ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৫ দিন পরে খুলেছে গার্মেন্ট কারখানা;###;বিভিন্ন কারখানায় তিন শ’র বেশি শ্রমিক বরখাস্ত;###;১৪৭ ষড়যন্ত্রকারী চিহ্নিত

দলে দলে কাজে গেল ওরা

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬

দলে দলে কাজে গেল ওরা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ শ্রম অসন্তোষের মুখে বন্ধ হয়ে যাওয়া আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল এলাকার ৫৯টি পোশাক কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। কারখানা খুলে দেয়ার পর প্রথম দিনেই ৯০ শতাংশ শ্রমিক কাজে যোগ দিয়েছেন বলে দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকরা কাজে যোগ দেয়ায় শিল্পাঞ্চলে ফের ফিরে এসেছে কর্মচাঞ্চল্য। তবে, ফের যাতে কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও থাকে সর্বোচ্চ সর্তকাবস্থানে। আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে প্রতিটি কারখানার সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে রাখা হয়েছে। বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর মহাসড়কে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাবকে টহল দিতে দেখা গেছে। এদিকে, পোশাক কারখানা খুলে দেয়া এবং শ্রমিকরা কাজে ফিরে আসায় সোমবার সন্তোষ প্রকাশ করেছে মন্ত্রিসভা। এদিকে, সোমবার সকালে আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা দলবেঁধে কারখানায় প্রবেশ করেছে। কারখানায় প্রবেশের পর তারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের উৎপাদন কাজ শুরু করে। দুপুর পর্যন্ত কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। এছাড়াও বিভিন্ন কারখানার ছাটাইকৃত শ্রমিকরা কারখানার সামনে আসলেও তারা বাড়ি ফিরে গেছে। এ প্রসঙ্গে আশুলিয়া শিল্প পুলিশের পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র নির্দেশে সোমবার সকাল থেকে আশুলিয়ার সব পোশাক কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে শ্রমিকরা সকাল থেকে কাজে যোগ দিয়েছে। আশুলিয়ায় বেতন ভাতা বাড়ানোর দাবিতে অব্যাহত শ্রম অসন্তোষের মুখে গত ২০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ৫৯টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এর আগে গত ১১ ডিসেম্বর থেকে আশুলিয়া এলাকায় শ্রম অসন্তোষ শুরু হয়। চলমান এই অসন্তোষ নিরসনে স্থানীয় সাংসদ, মালিকপক্ষ, শ্রম মন্ত্রণালয় এবং বিজিএমইএ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তবে যেসব পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, সেসব কারখানার অনেকগুলোতে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে বলে শ্রমিকদের অভিযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তবে, কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, যেসব শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে তারা শ্রমিক বিক্ষোভে উস্কানি দিয়েছে। এরই মধ্যে শ্রমিক বিক্ষোভে উসকানি ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বিভিন্ন কারখানার সহস্রাধিক কর্মীর বিরুদ্ধে সাতটি মামলা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় ১৯ শ্রমিক নেতা ও এক সাংবাদিককে। তিনটি কারখানার প্রায় সাড়ে তিন শ’ শ্রমিককে সাময়িক বরখাস্ত করে ফটকে নোটিস ঝুলিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। এরপর বিজিএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান রবিবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এবং ৩০ শ্রমিক সংগঠনের অনুরোধে বন্ধ কারখানাগুলো সোমবার থেকে খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। ইতোমধ্যে ৯১ শ্রমিককে বরখাস্তের নোটিস কারখানার ফটকে টাঙিয়ে দিয়েছে হা-মীম গ্রুপ। তাদের আগে উইন্ডি এ্যাপারেলস ও ফাউন্টেন গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড ২৫৬ জন শ্রমিককে বরখাস্ত করে। এছাড়া ফাউন্টেন, এনআরএন, দ্য রোজ ড্রেসেস, উইন্ডি গ্রুপ, শারমিন গ্রুপ কারখানা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের পক্ষ থেকে দু’টি মামলা দায়ের হয়েছে। এ নিয়ে মোট নয়টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় ইতোমধ্যে সহস্রাধিক শ্রমিক, ৮ শ্রমিক নেতা, অভিনেতা, স্থানীয় সাংবাদিক ও সাভার উপজেলা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিনিসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জানা গেছে, আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল ঘিরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে সরকার। এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে ১৪৭ জনকে। যাদের বিরুদ্ধে আশুলিয়াকে অস্থিতিশীল করে তোলার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য প্রমাণও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে। এদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পথেই যাচ্ছে সরকার। উস্কানি দিয়ে কারণে-অকারণে নিরীহ শ্রমিকদের আন্দোলনে ইন্ধন যোগানো, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাতকে বাধাগ্রস্ত করা, আর বিশ্বের কাছে দেশের পোশাক শিল্পের বিষয়ে নেতিবাচক বার্তা দেয়াই এই স্বার্থান্বেষী গ্রুপটির লক্ষ্য। সে লক্ষ্যেই শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি করছে তারা। বেছে বেছে এমন ১৪৭ জনকে চিহ্নিত করেছে সরকারের একটি শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা। সাভার থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, সোমবার সকাল থেকেই দলবেঁধে আশুলিয়ার জামগড়া, বাইপাইল, নরসিংহপুরসহ সব কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে আসতে দেখা যায়। দীর্ঘ অর্ধমাস ধরে অলস হয়ে পড়ে থাকা মেশিনপত্রগুলোও ফিরে পায় প্রাণ। শ্রমিকদের হাতের স্পর্শে সচল হয়ে ওঠে এর চাকাগুলো। যে সকল কারখানা থেকে শ্রমিকদের বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের ছবিসহ তালিকা কারখানার প্রধান ফটকে টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই সকল শ্রমিকের অনেকে কাজে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে এলেও পরে ফিরে যায়। সাধারণ শ্রমিকরা জানান, এ ক’দিন তারা মারাত্মক দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন তাদের ভবিষ্যত নিয়ে। কি করবেন, কোথায় যাবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে দ্রুতই কারখানাগুলো খুলে দেয়ায় তাদের সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেছে। এদিকে, এদিন সকাল থেকেই ঢাকা জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করে বলা হয় যে, ছাঁটাইকৃত শ্রমিকরা যেন কারখানায় প্রবেশ করতে না পারে এবং কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে দিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যরা যেন নজর রাখেন। পোশাক শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত কাজে যোগদানের ব্যাপারে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার শাহ্ মিজান সাফিউর রহমান বলেন, পোশাক শ্রমিকরা আমাদেরই ভাই-বোন। তাদের ঘাম মিশ্রিত টাকাতেই তৈরি হচ্ছে আমাদের আধুনিক বাংলাদেশ। মানবাধিকার থেকে শুরু করে তাদের সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি শান্ত। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষের জের ধরে ৫৯টি কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয় বিজিএমইএ। এরই প্রেক্ষিতে আমরা শিল্প পুলিশ, জেলা পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মিলে একটি শক্তিশালী নিরাপত্তার ব্যবস্থা করি। ইতোমধ্যেই কারখানা কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশের পক্ষ থেকে ১০টি মামলা রেকর্ড হয়েছে। নাশকতার চেষ্টা করা, ইন্ধন যোগানকারী হিসেবে ২২জনকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া, অজ্ঞাতনামা আরও কয়েক শতাধিক শ্রমিকের নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিজিএমইএ যাদের আসামি করে মামলা দিয়েছে, তাদের ব্যাপারে তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে। উল্লেখ্য, ১১ডিসেম্বর থেকে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে সৃষ্ট শ্রমিক অসন্তোষকে কেন্দ্র করে ২০ ডিসেম্বর ৫৯টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় মালিকপক্ষ। পরের দিন আরও ৪টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শ্রমিক অসন্তোষে সৃষ্ট অচলাবস্থার কারনে প্রতিদিন গড়ে ৮০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয় দেশের সবচেয়ে বৃহৎ এ শিল্প। সে হিসেবে ১৫দিনে ১২শ’ কোটি টাকার মতো ক্ষতিসাধিত হয়েছে এ শিল্পে।
×