ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কামরুল আলম খান খসরু

অপারেশন রূপসী শীতলক্ষ্যায় পাকিসৈন্যের টহলবোট ধ্বংস

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬

অপারেশন রূপসী  শীতলক্ষ্যায় পাকিসৈন্যের  টহলবোট ধ্বংস

(গতকালের পর) ডেমরা-নরসিংদী রোডের পূর্ব পাশে শাদীপুর গ্রামে আমরা মূল ক্যাম্প স্থাপন করি। কিছু অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ রাখার জন্য আমরা রূপসী বাজারের পাশে শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের অর্ধ-নির্মিত ফ্যাক্টরি ব্যবহার করি। পরবর্তীকালে রূপসীসহ আমরা আরও কিছু ক্যাম্প বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করা যাতে পাকিস্তানী আর্মিরা হামলা করে আমাদের সব অস্ত্রশস্ত্র দখল করতে না পারে বা সবাই যাতে একসঙ্গে ধরা বা মারা না পড়ি। রূপসী, বরপা, তারাবো ও শাদীপুরে আমার ক্যাম্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। সে বছর বর্ষাকালে এ অঞ্চলগুলো বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। মাইলের পর মাইল চারদিকে পানি আর পানি। পথের দু’পাশে পানিতে থৈ থৈ। প্রবল বর্ষণ ও বন্যার কারণে সব এলাকার বিশাল অংশ তখন পানিতে প্লাবিত হয়ে ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময়ের বর্ষাকালের বিস্তৃত জলরাশির এ রূপকে মনে হয়েছিল ঠিক যেন ভাসমান সাগর। তবে যুদ্ধকালীন সময়ে বর্ষার এ অতিরিক্ত পানি আমাদের বিভিন্ন স্থানে চলাফেরা করাকে সহজ করেছিল, কারণ পাকিস্তানী সৈন্যরা সাঁতার জানত না। তাই বর্ষার পানি আমাদের জন্য উদ্বৃত্ত হিসেবে কাজ করেছে। মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পাওয়ার মতো। আমার কাছে খবর আসে যে রূপসী এলাকায় মোতালেব খান নামে এক বিত্তবান লোক বাস করেন। যিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষের লোক। যেহেতু আমি গ্রুপ কমান্ডার তাই ভাবলাম ঘাঁটি সম্প্রসারণে এবং আমার ও সহযোদ্ধাদের ভরণপোষণে তার সাহায্য নিলে মন্দ হবে না। একদিন খুব সকালে আমরা খান সাহেবের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই। প্রবল বর্ষার কারণে নদীর দু’কূল প্লাবিত ছিল। রূপসীর পাশে ছিল বিশাল এক বিল। বিল পানিতে থৈ থৈ করছিল। বর্ষাকালে আমি নৌকায় চড়ে একাকী কিংবা সহযোদ্ধাদের নিয়ে রেকি করতাম। উদ্দেশ্য নৌপথ নিরাপদ রাখা যাতে আমার সহযোদ্ধারা নিরাপদে নদী পার হয়ে ঢাকার বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে হামলা চালাতে পারে। ঢাকায় যাওয়া আসার সময় আমি একেক সময় একেক রুট ব্যবহার করতাম। তাছাড়া নিজেদের ক্যাম্প নিরাপদ রাখা এবং নতুন নতুন পথে পাকিস্তানীদের ওপর হামলা চালানোর জন্যেও রেকি করতাম। ৭ সেটেম্বর, ১৯৭১ সকাল বেলা। সেদিনও প্রাত্যহিক কর্মপ্রক্রিয়ার নিয়মে পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে রেকি করতে এবং খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করার উপলক্ষে আমি একাই শাদীপুর ঘাঁটির ক্যাম্প থেকে বের হই। সঙ্গে ছিল আমার অতি প্রিয় এলএমজি (লাইট মেশিন গান) এবং চার ম্যাগজিন গুলি। প্রত্যেক ম্যাগজিনে ৭.৬২ (৭.৬২ সস) ২৮টি করে গুলি ভরা ছিল। এ চারটি ম্যাগাজিন আমার কোমরের বেল্টের সঙ্গে বাঁধা থাকত। কোমরে ম্যাগজিন রাখার জন্য আমি ফুটবল খেলার নিক্যাপের মাঝে খাপ বানিয়ে একটি বিশেষ কৌশলের মাধ্যমে ম্যাগাজিনগুলোকে কোমরে বেল্টের সঙ্গে আটকানো খাপে ঝুলিয়ে রাখতাম। কোমরবন্ধে রাখা ম্যাগাজিন দ্রুত বের করে এলএমজিতে লোড করতে আমার জন্য বিশেষ সুবিধা হতো এবং আমার কোমরের পেছন দিকে বেল্টে দুটি এইচ ই ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড ডেটোনেটরসহ (ঐ ঊ ৩৬ ঐধহফ এৎবহধফব রিঃয উবঃড়হধঃড়ৎ) ঝুলিয়ে রাখতাম। ক্যাম্প ত্যাগ করার আগে আমি আমার সহযোদ্ধাদের বলে আসি, যদি তোমরা অনবরত ব্রাশ ফায়ারের আওয়াজ শোন তবে বুঝবে তা আমার আর্মসের শব্দ এবং আমি শত্রুদের আক্রমণ করেছি। তোমরা প্রস্তুতি নিয়ে থাকবে। আমি লোক পাঠাবো কী করতে হবে জানিয়ে। এ কথা বলে আমি শাদীপুর ক্যাম্প থেকে বের হয়ে একটি ছইঅলা নৌকায় চড়ে বসি আর আমার এলএমজি ও গুলি ভরা ম্যাগজিনগুলো এবং গ্রেনেড দুটি পায়ের নিচে কাঠের পাটাতনের নিম্নাংশে রাখি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নদী পথে চলাচল করার জন্য আমি তিন ধরনের নৌকা ব্যবহার করতাম। তার মধ্যে একটি হলো ছইঅলা নৌকা, একটি ছিপ নৌকা এবং অন্যটি কোষা নৌকা। তিনটি নৌকাই ছিল আমার কেনা, আমি প্রয়োজন বুঝে একেক সময় একেক নৌকা নিয়ে বের হতাম। সেদিন বের হয়েছিলাম একা ছইঅলা নৌকা নিয়ে তবে আমার সঙ্গে ছিল একজন মাঝি। সাধারণত আমি কখনও ছইঅলা নৌকা নিয়ে একাকী বের হতাম না। নৌকায় আমার সঙ্গে কোন না কোন সহযোদ্ধা থাকত। এমনকি কখনও কখনও আমার দলের নারী যোদ্ধারাও থাকত। লুৎফা হাসান রোজি (বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছেন), মমতাজ বেগম (নিউক্লিয়াসের নারী ব্রিগেডের সংগঠক ও স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিব বাহিনীর নারী কমান্ডার; ১৯৯৬ সালের ৯ জুন মমতাজ বেগম চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন), ড. নাজমা শাহীন বেবী (বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক)সহ আরও অনেকে এবং তারা অস্ত্র চালনায়ও খুব দক্ষ ছিল। ছইওয়ালা নৌকায় মেয়েরা থাকার কারণে শাড়ি দিয়ে সবসময় নৌকার মুখ ঢাকা থাকত। দূর থেকে দেখেই বোঝা যেত এ নৌকায় নারী আরোহী আছে এবং তারা পর্দা করছেন। পর্দা করার গ্রামীণ এ পদ্ধতি আমরা যুদ্ধের সময় কৌশল হিসেবে কাজে লাগাই। আমার নৌকার মাঝির নাম সুনীল। বয়স আনুমানিক ১৭ বা ১৮ বছর। সুনীল ছিল খুবই বিশ্বস্ত এবং একজন দক্ষ নৌকা চালক। মোতালেব খান সাহেবের বাড়ি যেতে হলে আমাদের একটি ছোট ব্রিজের নিচ দিয়ে যেতে হবে। ডেমরা-নরসংদী রোডের ওপর ব্রিজটির অবস্থান। ব্রিজের দু’পারে বিল এলাকা। এ ব্রিজটি পার হওয়ার সময় আমি প্রথম বাধাটি অতিক্রম করি। অবশ্য পথে কী কী বিপদ হতে পারে সেসব বিষয় মাথায় রেখেই আমি চলাচল করতাম। বিপদ দেখলে আমার ভেতর আপনা-আপনিই কিছু বিশেষ ধরনের গুণ কাজ করত। কোন বাধা এলেই আমার ভেতর জেগে উঠতো এক বিস্ময়কর শক্তি ও মনোবল। তাই আমি যখন যে বিপদে পড়েছি, তা থেকে রক্ষা পেয়েছি কখনও দৈবক্রমে আবার কখনও উপস্থিত বুদ্ধির জোরে। সেদিন আমি এমনই এক বিপদ থেকে রক্ষা পাই সম্পূর্ণ তাৎক্ষণিক প্রয়োগকৃত বুদ্ধির মাধ্যমে। মাঝি নৌকা চালাচ্ছিল আর আমি ছইয়ের ভেতর থেকে কাপড় সরিয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে বিলের চারদিক পর্যবেক্ষণ করছিলাম। তখন হঠাৎ মাঝি ফিস ফিস করে বলল, ‘স্যার, স্যার একটা জিপ গাড়ি তারাবো ঘাটের দিকে যাচ্ছে!’ আমি কাপড় (শাড়ি) ফাঁক করে দেখতে পেলাম দূর থেকে খুব স্পিডে একটি জিপ আসছে এবং তারা আমার নৌকাটিকে লক্ষ্য করছে। পিচ ঢালা রাস্তার দু’পাশ সম্পূর্ণ ফাঁকা ছিল। রাস্তা এতটাই প্রশস্ত ছিল যে, সে রাস্তায় দুটি গাড়ি অনায়াসে চলাচল করতে পারত। দূর থেকে যদিও খুব একটা স্পষ্ট দেখাও যাচ্ছিল না তবুও আমি বুঝতে পারলাম জীপ গাড়িতে পাঁচ থেকে ছয় জন পাকিস্তানী সৈন্য পজিশন নিয়ে বসে আছে, তাদের সবার হাতে অস্ত্র। তারা সামনের দিকে মেশিনগান তাক করে রেখেছে আর তাদের লক্ষ্যবস্তু আমার নৌকা। আমার নৌকা তখন স্রোতের বিপরীত দিকে চলছিল। আমি চিন্তা করলাম নৌকাটি যদি ঘুরিয়ে নেই তাহলে তারা সন্দেহ করবে এবং ব্রাশ ফায়ার করবে, আবার ব্রিজের কাছে গেলেও তো নৌকা নিশ্চিত থামাবেই। বুঝতে পারলাম, আমি উভয় সঙ্কটে পড়েছি। জলে নামলে কুমিরে খাবে আর ডাঙ্গায় উঠলে বাঘ। ওই মুহূর্তে আমি যা-ই করি না কেন, মৃত্যু আমার অবধারিত। চলবে... লেখক : গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা
×