ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খাজুরার গুড়ের বাজার

যশোরের গ্রামে রস আর পাটালির ম ম গন্ধ...

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬

যশোরের গ্রামে রস  আর পাটালির  ম ম গন্ধ...

সাজেদ রহমান ॥ যশোরের বিভিন্ন গ্রামে এখন চলছে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের মৌসুম। পুরুষ মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠেই মাঠে ছোটেন খেজুর গাছ থেকে রসের ভাড় নামাতে। আর মহিলারা সেই রস জ্বাল দিয়ে তা থেকে তৈরি করেন নানা ধরনের পাটালি ও গুড়। তা ছাড়া পিঠা পায়েস তৈরি হয় খেজুরের রস দিয়ে। যশোরের খেজুরের গুড়ের জন্য বিখ্যাত বাঘারপাড়ার খাজুরা এলাকার মহিলারা এখন বেশ ব্যস্ত । যশোর থেকে প্রায় ১৪/১৫ কিলোমিটার দূরবর্তী যশোর-মাগুরা সড়কে খাজুরা বাজার। এই খাজুরার পাটালি এবং গুড় সারা দেশে নামকরা। এলাকাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা বলেন, খেজুরের কারণে এখানকার নাম হয়েছে খাজুরা। আর খেজুরের গুড়ের বাজার বসার কারণে এখানকার নাম হয়েছে খাজুরা বাজার। তবে খাজুরা নামে কোন মৌজা নেই। খাজুরা বাজারের পোস্ট অফিসের নাম গৌরিনগর। আর খাজুরা বাজার গড়ে উঠেছে মথুরাপুর, তেলিধান্য, পান্তাপাড়া, গহরপুর, তেজরোল গ্রামকে নিয়ে। গত সপ্তাহে খাজুরা বাজারের পাশে এনায়েতপুর গ্রামে সানাউল্লাহ্র বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বাড়ির উঠানে তার স্ত্রী তাবালে (উনুনে) খেজুরের রস জ্বাল দিচ্ছেন। সানাউল্লাহ্ জানান, প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি খেজুর গাছ কাটেন। প্রতি শীতের মৌসুমে পাঁচ পন (৮০টি খেজুর গাছে এক পন) গাছ কাটা হয় তার। কিন্তু এলাকায় খেজুর গাছ কমতে থাকায় এখন তিনি প্রতি শীত মৌসুমে ২ পন খেজুর গাছ থেকে রস বের করেন। এরমধ্যে তার নিজের একপন। বাকি গাছগুলো লিজ নেয়া। ৬টি খেজুর গাছপ্রতি তার ১ ভাড় (৭ কেজি) গুড় দিতে হয় খেজুর গাছ মালিককে। তাঁর স্ত্রী জানান, ফজরের নামাজের পর তার স্বামী মাঠে যান খেজুর গাছ থেকে রস নামাতে। প্রতিদিন তাদের কম করে হলেও ৭/৮ ভাড় ‘জিরেন রস’ হয়। এই রস জ্বাল দিয়েই তৈরি করা হয় সুস্বাদু পাটালি। যশোরে খেজুরের রস থেকে পাটালি তৈরির আছে নানান ধরনের কৌশল। যারা খেজুর গাছ থেকে রস বের করে তাদের বলা হয় ‘গাছি’ বা শিউলি। শীত মৌসুমের শুরুতে এই গাছিরা খেজুর গাছ ‘তোলে’ অর্থাৎ তার মাথার এক দিকের পাতাগুলো গোড়া কেটে তুলে ফেলে সেই অর্ধেক চেঁছে পরিস্কার করা হয়। কয়েকদিন পর ওই স্থান শুকিয়ে গেলে পুনরায় ‘চাঁছ দেয়া’ হয়। খেজুর গাছে হাঁড়ি টাঙ্গানোর জন্য উপরের একটি পাতার গোড়ায় এক গাছি দড়ি ঝুলালো এবং চাঁছ দেয়া স্থানটির নিম্নভাগে দুই দিকে খাঁজ কেটে তার সন্ধিস্থলের কিছু নিচে এক বিঘত বাঁশের কঞ্চির ‘নলী’ বসান। তখন কর্তিত স্থানের রস খাঁজ বেয়ে নলীর মুখ দিয়ে ভাড়ের মধ্যে পড়ে। চাঁছের পর ভাড় পাতিলে সামান্য রস বের হয়। তবে এই রস তেমন সুস্বাধু নয়। কারণ তা লবণাক্ত থাকে। পরে গাছটি শুকালে কয়েকদিন পর যখন চাঁছ দেয়া স্থানে অর্ধচন্দ্রাকারে কেটে তার রস নলী দিয়ে ভাড়ে জমা হয়, সে রসের স্বাদ আলাদা। এই রসে এক প্রকার গন্ধ পাওয়া যায়, তাকে বলে ‘নলিয়ান’ গন্ধ। ওই রসের যে গুড় বা পাটালি হয় তাও বাঙালীর খুব লোভনীয় খাদ্য। যশোরের খাজুরা এলাকার খেজুর গাছ থেকে সারা শীত মৌসুমে এই ধরনের নলিয়ান রস পাওয়া যায়। সে কারণে সেখানকার গাছিরা গাছ থেকে রস বের করে কয়েক দিন বিরতি দিয়ে। তাঁরা জানায়, এভাবে গাছ থেকে রস বের করলে সেই রসের গন্ধ থাকে ‘নলিয়ান’ স্বাদের। আর এই জন্য খাজুরার পাটালি এবং গুড় সারাদেশের নামকরা। তবে শীত মৌসুমে আকাশ মেঘলা থাকলে কিংবা রাতে শীত কম পড়লে রস ঘোলা হয়ে যায়। আর ওই রসের গুড়ের স্বাদ হয় অম্লান। তার পাটালিও হয় না। সাধারণত, খেজুর গাছগুলোকে ‘পালায়’ বিভক্ত করে কাটা হয়। এক এক পালা কাটা হয় একেক দিনে। কাটার পর পর তিন দিনের বেশি কোন খেজুর গাছ আর রস দেয় না। প্রথম দিনের খেজুর গাছ কাটলে যে রস বের হয়, তার রস কে বলে ‘জিরান’ রস। এই রস হয় খুব সুস্বাদু। পরের দিন ওই গাছ থেকে যে রস সংগ্রহ করা হয় তাকে বলে ‘দোকাট’। আর ৩য় দিন যদি সে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা যায় তাহলে তার রসকে বলে ‘তেকাট’। তবে দোকাট কিংবা তেকাট যাই হোক না কেন-ওই সব রসের আলাদা নাম আছে। এক কথায় তাকে বলা হয় ‘ওলা রস’। এই রসের পাটালি তো হয় না। বরং তার গুড় হয় টক। অনেকে গ্রাম এলাকায় তামাক মাখাবার কাজে এ গুড় ব্যবহার করে থাকে। শীতের সকালে খেজুর গাছ থেকে রস নামিয়ে রসের ভাড়গুলো বাঁকে করে কারখানায় বাড়িতে নেয়া হয়। যে উনুনে রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়, তার নাম বা’ন বা বাইন। ওই চুিল্লীতে দুটি থেকে ৮/১০টি পর্যন্তু মুখ থাকে। তার উপর নাদা বা জ্বালুয়া (যে পাত্রে রস জ্বাল দেয়া হয়) নামক মাটির তৈরি কড়ায় জ্বালানো হয় রস। রসের এই মৌসুমে যশোরের গ্রামাঞ্চলে এখন খেজুর গুড়ের পাটালিতে ম ম গন্ধে ভরে উঠেছে।
×