ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জলজ সম্পদ কাঁকড়া রফতানিতে নতুন দিগন্ত

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬

জলজ সম্পদ কাঁকড়া  রফতানিতে নতুন দিগন্ত

শংকর লাল দাশ ॥ কাঁকড়া, শক্ত খোলকবিশিষ্ট জলচর অমেরুদ-ী প্রাণী। এক সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের অভাবী লোকজন মাছের বিকল্প হিসেবে খেত। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। কাঁকড়া দেশের গ-ি ছাড়িয়ে পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে অভিজাতদের খাবার টেবিলে জায়গা করে নিয়েছে। যার ফলে এ প্রাণীটি দেশের মৎস্য সম্পদ সম্পর্কিত রফতানি তালিকার প্রায় শীর্ষে উঠে এসেছে। চিংড়ির পরেই এর অবস্থান। দিন দিন বাড়ছে কাঁকড়া চাষের পরিধি। বাড়ছে কর্মসংস্থান। বাড়ছে পুঁজির ব্যবহার। হয়েছে প্রকল্প। যার সফল বাস্তবায়ন হলে এ খাতটিও ভবিষ্যতে হবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের আরেকটি ক্ষেত্র। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে- দেশের জলভাগে ১৬ প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। উপকূলের লবণাক্ত পানিতে রয়েছে ১১ প্রজাতির কাঁকড়া। এগুলোর মধ্যে খাদ্য তালিকার শীর্ষে জায়গা করে নিয়েছে শীলা কাঁকড়া। এটির চাষও সহজসাধ্য এবং দ্রুত বর্ধনশীল। বাণিজ্যিকভাবে ফ্যাটেনিংযোগ্য। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে শীলা কাঁকড়ার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চলে তিন লাখেরও বেশি মানুষ বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষ ও আহরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত রয়েছে। বিপণনসহ অন্যান্য কার্যক্রমেও জড়িত রয়েছে অন্তত এক লাখ মানুষ। এর মধ্যে কেবল সুন্দরবন ঘিরে ৬০-৭০ হাজার মানুষ কাঁকড়া চাষ করছে। বাংলাদেশের উপকূলের লোনা পানিতে উৎপাদিত কাঁকড়া রফতানি হচ্ছে এশিয়ার চীন, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, হংকং এবং আমেরিকা ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এসব দেশে ১৬৯ দশমিক ৪৯ কোটি টাকা মূল্যের ৭৪২৮ মেট্রিক টন কাঁকড়া রফতানি হয়। পরের অর্থবছরে রফতানি হয় ১৬৪ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা মূল্যের ৭ হাজার ৭০৭ মেট্রিক টন কাঁকড়া। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কাঁকড়া রফতানি হয়েছে ১০ হাজার ৭৭৬ মেট্রিক টন। যার মূল্য ২শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। মৎস্য সম্পদ রফতানি তালিকার শীর্ষে রয়েছে চিংড়ি। এর পরেই রফতানি তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে কাঁকড়া। কাঁকড়া চাষ লাভজনক হওয়ায় দিন দিন এ খাতের সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহীদের সংখ্যা বাড়ছে। কাঁকড়া চাষ করে এরই মধ্যে হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য বদলে গেছে। কাঁকড়া চাষ পদ্ধতিও অনেক সহজ। সমুদ্র কিংবা নদীর লোনা পানি থেকে প্রথমে এর বাচ্চা আহরণ করা হয়। পরে ফ্যাটেনিং বা মোটাতাজা করা হয়। মাত্র দুই থেকে তিন মাসেই কাঁকড়া চাষ সম্পন্ন হয়। মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের উপকূল ঘেঁষা কয়েকটি এলাকায় সারা বছর কাঁকড়া চাষ হলেও শীত মৌসুমে মাদি কাঁকড়ার চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। চাষীরা এগুলো দু’ভাবে মোটাতাজা করে। চিংড়িঘেরে পেন তৈরি করে যেমন কাঁকড়া মোটাতাজা করা হয়। আবার বাক্স বা খাঁচায় আবদ্ধ রেখে খাবার দিয়েও মোটাতাজা করা হয়। পুকুর বা বদ্ধ খালেও অনেকে মোটাতাজা করে। মাত্র আড়াই তিন মাসে পুরুষ কাঁকড়া কম-বেশি পাঁচ শ’ গ্রাম এবং স্ত্রী কাঁকড়া প্রায় ২শ’ গ্রাম ওজনে পরিণত হয়। পরিপুষ্ট এ কাঁকড়া চাষীরা পাইকার-মহাজনদের কাছে ৮শ’ থেকে হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করে। মহাজনরা রফতানিকারকদের কাছে বিক্রি করে। দেশ থেকে জীবন্ত এবং প্রক্রিয়াজাত অর্থাৎ হিমায়িত দু’ভাবেই কাঁকড়া রফতানি হয়। খুলনা, পটুয়াখালী, কক্সবাজারসহ উপকূলীয় অঞ্চলে এক সময়ের জমজমাট লবণ পানির চিংড়ি ঘেরেই এখন কাঁকড়া মোটাতাজা করা হচ্ছে। এসব ঘেরে নদীর সরকার ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত এলাকায় কুচিয়া ও কাঁকড়ার চাষ এবং গবেষণা’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। মৎস্য অধিদফতরের মাধ্যমে দেশের উপকূলীয় ২৭টি উপজেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। কর্তৃপক্ষ আশা করছেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দেশের উপকূলীয় এলাকায় কাঁকড়া চাষ আরও জনপ্রিয় হবে এবং আরও সম্প্রসারণ হবে। চাষীরা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হবে। জলজ পরিবেশের ইকোসিস্টেমের উন্নয়ন হবে। কাঁকড়া রফতানির মাধ্যমে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে।
×