মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে ॥ উত্তরাঞ্চলের মানুষের তথ্যপ্রযুক্তির স্বপ্ন এবার বাস্তবায়ন হতে চলেছে বিভাগীয় শহর ও শিক্ষানগরী খ্যাত রাজশাহীতে। এখন শুধু অপেক্ষা বরেন্দ্র সিলিকন সিটি বাস্তবায়নের। অন্তত ১৪ হাজার তরুণ-তরুণীর প্রযুক্তিনির্ভর কর্মস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে আগামী বছরের শুরু থেকে অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
রাজশাহী মহানগরীতে ৩১ একর জমির ওপর ২শ’ ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হচ্ছে ‘বরেন্দ্র সিলিকন সিটি’। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির আদলে তৈরি করা হবে এ বরেন্দ্র সিলিকন সিটি। মহানগরীর রাজপাড়া থানার বুলনপুর এলাকায় গড়ে তোলা প্রযুক্তি কেন্দ্র হবে দেশের প্রথম সিলিকন সিটি। এরই মধ্যে জমি অধিগ্রহণও সম্পন্ন হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২১ সালের মধ্যে আইটি খাতে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিত করতে সরকার নানান পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, এর মধ্যে শুরুতেই বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে এ বরেন্দ্র সিলিকন সিটি প্রকল্প। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় বরেন্দ্র সিলিকন সিটির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। একনেক সভায় রাজশাহীতে ‘বরেন্দ্র সিলিকন সিটি’ প্রকল্পটি উত্থাপিত হলে তা নীতিগত অনুমোদন পায়। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩৮ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো ও সানহোসে শহরের মাঝামাঝিতে ৩০০ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা সিলিকন ভ্যালি ইন্টারনেট সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বিশ্বব্যাপী। গুগল, ফেসবুক, ইয়াহু, এ্যাপল, ইনটেল, এএমডি, এইচপি, ওরাকল, এ্যাডবির মতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যালয় এ সিলিকন ভ্যালিতেই। এছাড়াও রয়েছে তুলনামূলকভাবে ছোট কয়েক শ’ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রের সেই সিলিকন ভ্যালির আদলেই রাজশাহীতে গড়ে তোলা হবে বরেন্দ্র সিলিকন সিটি।
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও মহানগরের সভাপতি এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন জানান, বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে তথ্যপ্রযুক্তি অনেকাংশে এগিয়ে গেছে। আমরা প্রত্যাশা করি, বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তথ্যপ্রযুক্তি সেবা ফেসবুক, গুগল, হোয়াটস এ্যাপের মতো প্রতিষ্ঠান বা সেবা রাজশাহীতে তৈরি হবে। তৈরি হবে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ বিপুল জনশক্তি।
তিনি জানান, ২০১২-১৩ অর্থবছরে রাজশাহীতে প্রথম ‘হাইটেক পার্ক’ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। পরবর্তিতে যার নাম দেয়া হয় ‘বরেন্দ্র সিলিকন সিটি’। সর্বশেষ একনেকে এ প্রকল্প অনুমোদন হওয়ায় রাজশাহী তথা এ অঞ্চলের মানুষের তথ্যপ্রযুক্তির স্বপ্ন এবার বাস্তবায়ন হতে চলেছে। এজন্য রাজশাহীর মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে বলেও জানান তিনি।
খায়রুজ্জামান লিটন আরও বলেন, বরেন্দ্র সিলিকন সিটি বাস্তবায়ন করতে আরও একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য একনেকের সভায় অনুমোদন পেয়েছে। সেটি হলো পদ্মার তীর রক্ষা প্রকল্প। ২৬৮ কোটি টাকার প্রকল্পও একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়। ইতোমধ্যে এর ট্রেন্ডারও হয়ে গেছে। কারণ বরেন্দ্র সিলিকন সিটির কাজ করার পাশাপাশি পদ্মার তীর রক্ষা প্রকল্পেও কাজ করতে হবে বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজশাহীতে প্রস্তাবিত দেশের প্রথম সিলিকন সিটিতে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য চারতলা ভবন নির্মাণ ও প্রশিক্ষণের জন্য দশতলা টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। বরেন্দ্র সিলিকন সিটি নির্মাণ শেষ হলে ১৪ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, বরেন্দ্র সিলিকন সিটির অবকাঠামো নির্মাণে অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক বাউন্ডারি ওয়াল, স্ট্রিটলাইট, পানি ও স্যুয়ারেজ লাইন ও ৬০ হাজার বর্গফুটের চারতলা ভবন নির্মাণে অর্থায়ন করবে। বাকি কাজ সরকারী অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত কার্যক্রমের মধ্যে সিলিকন সিটির জন্য সহায়ক উপযুক্ত পরিবেশ রাজশাহী শহরে রয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য রাজশাহীবাসীও অপেক্ষায় রয়েছে। হাইটেক পার্ক স্থাপন হলে এ অঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে এবং সেই সঙ্গে বহির্বিশ্বসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনসাধারণ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সহিত সুদৃঢ় বন্ধন গড়ে উঠবে।
সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ জানিয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিকাশে জেলায় জেলায় আইসিটি পার্ক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি জেলায় আইসিটি পার্ক নির্মাণ কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে। তথ্যপ্রযুক্তি সেবার মান বাড়ানোর ওপর সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। এরই মধ্যে আইসিটি খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশ পুরোপুরি আইসিটিনির্ভর হিসেবে গড়ে উঠবে। সারাদেশে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে।
সম্প্রতি রাজশাহীতে এসে তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানিয়েছিলেন, সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকারাবদ্ধ। প্রযুক্তিবান্ধব এ সরকার তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। রাজশাহীতে বরেন্দ্র সিলিকন সিটির নির্মাণ কাজ শীঘ্রই শুরুর ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, সিলিকন সিটির প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য চারতলা ভবন ও প্রশিক্ষণের জন্য দশতলা টাওয়ার নির্মাণ করা হবে।
জানা গেছে, দেশের সাইবার প্রতিরক্ষা, ডাটা সেন্টার, কল সেন্টার এবং আউটসোর্সিংÑ এ চারটি বিষয়ে সহযোগিতার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়ে ইতোমধ্যেই একটি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৬ আসনের সাংসদ শাহরিয়ার আলম বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার জন্য সময়োপযোগী নানান উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের অব্যাহত কর্ম প্রচেষ্টায় ডিজিটাল বাংলাদেশের বিনির্মাণ এখন আর কোন স্বপ্ন নয়, একের পর এক সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ আর তার বাস্তবায়নে নিরলস কর্ম প্রচেষ্টায় প্রতিনিয়ত তা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। বরেন্দ্র সিলিকন সিটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিতে আরও এগিয়ে যাবে দেশ। কর্মস্থান হবে হাজারও মানুষের।