ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বকেয়া পাওনা ১০৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা

রবি-এয়ারটেল একীভূত হলেও লাইসেন্স দেয়নি বিটিআরসি

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬

রবি-এয়ারটেল একীভূত হলেও লাইসেন্স দেয়নি বিটিআরসি

ফিরোজ মান্না ॥ রবি আজিয়াটা ও ভারতীয় এয়ারটেল বাংলাদেশে কার্যক্রম একীভূতকরণের বিষয়টি চূড়ান্ত হলেও বকেয়ার কারণে বিটিআরসি লাইসেন্স দেয়নি। এছাড়া দুই অপারেটর একীভূত হওয়ার কিছু বিষয় আদালতে থাকায় রবি এয়ারটেল একীভূত চূড়ান্ত অনুমতিপত্র পেতে সময় লাগবে। রবি-এয়ারটেল একীভূত সংক্রান্ত ফি ও আনুষঙ্গিক স্পেকট্রাম (তরঙ্গ) সমন্বয় ফি বাবদ মোট ১০৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা বিটিআরসির পাওনা রয়েছে। এই টাকা পরিশোধের জন্য বিটিআরসি সম্প্রতি রবিকে চিঠি দিয়েছে। ওই চিঠিতে বকেয়া পরিশোধ ও প্রযুক্তিগত শর্তের বিষয়ে রবির অবস্থান জানতে ১০ দিনের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। যদিও এর আগে ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে রবি-এয়ারটেল একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় সার্বিক সহযোগিতা দেয়ায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠান করেছে রবি। বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, রবি-এয়ারটেল একীভূত হতে বকেয়া পরিশোধ ও প্রযুক্তিগত কয়েকটি শর্ত পালন করেনি। এ কারণে বিটিআরসি রবি-এয়ারটেল একীভূত হওয়ার চূড়ান্ত অনুমতিপত্র দেয়নি। রবি-এয়ারটেল একীভূত হওয়ার লাইসেন্স না পাওয়া পর্যন্ত এক নামে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে না। রবি-এয়ারটেল একীভূত হওয়ার ফি বাবদ এক শ’ কোটি টাকা ও তরঙ্গ সমন্বয় বাবদ ৩ শ’ ৭ কোটি টাকা ধার্য করা হয়। এর সঙ্গে ভ্যাট ও ট্যাক্সসহ মোট ৪২৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বিটিআরসির পাওনা। এই টাকা এককালীন অথবা তিন কিস্তিতে পরিশোধের জন্য নির্দেশ দেয় বিটিআরসি। বিটিআরসির নির্দেশের পর রবি ৩শ’ ৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। বর্তমানে বিটিআরসির রবির কাছে ১০৮ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, রবি-এয়ারটেল একীভূত সংক্রান্ত স্পেকট্রাম সমন্বয় ফি বাবদ বকেয়া ১০৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা পরিশোধের বিষয়ে বিটিআরসি রবি-এয়ারটেলকে ইতোমধ্যে চিঠি পাঠিয়েছে। রবি-এয়ারটেল একীভূত হওয়ার বিষয়ে যে ২১টি শর্ত দিয়েছিল বিটিআরসি তা অমীমাংসিত রয়েছে। এ বিষয়গুলো মীমাংসা না করে রবি ব্যবসা পরিচালনা করলে তা বিটিআরসির নিয়ম ভাঙ্গা হবে। এজন্য রবি-এয়ারটেলের বিরুদ্ধে বিটিআরসি যে কোন ব্যবস্থা নিতে পারবে। এ বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. শাহাজান মাহমুদ বলেন, রবি ও এয়ারটেল একীভূত হওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সার্টিফিকেট দেয়া হয়নি। বিটিআরসি রবি ও এয়ারটেলের কাছে বকেয়া পায়। এই টাকা পরিশোধ করলেই তাদের চূড়ান্ত লাইসেন্স দেয়া হবে। তবে কিছু বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই বিষয়গুলো আদালতে রয়েছে। এর বাইরে রবি এয়ারটেল একীভূত হওয়ার আর কোন জটিলতা নেই। বিটিআরসির সঙ্গে রবির অল্প কিছু ‘গ্যাপ’ রয়েছে। এটা উভয় পক্ষ বসে ঠিক করা হবে। এ জন্য বিটিআরসির পক্ষ থেকে রবিকে চিঠি দিয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে বলা হয়েছে। আশা করি এসব বিষযে আলোচনা হলে একীভূত হওয়ার চূড়ান্ত সার্টিফিকেট রবি পেয়ে যাবে। জানা গেছে, গত ১৬ নবেম্বর রবি-এয়ারটেল একীভূত কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করার ঘোষণা দেয়। একীভূত হয়ে অপারেটর ‘রবি আজিয়াটা লিমিটেড’ নামে ব্যবসা পরিচালনা করবে। রবির পাশাপাশি কোম্পানির একটি স্বাধীন ব্র্যান্ড হিসেবে থাকবে এয়ারটেল। রবির মালিকানায় ৬৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ভারতী এয়ারটেলের ২৫ শতাংশ ও বাকি ৬ দশমিক ৩ শতাংশের মালিক জাপানের এনটিটি ডোকোমো। একীভূতকরণ শেষে গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ২২ লাখ। দেশে এই গ্রাহক সংখ্যা নিয়ে রবি দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে। রবি সূত্র জানিয়েছে, দুটি কোম্পানি একীভূত হলে গ্রাহকদের কোন ধরনের অসুবিধা হবে না। এতে গ্রাহকরা আরও উন্নত সেবা পাবে। এয়ারটেলের গ্রাহকদের নম্বর (০১৬ দিয়ে শুরু) অপরিবর্তিত থাকবে। তিন বছর পর ০১৬ দিয়ে নতুন সংযোগ দেয়া হবে না। দুই কোম্পানি এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে একটি বৈঠক করে। সেখানে দুই কোম্পানির মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তি সই হয়। দুই কোম্পানি এক হওয়ার প্রযোজনীয় সব কাগজপত্র বিটিআরসির কাছে জমা দেয়। বিটিআরসির কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর এই কাগজপত্র ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় পাঠায়। মন্ত্রণালয় আবার এই কাগজপত্র তাদের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আদালতে পাঠায়। এরপর আদালত অনুমতি নিয়ে বিটিআরসি দুই কোম্পানির একীভূত হওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। এভাবেই দুই কোম্পানি এক কোম্পানিতে পরিণত হয়। এর আগ পর্যন্ত রবি ও এয়ারটেল আলাদাভাবেই ব্যবসা করেছে। দুই কোম্পানির একীভূত শক্তি সবচেয়ে বিস্তৃত নেটওয়ার্কের সুবিধা নিয়ে গ্রাহকদের আরও উন্নত সেবা দেয়া সম্ভব হবে। বর্তমানে ৫ কোটি ৩৯ লাখ গ্রাহক নিয়ে দেশে শীর্ষে রয়েছে গ্রামীণফোন। এখন রবি একীভূত হয়ে গ্রাহক সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে। এর পরের স্থানে রয়েছে বাংলালিংক। বাংলালিংকের গ্রাহক সংখ্যা ৩ কোটির ওপরে। সূত্র জানিযেছে, বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাত ক্রমবর্ধমান হারে এগিয়ে চলেছে এবং অল্প সময়ে গ্রাহকের দোরগোড়ায় মোবাইল সেবা পৌঁছে গেছে। প্রস্তাবিত একীভূতকরণ এই শিল্প খাতে বিদ্যমান অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা দূরীকরণে সহায়ক হবে। বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা সুনিশ্চিত করবে। আরও মানসম্পন্ন এবং বিস্তৃত নেটওয়ার্ক নিয়ে গ্রাহকদের কাছে অধিকতর সুবিধা-উন্নততর ডাটা ও অন্যান্য সেবা পৌঁছে দেবে রবি। একীভূত হলে এয়ারটেল বাংলাদেশের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি ও দেনার দায়িত্ব নেবে রবি। ভারতী এয়ারটেলের প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন ২০১৫ অনুযায়ী, এপ্রিল ২০১৪ থেকে মার্চ ২০১৫ পর্যন্ত এক বছরে এয়ারটেল বাংলাদেশ লোকসান দিয়েছে ৬৭৪ কোটি ৬০ লাখ রুপি (টাকায় ৮২২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা)। এ সময়ে এয়ারটেল বাংলাদেশের মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫৫৮ কোটি রুপি। এয়ারটেলের কাছে থাকা তরঙ্গের মালিকানাও একীভূত হওয়া রবির কাছে চলে যাবে। বর্তমানে এয়ারটেলের কাছে ২০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ আছে। আর রবির কাছে আছে ১৯ দশমিক ৮০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ। দুটি প্রতিষ্ঠানের তরঙ্গ এক হয়ে ৩৯ দশমিক ৮০ মেগাহার্টজ। যা কিনা মোবাইল অপারেটরের মধ্যে সর্বোচ্চ তরঙ্গ হবে। বর্তমানে গ্রামীণফোনের কাছে সর্বোচ্চ ৩২ মেগাহার্টজ তরঙ্গ আছে। জানা গেছে, রবি আজিয়াটা মালয়েশিয়ার আজিয়াটা গ্রুপ বারহাদ ও জাপানের এনটিটি ডোকোমোর যৌথ উদ্যোগ। এখানে আজিয়াটার শেয়ারের পরিমাণ ৯২ শতাংশ আর এনটিটি ডোকোমোর শেয়ার ৮ শতাংশ। ১৯৯৭ সালে একটেল নামে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে রবি। বাংলাদেশের শিল্পগোষ্ঠী এ কে খান গ্রুপ ও টেলিকম মালয়েশিয়ার যৌথ অংশীদারিত্বের কোম্পানি ছিল একটেল। ২০০৯ সালে এ কে খান গ্রুপ ও টেলিকম মালয়েশিয়া আজিয়াটার কাছে রবির মালিকানা বিক্রি করে দেয়। ২০১০ সালের ২৮ মার্চ ‘রবি’ নামে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে তারা। রবির পরিশোধিত মূলধনের (পেইড-আপ ক্যাপিটাল) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৭শ’ কোটি টাকায়। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে কর্মরত আছেন এক হাজার ৬শ’ জনের বেশি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এক হাজার ৫৮০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে রবি। ভারতী এয়ারটেল ২০১০ সালে ওয়ারিদ টেলিকমের ৭০ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়ে এয়ারটেল বাংলাদেশ নামে ব্যবসা শুরু করে। ২০১৩ সালে বাকি ৩০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় ভারতী এয়ারটেল। ভারতী এয়ারটেল এশিয়া, আফ্রিকাসহ বিশ্বের ২১ টির দেশে ৩০ কোটির বেশি গ্রাহক নিয়ে বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর। এখানে মোট কর্মরত জনবলের সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। আর বাংলাদেশে কর্মরত জনবলের সংখ্যা ৫শ’র বেশি।
×