ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহীন রেজা নূর

বিএনপি বিষয়ক জটিলতা

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬

বিএনপি বিষয়ক জটিলতা

(শেষাংশ) তাদেরকে নিশ্চয় কেউই হিন্দু-বৌদ্ধ বা খ্রীস্টান মনে করত না। তেমনিভাবে, ব্রিটিশ ভারতে বাংলা ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। তখন বাংলাকে ‘মুসলিম বাংলা’ বানানোর কোন সস্তা কৌশল কারও মাথায় আসেনি। আর তা এ কারণেই আসেনি যে, এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য বিষয় ছিল। যদিও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষার পেছনে ভূভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোই এর স্রষ্টাদের মাথায় ছিল। কিন্তু তাই বলে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমিগুলো (লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী) কেবল ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ হবে এই বিধান কোথাও ছিল না। কিন্তু গোঁজামিলের মাধ্যমে শেষতক যে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি সেদিন অর্জিত হলো, তার সর্বাঙ্গে বিষ-কাঁটা লাগিয়ে দেবার নিরন্তর প্রয়াসই লক্ষ্য করা গেল পাকিস্তান আমলজুড়ে। এর পরিণতি যে ভাল হয় না তার প্রমাণ পেলাম আমরা শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতনের রকমফেরের মধ্যে। জিয়াউর রহমান পঁচাত্তরের পর ঐ কৃত্রিম অবাস্তব ও সস্তা-স্থূল রাজনীতির ধারাটিকে আমাদের জাতীয় জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন আইএসআইর প্ররোচনায়। ‘বাংলাদেশ বেতার’ ও ‘রেডিও বাংলাদেশ’ এই শব্দ দুটির মধ্যে অর্থগত ও ভাবগত কোন পার্থক্যই না থাকা সত্ত্বেও তিনি সাধারণ মানুষদের মনে অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে এই ধারণাই গেঁথে দিতে চাইলেন যে, ‘বেতার’ শব্দটিতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনমানসিকতার প্রতিফলন আছে, তাই তা পরিত্যজ্য আর ‘রেডিও’ শব্দটি আমাদের অঞ্চলের মুসলমান বাঙালীদের ভাব ও বুঝের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধায় সেটিই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। এর মধ্যে বাঙালী হিসেবে আমরা হিন্দু বাঙালীদের চাইতে আলাদা এই কথাটিও সূক্ষ্মভাবে বোঝানোর অপচেষ্টা যে নিহিত ছিল তা তো বলাই বাহুল্য! জিয়া ও তার চারিপাশে ঘুর ঘুর করা ব্যক্তিদের এই মানসিকতা যে শতকরা এক শ’ ভাগ পাকিস্তানবাদী মনোভাব তা বুঝতে নিশ্চয়ই প-িত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার ঘোষক ইত্যাদি শব্দের মোড়কে প্রচারিত জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসেই একাত্তরে যারা পাকিস্তান রক্ষার্থে মুক্তিকামী বাঙালীদের নিধনে মেতে উঠেছিল, বাংলার অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জত কেড়ে নিয়েছিল, বাংলার মায়েদের গর্ভে পাঞ্জাবী সেনাদের সন্তান জন্মানোর জঘন্য ও বর্বরোচিত আয়োজন করেছিল, সেই কুলাঙ্গারদের এক কলমের খোঁচায় বাঁচিয়ে দিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার মাত্র ৪ মাসের মাথায় দালাল আইনটি বাতিল করে দিলেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে ধর্মান্ধ রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন; সূক্ষ্মভাবে ভারতবিদ্বেষ আর পাকিস্তান-প্রীতি তার রাজনীতির মূল চেতনা হয়ে দেখা দিতে থাকল। শাসনযন্ত্রের সঙ্গে তিনি একে একে পাকিস্তানী মনোবৃত্তিসম্পন্ন বড় বড় চাঁইকে জুড়ে দিতে শুরু করলেন। তার বিরুদ্ধে অনেক ক্যু সংঘটিত হলে তিনি নির্বিচারে সামরিক বাহিনীর মধ্যকার মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা শুরু করলেন। মশিউর রহমান যাদু মিয়া, শাহ আজিজুর রহমান এমনকি গোলাম আযমের অনুসারীর মতো বাংলাদেশবিরোধীদের ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে এলেন ও দেশের রাজনীতিতে পুনঃপ্রবেশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিলেন। জনগণের চোখে পট্টি বেঁধে তাদের ধোঁকা দেয়ার জন্য গেঞ্জি গায়ে কোদাল হাতে খাল কাটা ‘বিপ্লব’ শুরু করলেন। জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে এই লোক দেখানো- ছেলে ভোলানো কর্মকা-কে জিয়ার তল্পিবাহকেরা হযরত ওমরের (রা) ‘মহত্ত্ব’ আরোপের চেষ্টা চালাল। তার শাসনামলে তাকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর চেষ্টা হলে তা ধোপে টিকত না এ কথাটি এই চতুর ব্যক্তিটির অজানা ছিল না। তাই তার আমলে সে চেষ্টা না হলেও তার পতœী বেগম খালেদা জিয়াকে পরবর্তীকালে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য তার পাকিস্তানী মেন্টররা ঠিকই জিয়াকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ অভিধায় অভিহিত করল জাতিকে আরেক দফা বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে। মুক্তিযুদ্ধে জেনারেল জিয়ার অবদানের বা কোন বীরোচিত ভূমিকার উল্লেখযোগ্য তথ্যই কিন্তু মেলে না। পাকিস্তানী সোয়াত জাহাজ থেকে (একাত্তরের মার্চে) বাঙালী নিধনের অস্ত্র খালাস করতে যাওয়া মেজর জিয়া ঘটনাচক্রে এবং নিতান্তই ভাগ্যগুণে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দেবার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কেমন উচ্চাভিলাষী ছিলেন তা বোঝা যাবে তার প্রথম ঘোষণায় নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি দাবির মধ্য দিয়ে। যা হোক, এসব বিষয়ে গভীর ধন্দ সৃষ্টি করে জিয়ার অনুসারীরা দেশে কত বিভ্রান্তিই না ছড়িয়েছে! কিন্তু সত্যকে ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয়নি। তাদের এইসব দাবিই আজ বুমেরাং হয়ে বিএনপি নামক দলটিকে ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করেছে। বিএনপির জন্ম বৃত্তান্ত ও তার চাল-চলন সর্বতোভাবে নীতি-আদর্শহীন আর মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশবিরোধী, বাংলাদেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতিবিরোধী এক ধরনের জগাখিচুড়ি বলেই প্রতিভাত হয়। জিয়ার মৃত্যুর পর তদীয় পতœী আর অতঃপর তাদের গুণধর পুত্র তারেক জিয়া দলটিকে আরও ছেড়াবেড়া করে ফেলেছেন আইএসআইএর প্রেসক্রিপশন হুবহু ফলো করতে গিয়ে। তাই এককালে দলের বিশাল নেতা বদরুদ্দোজা চৌধুরী গংরা প্রায়শই অভিযোগ করেন যে, জিয়ার আদর্শচ্যুতি তথা তার ১৮ দফা থেকে খালেদা-তারেকের বিচ্যুতিই আজ বিএনপির এই দৈন্যদশার জন্য দায়ী। কথাটির সত্যাসত্য নির্ধারণের দায় বিএনপির নেতাকর্মীদের। তবে দেশবাসী এখন বোঝে যে, জিয়ার গোটা রাজনীতি ও কর্মকা-ই ছিল পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারাটিকে পুনরায় এই দেশে প্রতিষ্ঠিত করা। তাই ভুয়া গণভোটের মাধ্যমে নিজেকে প্রেসিডেন্ট বানানো, ক্যান্টনমেন্টে বসে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের রাষ্ট্র-সমাজ-অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাদের হয়ে বিএনপি নামক একটি দলের গোড়াপত্তন করা, আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে একটি রাবারস্ট্যাম্প পার্লামেন্ট বানানো, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ইনডেমনিটির আওতায় আনা ইত্যাদি সকল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী উদ্যোগ গ্রহণ ও বাঙালী জাতিসত্তার সুষ্ঠু-স্বাভাবিক গতিধারাকে বিপর্যস্ত করে লাকি খান মার্কা সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের পৃষ্ঠপোষকতা করা। যুবশক্তিকে কেনাবেচার সামগ্রীতে পরিণত করা আর সবচেয়ে বড় কথা রাজনীতিকে আমলা-ফড়িয়া-ধড়িবাজ- ধোঁকাবাজদের হাতে তুলে দেয়া ছিল জিয়াউর রহমানের রাজনীতির উপজীব্য। এসবই তিনি করেছেন তার পাকিস্তানী প্রভুদের মনঃতুষ্টির জন্য। কেননা, তারাই তাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল। তার তিরোধানের পর বিএনপির রাজনীতিতে ঐ পাকিস্তানবাদী মনোবৃত্তি চর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়, আর এরই ফলে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার করে। সারাদেশ যেখানে একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকার নিন্দায় সোচ্চার, সেখানে বিএনপি নেত্রী ও তার অর্বাচীন পুত্র জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সাফাই গাইতে সদা উদগ্রীব। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এক কোটি ভুয়া ভোটার বানানো আর রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রশাসনের সবাইকে আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করা, অবরোধের নামে হিংসাশ্রয়ী তৎপরতা, পেট্রোল বোমা মেরে সাধারণ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে হত্যা বিএনপি রাজনীতির গণবিরোধী ও বাংলাদেশবিরোধী চরিত্রকেই মেলে ধরে মাত্র! তারেক সাম্প্রতিককালে ঘোষণা দিয়েছে যে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে নাকি উর্দু নামের কোন দলের অস্তিত্ব রাখবে না। বাংলা ভাষার পক্ষে সংগ্রামের দাবিদার আওয়ামী লীগ নিজের নামটি রেখেছে উর্দুতে। সুতরাং, তারেকের মতে, এই কারণেই তারা উর্দু নামের দল দেশে রাখবে না। অর্বাচীন তারেক জানেই না যে, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের কর্ণধার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস বা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস নামগুলো কোন ভারতীয় ভাষা থেকে উৎসারিত নয়। আর তাছাড়া আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের আগে। এই ধরনের হীন ও দুর্বল যুক্তি খাড়া করে তারেক ৬৭ বছরের সংগ্রামী দল আওয়ামী লীগের মূলোৎপাটন করতে চায় এর চাইতে বেকুবি বা আহাম্মকি আর কী হতে পারে! লন্ডনে শান শওকতের সঙ্গে বিলাসী জীবন-যাপনকারী তারেক ও তার পরিবারকে জিয়াউর রহমানের ছেঁড়াগেঞ্জি আর ভাঙা স্যুটকেসের ভেতর থেকে এত বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক বনে যেতে দেখলাম আমরা। দুর্নীতির শিরোমণি তারেক গং যখন দেশবাসীকে হেদায়েত করার ধৃষ্টতা দেখায়, তখন তা দেখে জাতি মুখ টিপে হাসে নিশ্চয়ই! বিএনপির আইএসআই ও মোসাদ কানেকশন আজ সর্বজনবিদিত। তাদের ভারতবিদ্বেষ আর ভারতবিরোধী জঙ্গীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দানের নীতি-কৌশল আজ সব ফাঁস হয়ে গেছে। বেগম জিয়া ও তারেক কেন জামায়াত ও অন্য জঙ্গীবাদীদের সংশ্রব ত্যাগ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারায় রাজনীতি করতে অক্ষম তাও কমবেশি এখন সকলেই বোঝে বৈকি! যারা তাদেরকে সৃষ্টি করেছে এবং যাবতীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বিত্তবান ও ক্ষমতাবান বানিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে (আইএসআই ও অন্যান্য) অবস্থান নিতে গেলে নিজেদেরই অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে একথা তারা জানে আর জানে বলেই তাদের পাকিস্তানবাদী রাজনীতির তাঁবেদারি করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। নিজেদের হাজার একটা ভুলের কারণে এবং তাদের পাকিস্তানবাদী বদখত চেহারাটি জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়ে যাওয়ায় এখন বড়ই বিপাকে পড়ে গেছে বিএনপি। এর থেকে বেরুবার জন্য নানান কূটকৌশল অবলম্বন করছে তারা আজ, দেশে-বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে দীর্ঘদিন যাবত ক্ষমতার কেন্দ্রে ছলে-বলে-কৌশলে ফিরে আসতে বেপরোয়াভাবে কাজ করে যাচ্ছে তারা। এরই সর্বশেষ কৌশল তাদের ইসি নিয়ে নতুন ধূম্রজাল সৃষ্টির পাঁয়তারার মধ্যে নিহিত রয়েছে। বেগম জিয়া সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ইসি গঠনের ব্যাপারে যে সকল প্রস্তাবনা রেখেছেন তাতে তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা স্পষ্ট আর জামায়াতকে সঙ্গে রাখার বাহানার মধ্য দিয়ে তাদের অন্য উদ্দেশ্যটিও এতে দিবালোকের মতোই পরিষ্কার। বিএনপি যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারায় তার রাজনীতিকে প্রতিস্থাপিত করার প্রয়াস গ্রহণ না করে ঐ পাকিস্তানবাদী চেতনার পুনঃপ্রবর্তনে তৎপর থাকে, তাহলে এর ভবিষ্যত ধরার ধুলায় বিলীন হয়ে গেলে বিস্ময়ের কিছুই রইবে না নিশ্চয়ই! এখনও তাই সময় আছে, বিএনপির মাঝে সত্যিকারের দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার ও মূল স্রোতধারায় ফিরে আসার।
×