ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হরগঙ্গা কলেজের পাকি ক্যাম্প অপারেশনের গল্প শোনালেন মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ

আমার প্রথম ফায়ারেই ঢলে পড়ে এক রাজাকার, অতঃপর...

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬

আমার প্রথম ফায়ারেই ঢলে পড়ে এক রাজাকার, অতঃপর...

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ ‘রাত দুটোর এক মিনিট আগে এক রাজাকার দুটোর ঘণ্টা বাজাতে আসে। এক বেল দেয়ামাত্রই আমি এলএমজি দিয়ে সিগন্যাল ফায়ার ওপেন করি। সঙ্গে সঙ্গে একযোগে ফায়ার শুরু হয়। কেউ এসএলআর কেউ রাইফেল কেউ মর্টার কেউ এলএমজিÑ যার কাছে যা আছে তা দিয়ে ফায়ার চলে মিনিট পাঁচেক। আতঙ্ক সৃষ্টি হয় পাক হানাদারদের হরগঙ্গা কলেজ প্রধান ক্যাম্পে। ওরা ভয় পেয়ে বের না হয়ে আত্মরক্ষার জন্য ক্যাম্প থেকে গুলিবর্ষণ করে’Ñ মহান বিজয়ের মাসে জনকণ্ঠের কাছে এভাবেই মুন্সীগঞ্জ সদর থানা অপারেশনের সফল নেতৃত্বদানকারী মুক্তিযোদ্ধা আশরাফউজ্জামান একাত্তরের রণাঙ্গনের কথা তুলে ধরছিলেন। তার ভাষ্যমতে, একদিন রাতে চরাঞ্চলের যে গ্রামে আমরা ক্যাম্প করেছিলাম সে গ্রামে মেশিনগান সজ্জিত তিনটি গানবোড নিয়ে পাকবাহিনী গ্রাম ঘেরাও করে। আমাদের ১১ জনের মধ্যে ৯ জনই ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত। যে অস্ত্র আছে সে অস্ত্র দিয়ে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। তাই ভাগ ভাগ হয়ে পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে নদী পার হয়ে অপরপ্রান্তে চলে আসি আমরা। মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জেলেদের একটি নৌকায় ওঠে জেলে সেজে। সিদ্ধান্ত ছিল যদি কেউ পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার করলেই অন্যরা বুঝতে পারবে কেউ ধরা পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে যে যেখানে থাকবে সেখান থেকেই পাকবাহিনীর ওপর ফায়ার করবে। আশরাফউজ্জামান বলেন, পাকবাহিনীর অস্ত্র ছিল চায়নিজ। আর আমাদের অস্ত্র ভিন্ন ও গুলির আওয়াজও ভিন্ন। শুধু পাকবাহিনীর গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের কোন গুলির আওয়াজ না পাওয়ায় আমরা সকলেই মুক্তাঞ্চলে আসতে সক্ষম হয়েছি বলে নিশ্চিত হই। পরে খবর পাই সেদিন ওই গ্রামের যুবকরা মসজিদে ফজর নামাজ পড়ার সময় পাকবাহিনী ৯ জনকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। কিন্তু মুন্সীগঞ্জ শহরের মানুষ মনে করেছে মহিউদ্দিনের গ্রুপের নয় মুক্তিযোদ্ধাকে পাকবাহিনী হত্যা করেছে। টঙ্গীবাড়ির বাঘিয়া বাজারের কাছে একটি পুরান বিল্ডিংয়ে আমরা যুবকদের ট্রেনিং করাই। এতে আমাদের নয় জনের গ্রুপ ৪০ জনে পরিণত হয়। নবেম্বর মাসের প্রথম দিকে আমরা সিদ্ধান্ত নেই বড় ধরনের অপারেশন করে শহর মুক্ত করব। ১৬ নবেম্বর পাক বাহিনীর ওপর আক্রমণ করার জন্য কয়েকবার শহর রেকি করি। জানতে পারি শহরে ৩শ’ পাক হানাদার রয়েছে। তারা সারাদিন শহরে টহল দেয়, বিভিন্ন অফিস আদালতে যায়। তখন আমরা ১৬ নবেম্বর রাত এগারোটার দিকে ধলাগাঁও হয়ে রামপাল স্কুলে ৮০ মুাক্তিযোদ্ধা একত্রিত হই। এর মধ্যে ছিল কাজী আনোয়ারের গ্রুপ, মোফাজ্জল গ্রুপ, এনামুল গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি গ্রুপ। আমরা সকালে স্কুলের মাঠে বসে রাতেই থানা অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেই। সর্বসম্মতিতে আমাকে অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি বলেন, তখন আমি রামপাল স্কুলের মাঠে বসেই পরিকল্পনা করি ৮০ মুক্তিযোদ্ধা ৯-১০ জন করে ৮ গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আটটি স্থানে অবস্থান নেব। রাত একটায় আমরা স্কুল থেকে বের হয়ে ঠিক দুটোর মধ্যে যার যার অবস্থানে পৌঁছব। রাত দুটো বাজার সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রথম এলএমজি দিয়ে ফায়ার শুরু করব, সঙ্গে সঙ্গে সকলেই ফায়ার করবে। ফায়ার চলবে ৪-৫ মিনিট। সময়মতো পৌঁছতে কেউ যদি ব্যর্থ হয়ে বিপদে পড়ে তার দায়-দায়িত্ব আমরা নেব না। সেদিন ছিল শবেকদরের রাত। রাতে বিভিন্ন মসজিদের মাইকে কোরান তেলোয়াত ও খতম হচ্ছে। টার্গেট অনুযায়ী ৮০ মুক্তিযোদ্ধা শহরে ঢুকে পড়লাম। মাইকের আওয়াজে আমাদের ঢুকতে সুবিধা হয়। ঠিকমতো আমরা পৌঁছতে পারি। আমার গ্রুপ নিয়ে আমি থানা পুকুরের পূর্ব পাশে এবং মোহাম্মদ হোসেন বাবুল ভাইয়ের বাড়ির পশ্চিম পাশের মাঠে পজিশন নেই। রাত দুটো বাজার এক মিনিট আগে এক রাজাকার দুটোর ঘণ্টা দিতে আসছে। ঘণ্টার বাড়ি একটি দেয়ার মুহূর্তে আমি এলএমজি দিয়ে ফায়ার ওপেন করি। সবাই একযোগে ফায়ার শুরু করে। কেউ এসএলআর কেউ রাইফেল কেউ মর্টার কেউ এলএমজিÑ যার কাছে যা ছিল তা দিয়ে ফায়ার চলে প্রায় ৫ মিনিট। আতঙ্ক সৃষ্টি হয় পাক হানদারদের হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্পেও। তারা ভয় পেয়ে বের না হয়ে আত্মরক্ষার জন্য ক্যাম্প থেকেই গুলিবর্ষণ করে। তিনি বললেন, আমি ফায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায় ঘণ্টা দিতে আসা ওই রাজাকার। এতে থানা থেকে পাল্টা হামলা না চালিয়ে ভয় পেয়ে যে যেদিকে পারে সেদিকে পালিয়ে যায়। পরে আমরা থানায় গিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের পর পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেই। এ সময় দেখি খালের পূর্বপাড়সহ চারদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে মিছিল নিয়ে শহরে বের হয়ে আসে। এতে আমরা ভড়কে যাইÑ কারণ আমাদের হামলার খবর পেয়ে ঢাকা থেকে আসা পাকবাহিনী যদি হামলা চালায় তাহলে হাজার হাজার লোক মারা যাবে। আমরা (মুক্তিযোদ্ধারা) পরিস্থিতি খারাপ দেখলে হয়ত নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়া সম্ভব হবে, কিন্তু সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়বে। এজন্য ছবিঘর সিনেমা হলের সামনে একটি মাইক নিয়ে ঘোষণা করি মুক্তিযোদ্ধারা কার্ফু দিয়েছে, আপনারা কেউ ঘর থেকে বের হবেন না। আবার সবাই যার যার বাড়িতে চলে যায়। পরের দিন ভোরে দেখলাম ঢাকা থেকে গানবোড লঞ্চঘাটে আসছে। বড় বড় শেল পড়ছে শহরে। এর মধ্যে আনিছুজ্জামান আনিস পাকবাহিনীর হরগঙ্গা কলেজের ক্যাম্পে একটি চিঠি লিখে পাঠিয়েছেÑ তোমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুন্সীগঞ্জ ত্যাগ না করলে ধূলিসাত করে মুন্সীগঞ্জ মুক্ত করা হবে। সকাল আটটায় লঞ্চ ঘাট থেকে পাকবাহিনী হরগঙ্গা কলেজে আসার চেষ্টা করেও ভয়ে আসতে সময় লেগেছে বিকেল তিনটা। তারা একবার আসে আবার পিছিয়ে যায়। এরপর কলেজ থেকে পাকবাহিনী সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় চলে যায়। মুন্সীগঞ্জ শহর প্রায় হানাদার মুক্ত হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বিবিসি খবরে বলা হয় ঢাকার নিকটবর্র্তী মুন্সীগঞ্জ শহর মুক্ত হয়েছে। যুদ্ধের সময় আশরাফউজ্জামান ছিলেন মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজের বিএসসির ছাত্র। ’৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে পাক হানাদাররা দেশের নারী-পুরুষের ওপর নির্মম নির্যাতন ও নারকীয় হত্যাকা- শুরু করলে তিনি প্রথমে চলে যান নিজ বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার ধুপধারা ইউনিয়নের বাজরী গ্রামে। পাক হানাদারদের কবল থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখান থেকে তিনি আড়াইহাজারের আরও ৬ জনকে নিয়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে রওনা হন ভারতের উদ্দেশে। চার দিন হেঁটে ও নৌকায় করে কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে কসবা দিয়ে পৌঁছেন আগরতলা শহরে। সেখানে গিয়ে দেখা হয় মুন্সীগঞ্জের মহিউদ্দিন, খালেকুজ্জামান খোকা, মোহাম্মদ হোসেন বাবুল ও শহিদুল আলম সাঈদ, মোস্তফা মহসীন মন্টু, খসরু, হাসানুল হক ইনুসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও অনেক ছাত্র নেতার সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার আব্দুর রশিদসহ কয়েক ছাত্রনেতা সাতজনের মধ্যে ছাত্র হওয়ায় তাকেও দেরাদুনে বিএলএফ (মুজিব বাহিনী) ক্যাম্পে পাঠায়। বাকিদের ট্রেনিং করতে অন্যত্র পাঠানো হয়। প্রায় ২ মাস ট্রেনিংয়ের পর তাকে আগরতলার ট্রানজিট ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে ১৫-২০ দিন থাকার পর ৯ জনকে ট্রেনিংয়ের ওপর ইন্টারভিউ নেয়া হয়। পরে গ্রুপের মধ্যে দুটি এলএমজি দেয়া হয়Ñ একটি আশরাফউজ্জামানকে ও আরেকটি মহিউদ্দিনকে। প্রত্যেককে দেয়া হয় রাইফেল ও প্রচুর গ্রেনেডসহ গোলাবারুদ। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে নয় জনের গ্রুপ নৌকায় মুন্সীগঞ্জের পদ্মার চরাঞ্চলে আসে। এই গ্রুপে আরও ছিল খালেকুজ্জামান খোকা, মোহাম্মদ হোসেন বাবুল, শহিদুল আলম সাঈদ, লৌহজংয়ের ইকবাল, দাউদকান্দির নজরুল। ১৪ আগস্ট লৌহজংয়ে ইকবাল ও সেন্টু গ্রুপের সঙ্গে মধ্য রাতে লৌহজং থানায় আক্রমণ চালায়। সেই যুদ্ধে জয়ী হন তারা। মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় সেদিন ২০-২৫ মিলিশিয়া নিহত হয় এবং প্রচুর গোলাবারুদ উদ্ধার করি আমরা। আর দু’জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে এবং জীবন ভিক্ষা চেয়েছে বলে পাকবাহিনী চাপের মুখে তাদের এখানে এনেছে। এখন থেকে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করবে এবং মুক্তিযুদ্ধ করবে। আনসার কমান্ডার তারা মিয়াসহ তারা দু’জনই পরে মুক্তযোদ্ধা হয়েছিল। অনেক সম্মুখ যুদ্ধের সাক্ষী এই যোদ্ধা। বিভিন্ন স্থানে অপারেশনও চালায়। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের ধূপতারা ইউপির বাজবী গ্রামের আব্দুস ছোবহানের ছেলে আশরাফউজ্জামান। উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর চাকরি না করে ব্যবসায় নেমে পড়েন। তবে বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। এক পুত্র, এক কন্যা এবং স্ত্রী নিয়ে বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করছেন।
×