ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পৌষেও এবার হেমন্তের শীত

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৬

পৌষেও এবার হেমন্তের শীত

সমুদ্র হক ॥ এবারের শীত মৌসুম একেবারে ভিন্ন এবং বিচিত্র। আগের বছরের মতো নয়। পৌষ মাসেও শীত বোঝা যাচ্ছে না। পৌষের শীত পৌষের কথা কইছে না। এই সময়টায় সাধারণত রাতে গায়ে লেপ চড়িয়ে থাকতে হতো। বর্তমানে কাঁথা-কম্বলেই চলে। তার মধ্যেও গভীর রাতে অনেক সময় কম্বল ফেলে দিতে হয় হঠাৎ গরম পড়ায়। তবে প্রতি বাড়িতে লেপ বের করে রাখা হয়েছে। ঢাকায় কংক্রিটের রাজত্বে পৌষের শীত এখনও ছুঁতে পারেনি। বাসা বাড়িতে কাঁথায় খুব বেশি হলে কম্বলেই শীত পাড়ি হচ্ছে। আবহাওয়া বিভাগ শীতের আগে জানিয়েছিল কয়েকটি শৈত্যপ্রবাহ আসবে। সেই আলামত এখনও ফুটে ওঠেনি। অবশ্য ইংরেজী নতুন বর্ষের প্রথম মাসে (জানুয়ারি) কতটা শীত নামে তা দেখার বিষয়। হতে পারে শৈত্যপ্রবাহ। শীত বলতে হিমালয় পাদদেশীয় উত্তরাঞ্চল বড় মডেল হয়ে আছে। সেই উত্তরাঞ্চলের সর্ব উত্তরের জেলাগুলোতে নবেম্বর মাসের শুরুতে প্রকৃতি শীতের যে আগমনী বারতা দিয়েছিল তা পৌষ মাসে আর ঠিক নেই। পৌষ মাসকেই মনে হচ্ছে হেমন্তকাল। পরিবর্তন শুধু দিনের। দিনগুলো ছোট হয়ে থাকছে। রাত বড়। ছোট দিনের সময়ও শেষ হয়ে গিয়েছে। দিনে দিনে দীর্ঘ সময়ের দিকে একটু করে এগোচ্ছে। এই সময়টায় যখন শীত একেবারে জেঁকে বসার কথা তা বসছে না। সকলেরই প্রশ্ন তাহলে শীত মৌসুমের হলোটা কি। এই বিষয়ে আবহাওয়াবিদদের কথা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে শীতের ওপর। কেমন করে এই জলবায়ুর প্রভাব পড়ছে এই বিষয়ে যে বক্তব্য মেলে তা উপরিভাগের কথা। গভীরের কোন কথা নেই। বর্তমানে আবহাওয়া বিভাগ এখন বিশ্বায়নের মধ্যে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসার বিজ্ঞানীরা স্যাটেলাইটে তথ্য উপাত্ত নিয়ে যে কথা বলবেন অন্যান্য দেশের আকাশ বিজ্ঞানীরা কমবেশি তাই বলেন। একজন জলবায়ু বিশেষজ্ঞের কথা- এশীয় অঞ্চলে ধুলোমেঘের কারণে সূর্যের আলো সহজে মাটিতে নামতে পারছে না। সেই হিসেবে শীত তো বেশি হওয়ার কথা! তাহলে শীত কম কেন! এর উত্তর বিশ্ব উষ্ণায়নের পথে যাচ্ছে। কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, জলীয় বাষ্প ইত্যাদি গ্যাস বাতাসে জমা হয়ে সূর্যতাপকে ধরে রাখছে। এভাবে গ্রীন হাউস এফেক্টের মতো ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বায়ুম-ল। ফলে গলে যাচ্ছে জমাটবাঁধা বরফ। অস্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছে জলবাযুর গতি প্রকৃতির। ডেকে আনছে এক মারাত্মক বিপর্যয়। যে সব গ্যাসের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি তার মধ্যে কার্বনডাই অক্সাইড ও মিথেন মানুষের সৃষ্টি। বলা যায়, মানুষই ঋতুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন ডেকে আনছে। যান্ত্রিক সভ্যতার চাকা সচল রাখতে ফসলি জ্বালানি পুড়িয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত বায়ুম-লে কার্বন ডাই অক্সাইড জমা করছে। এরপর মিথেন। এর নির্গমনমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গোটা বিশ্বের জলবায়ুর প্যাটার্ন পাল্টে গিয়েছে। বাংলদেশেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। একই সঙ্গে পৃথিবীর বায়ুম-ল ভেজা ও ময়লাযুক্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বেড়ে ২ থেকে ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসে ঠেকেছে। আরও বাড়বে। ফলে বাতাস বেশি উত্তপ্ত হচ্ছে। আর গরম বাতাস বেশি জলীয় বাষ্প ধারণ করতে পারে। যে কারণে বায়ুম-লে আর্দ্রতা বেড়ে যাচ্ছে। আরেকদিকে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতও তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ সম্পর্কে বিশ্বকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলগোর। গোরের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছে ইন্টার গবর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে গ্রীষ্ম বর্ষা শীত বসন্ত ঋতুগুলোর ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। তা যে পরিবর্তিত হচ্ছে তার প্রমাণ মিলছে প্রায় সকল দেশেই। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পরিবর্তন বেশ ভালভাবেই চোখে পড়ছে। একজন আবহাওয়াবিদ জানান, দেশের আবহাওয়া ক্রমেই বৈরী আচরণ শুরু করেছে। আগে অনেকটা বিরতি দিয়ে অতি শীত অতি গ্রীষ্ম অতি বর্ষা আসত। এখন তা উল্টে গিয়েছে। ভবিষ্যতে যে আবহাওয়া আরও পাল্টে যাবে এবং বৈরী হবে তার প্রমাণ এবারের শীতকাল। ঢাকা মহানগরীতে জলাশয় কম থাকা কংক্রিটের বন ও পাকা সড়কের কারণে তাপমাত্রা এমনিতেই ২/৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়তি হয়। ফলে দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে ঢাকার শীত কিছুটা কম অনুভূত হয়। শীতকালীন তাপমাত্রা নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন একজন অধ্যাপক বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে শীতকালের ব্যাপ্তি কমেছে। আগে বছরে তিন থেকে সাড়ে তিন মাস শীত থাকত। বর্তমানে তা কমে যে দুই মাস থাকে তার মধ্যেই গরম চলে আসে। তবে শৈত্যপ্রবাহ আসে একটা নির্দিষ্ট সময়ে। তারও ব্যাপ্তি কমেছে। তার মতে জলবায়ুর বিষয়টি দিনে দিনে আরও জটিল হয়ে উঠেছে। এর মধ্যেই দেশ শীতকাল অতিবাহিত করছে। এবারের শীতে যে হারে শীতের পোশাক পরে দেখানোর কথা তা নেই। দেশের প্রতিটি জেলা শহরের কমবেশি একই চিত্র। গ্রামে যে খুব শীত তাও নয়। গোধূলীর পর কুয়াশা জানান দেয় শীত পড়বে। তা আর থাকে না। হিমেল হাওয়া তেমন নেই। এবারের শীত বুঝি এভাবেই কেটে যায়। জলবাযুর পরিবর্তনের থাবা এভাবেই আসছে।
×