ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নাসিক নির্বাচন

বিদায় বেলায় ইসি দৃষ্টান্ত স্থাপন করল

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬

বিদায় বেলায় ইসি দৃষ্টান্ত স্থাপন করল

শাহীন রহমান ॥ বিদায় বেলা অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল বর্তমান নির্বাচন কমিশন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমান ইসির অধীনে নারায়ণগঞ্জ সিটির মতো এত ভাল নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন নজির সম্প্রতি নেই। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে কমিশন সম্পর্কে সবার মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করবে। এ নির্বাচন ভাল দৃষ্টান্ত হিসেবে আগামী নির্বাচনগুলোতে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে বলে তারা উল্লেখ করেন। আগামী ফেব্রুয়ারিতে শেষ হচ্ছে বর্তমান কমিশনের মেয়াদ। এরপরই নতুন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করবে। ইতোমধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সবার মতামতের ভিত্তিতে যোগ্য ব্যক্তিদের কমিশনে নিয়োগ দিতে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। কিন্তু বিদায়ের আগে বর্তমান কমিশন নারায়ণগঞ্জ সিটিতে যেভাবে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে, তাতে সারাদেশে যে নির্বাচনী সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল তা থেকে উত্তরণে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের মতে, আগের সব নির্বাচন নিয়েই বর্তমান ইসি ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও সে সমালোচনার লাঘব হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান ইসির অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে নিশ্চয়ই নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন ছিল ব্যতিক্রম। যেখানে ছিল না কোন গোলাযোগ, সহিংসতা। কোন কেন্দ্রের ভোট গ্রহণও স্থগিত করতে হয়নি। জাল ভোট প্রদানেরও কোন খবর পাওয়া যায়নি। কোন পক্ষ থেকেও নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ করা হয়নি। বরং প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী নির্বাচনী পরিবেশ দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে নির্বাচন মেনে নেয়ার ঘোষণাও দেন। আবার বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে সারাদিনের নির্বাচন পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তারা এ নির্বাচন নিয়েও কোন ধরনের অভিযোগ তোলেনি। বৃহস্পতিবার নির্বাচন শেষে কমিশনে এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন বলেন, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী এবং ভোটাররা সহযোগিতা করলে যে সহিংসতামুক্ত পরিবেশে নির্বাচন উপহার দেয়া যায় তার একটি বড় উদাহরণ হলো নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন। তিনি শান্তিপূর্ণ এ নির্বাচন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা পাওয়ায় গোলযোগহীন ভোটগ্রহণ সম্ভব হয়েছে। এ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের কাছ থেকে কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছিল। নির্বাচনের আগে সব প্রার্থীর সঙ্গে মতবিনিময়ও করা হয়েছে। সমস্যা নিরসনে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যার ফলে একটা শান্তিপূর্ণ অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। ২০১১ সালেও নারায়ণগঞ্জে প্রথমবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়ও বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। এ কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে ওই নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি তোলা হয়েছে। এলাকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে শেষ পর্যন্ত হুদা কমিশন সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিলেও পরে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্যেই নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও ব্যক্তি ইমেজের কারণে সেলিনা হায়াত আইভী প্রথমবার এ সিটির মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবারও তফসিল ঘোষণার প্রথম থেকেই এ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। ইসির প্রতি দাবি তোলা হয়েছিল নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার। বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের জন্য ইসিতে লিখিত আবেদনও জানানো হয়। কিন্তু সেনাবাহিনী ছাড়াই নির্বাচন সুষ্ঠু করতে প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করা হয়। শেষ পর্যন্ত কোন প্রকার অভিযোগ ছাড়াই তারা নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সমর্থ হয়েছে। এ বিষয়ে সিইসি আরও বলেন, ভোটের আগের দুই দিন ও ভোটের দিনের মতো পরের একদিনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর থাকতে বলা হয়েছে। তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে সব দিকে তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে। শৈথিল্য না দেখাতে। কেউ যাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে। যারা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে তাদের দুষ্কৃতকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। তারা শাস্তির আওতায় আসবে। শেষ পর্যন্ত কোন অভিযোগ ছাড়াই নির্বাচন সুষ্ঠু করায় কমিশনের জন্য এটি একটি বড় অর্জন। এ নির্বাচনের পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের পরিচালক আব্দুল আলীম বলেন, সাম্প্রতিক খারাপ দৃষ্টান্তগুলো থেকে নারায়ণগঞ্জের এ নির্বাচন ভাল দৃষ্টান্তের রূপান্তর ঘটেছে। এ নির্বাচন আগামীতে একটা ভাল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, যার ইতিবাচক প্রভাব সবখানে পড়বে। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যত ধরনের ফ্যাক্টর দরকার তার সবটুকুই এ সিটি নির্বাচনে হয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতায় সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। এ নির্বাচনে প্রার্থী-ভোটার, দল, সরকার, ইসি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা কাজ করেছে। যার ফলে একটি দৃষ্টান্তমূলক নির্বাচন সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিবেশে ও বর্তমান ইসির বিদায়ের শেষ সময়ে এমন নির্বাচন অংশীজনসহ সবার মধ্যে আস্থা তৈরি করবে। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন নিয়ে পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতীর তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছেÑ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারা বলেন, নির্বাচনে সর্বস্তরের ভোটারদের সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে দেখা গেছে। কোন ধরনের বল প্রয়োগ, প্রভাব বিস্তার, অনিয়ম, সংঘাত বা সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। অধিকাংশ কেন্দ্রের ভেতর ও বাইরের পরিস্থিতি অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ছিল। প্রায় সকল বুথে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রতিনিধির উপস্থিতি দেখা গেছে। ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় কোন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ভোট প্রদানে নারী ও সংখ্যালঘু ভোটারদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়Ñ নির্বাচন বিষয়ে ভোটার, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী, প্রার্থীর প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা, সরকারের সহায়তা ও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীল আচরণের ফলে এ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়েছে।
×