাকমা, গারো, সাদ্রি ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর শিশুরা প্রথমবারের মতো নিজ নিজ মাতৃভাষার বই পাবে বিনামূল্যে। পাশাপাশি এবার পাঁচটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় (শিশুর জন্য) ২৫ হাজার ৫০০টি টিচিং ম্যাটারিয়াল বা শিক্ষা উপকরণ বিশেষ করে ফ্লিপ চার্ট, ফ্ল্যাশ, কার্ড, স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জনবর্ণ চার্ট বিনামূল্যে বিতরণ করবে সরকার। প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপানো হয় আন্তর্জাতিক দরপত্রে। বাকি বই ছাপা হয় স্থানীয় দরপত্রে। আন্তর্জাতিক দরপত্রে ছাপানো বইয়ের কাগজসহ যাবতীয় উপকরণ ছাপাখানার মালিকরাই কিনে নেন। এনসিটিবি কেবল কাগজ ও কালির মান নিয়ন্ত্রণ করে। এদিকে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছর পর আগামী ১ বছরের প্রথম দিনই দেশের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের পথ উন্মুক্ত হতে চলেছে। মাতৃভাষায় পাঠ্য বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে দেশের পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা। প্রথমবারের মতো ৫টি জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় প্রস্তুত হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই ও শিক্ষা উপকরণ। পরবর্তী শিক্ষা বর্ষ থেকে পর্যাক্রমে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক স্তরে অন্যান্য আদিবাসী শিশুরাও মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। জানা গেছে, পার্বত্য শান্তিচুক্তিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের অধিকার থাকলেও গত দুই দশক তা ছিল স্বপ্ন। সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মাতৃভাষায় শিক্ষা লাখের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি জাতিসংঘেও স্বীকৃত। তার পরেও এতদিন দেশের আদিবাসীদের জন্য ছিল এটি কেবলই স্বপ্ন। তবে সে স্বপ্ন পূরণেই এবার এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এনসিটিবি জানিয়েছে, চার বছর আগে প্রাথমিক স্তরে পাঁচটি নৃগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের জন্য মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষা (এমএলই) বিষয়ক জাতীয় কমিটিও গঠন করেছিল সরকার। পুস্তক ছাপানোর প্রস্তুতির নানা ধাপ ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে এখন তা ছাপা হচ্ছে।
×