ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোস্তফা জব্বার

একাত্তরে ভুল করিনি

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬

একাত্তরে ভুল করিনি

ব্যক্তিগত স্মৃতি ও ডিসেম্বর ৭১ : ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসটি বিদায় নিচ্ছে। এই মাসের সঙ্গে সঙ্গে আমার মতো লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধার ব্যক্তিগত স্মৃতি অনেক বেশি জেগে ওঠে। আমরা অনুভব করি, জীবনের সেই শ্রেষ্ঠতম সময় এই জীবনে আর কখনও ফিরে আসবে না। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় যে জাতির এত বড় একটি ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের। কৈশোর-তারুণ্য থেকে স্বাধীন বাংলার স্বপ্নের লড়াই, স্বাধীন বাংলাদেশ ধারণা ও বাঙালী জাতিসত্তার জন্মের লড়াই এবং একাত্তরের মার্চ থেকে সশস্ত্র লড়াই ও জীবন নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলো দেখে এই ডিসেম্বর মাসে আনন্দ, শংকা আর ভয় নিয়ে কাটছিল পুরো জাতির সময়। ’৭১ সালে আমাদের মতো বিশের কোঠা অতিক্রমকারী যুবকদের জন্য সময়গুলো ছিল টান টান উত্তেজনা আর নানামুখী ঘটনায় ভরা। মনে পড়ছে ডিসেম্বরের প্রথম দিনেই বিএলএফ’র হাইকমান্ড থেকে অনুমতি পেয়েছিলাম মুক্তাঞ্চলে প্রবেশ করার। ৬ তারিখেই গারো পাহাড়ের মহেষখলা ক্যাম্প থেকে দেশের ভেতরে প্রবেশ করে খালিয়াজুরির লিপ্সা বাজারের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থান করছিলাম। আমার থানাটি পুরো নয় মাসই মুক্তাঞ্চল ছিল। মাঝখানে একদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য পাকিস্তানী সেনাবাহিনী থানা সদরে অবস্থান করেছিল। অন্য সকল সময়েই পাকিস্তানের চাকরিরত বাঙালী পুলিশ বাহিনী চাকরি রক্ষার খাতিরে থানার চৌহদ্দিতেই তাদের জীবন কাটাচ্ছিল। দিগন্তবিস্তৃত হাওড়, দ্বীপের মতো গ্রামগুলো, হাট-বাজার, জনপদ আর প্রান্তর ছিল আমাদের দখলে। মানুষের জীবনযাপন, বিচার আচার, আইনশৃক্সক্ষলা এমনকি লবণ কেরোসিনের রেশনিং করতাম আমরা। পুলিশবাহিনী সাহস করেনি থানার বাইরে এক পা ফেলতে। তবে বিপদ ছিল পাশের থানা শাল্লায়। ওখানে ১৬১ জনের একটি রাজাকার বাহিনী ছিল। সঙ্গে ছিল পাকিস্তানী মিলিশিয়া। সেই থানাতেই একটি বড় যুদ্ধও হয়ে গিয়েছিল। আজমিরীগঞ্জের জলসুখা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা জগতজ্যোতি সেই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। ঐ থানারই সকল হিন্দুগ্রাম রাজাকাররা পুড়িয়ে দিয়েছিল। লুট করেছিল তাদের সকল সম্পদ। হাজার হাজার শরণার্থী পাড়ি দিয়েছিল ভারতে। আমার ইউনিয়ন বা নিজের পিতৃভূমি কৃষ্ণপুর গ্রামটি ছিল শাল্লা থানার প্রান্তে। অনেক হিন্দু গ্রাম ছিল আমার ইউনিয়নেও। ফলে আমার ইউনিয়নেরও হাজার হাজার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে শরণার্থী হয়েছিল। ডিসেম্বরের বিজয়ের পরও তাদের সম্পদ আর গ্রাম রক্ষা করতে হয়েছে আমাদের। মনে পড়ে, লিপ্সা বাজার থেকে বাবার নির্দেশে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে শাল্লার রাজকারদের অস্ত্র সমর্পণ করিয়েছিলাম। সেই রাজাকারদের পরিণতি হয়েছিল মৃত্যুদ-। বিজয়ের পর শাল্লার কুশিয়ারা নদীর পাড়ে আমাদের বন্ধু মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মৃত্যুদ- কার্যকর করেছিল। সেটি না হলে আজ ৪৫ বছর পর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা করতে হতো। সেই ’৬৮ সালে যেদিন ঢাকার রাজপথে প্রথম সেøাগান দিয়েছিলাম, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’Ñ সেদিন থেকেই ভাল কিছুর জন্য লড়াই করছি, ভাল কিছুর জন্য অপেক্ষা করছি। বড় কিছুর জন্য লড়াই করছি-বড় কিছু করার চেষ্টা করছি। একাত্তরে বিজয়ের জন্য লড়াই করেছি। একাত্তরের পরও বিজয়ের জন্য লড়াই করছি। ব্যক্তিগতভাবে এই লড়াই আমার জীবনব্যাপী লড়াই। ’৮৮ সালের এই দিনে বিজয় বাংলা কীবোর্ড প্রকাশ করেছি। সেই বিজয়ের এবার আটাশ পার হলো। এই মাসে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি আরও অনেক বড়। ২০০৮ সালের ৬ ডিসেম্বর আমি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা লিখেছিলাম। ১১ ডিসেম্বর ২০০৮ সেটি আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির অনুমোদন পেয়েছিল। ১১ ডিসেম্বর ২০০৮ আমি এসোসিওর হংকং সম্মেলনে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রকাশ করেছিলাম। তার আগের বছর ২৬ মার্চ ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়। ১২ ডিসেম্বর ২০০৮ জননেত্রী শেখ হাসিনা সেটি ঘোষণা করেন। ২৩ ডিসেম্বর ২০০৮ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ক প্রথম সেমিনার করেছিলাম। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯৯ আমি প্রথম আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল প্রতিষ্ঠা করি। ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ দেশের প্রথম ডিজিটাল স্কুল চালু করি। ৪৫ বছর পর : কখনও মনে হতো, আত্মসমর্পণের পর রাজাকারদের মৃত্যুদ- দেয়া কি ঠিক হয়েছিল? আমরা তখন যুদ্ধ সংক্রান্ত বিশ্বরীতি জানি না। আত্মসমর্পণ করলে কী করতে হয় সেটি ২২ বছর বয়সী মানুষের জানার কথাও নয়। বরং স্মৃতিতে তখন ভাসছিল সেই রাজাকারদের নৃশংসতা। সেই ঘটনার ৪৫ বছর পর এখন মনে হয়, সম্ভবত কাজটি সঠিক ছিল। কারণ তা না হলে বেগম জিয়া সেই রাজাকারদের বাঁচানোর জন্য আন্দোলন করতেন- যা আমরা কোনদিন ক্ষমা করতে পারব না। মাঝে মধ্যে আমার ইচ্ছা হয় আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে সেই রাজাকাররা যে লুটপাট করেছিল যেভাবে হাজার হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়েছিল সেই দৃশ্যগুলোর যদি ভিডিও থাকত এবং বেগম সাহেবা, তার দল ও জোটের নেতা-কর্মীদের যদি দেখানো যেত, তবে তিনি হয়ত একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দোসরদের বর্বরতা, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে কিছু ধারণা পেতেন। নয় মাস সেনানিবাসে থেকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সেই দুর্দশার চিত্র তো তিনি দেখেননি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধও দেখেননি। ফলে খুব সহজে তিনি গোলাম আযম, নিজামী, কামারুজ্জামান, সাঈদী, সাকাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসতে পারেন। এজন্য তার বুক কাঁপে না। তিনি লাখ লাখ মা-বোনের আর্তনাদ শুনেন না। তিনি লাখো শহীদের আত্মার চিৎকারও শুনতে পান না। ক্ষমতার মদমোহে নিমগ্ন এই নারী বাঙালীর ঘরে জন্ম নেয়া একটি বাঙালীবিরোধী নারী হিসেবেই চিহ্নিত থেকে গেলেন। প্রতিবছর যখন ডিসেম্বর মাস আসে তখন আমার ছেলে, যার নাম বিজয়, সে প্রায় প্রতিদিন তার বাবা-মার সঙ্গে ইতিহাস নিয়ে কথা বলে। কয়েক বছর আগে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ৪০ বছর পূর্তিতে সে মায়ের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে গিয়েছিল। তার মা মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পরে জাসদ করতেন বলে মুজিব বাহিনীর অনেকের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। সন্ধ্যায় আমিও গিয়েছিলাম সেই অনুষ্ঠানে। ওখানে সে তার বাবা-মায়ের বন্ধুদের কাছে গল্প শুনেছে তার ১৮ বছর বয়সী মা কেমন করে বাঞ্ছারামপুরের গ্রাম থেকে পালিয়ে ভারত গিয়েছিল, কেমন করে মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিল এবং তারও পরে দেশে ফিরে কেমন করে জাসদ করেছেন। বাবার কথা বেশি শুনেছে গণকণ্ঠের সাংবাদিক হিসেবে। এখন সে প্রায় প্রতিদিনই প্রশ্ন করে, তোমরা কেমন করে মার্চ মাস তৈরি করলে, কী করলে তখন, নয় মাসে তোমাদের কী কী অভিজ্ঞতা রয়েছে এসব। এতদিন তার মাঝে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কোন কৌতূহল ছিল না, পাকিস্তান কেন ভাঙ্গা হলো এবং পাকিস্তানের জাতীয়তার সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয়তার কী কী পার্থক্য আছে, মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও মৌলবাদ কেন আমাদের চালিকাশক্তি হতে পারে নাÑ এসব বিষয় নিয়ে তার ব্যাপক আগ্রহ। আমি খুব অবাক হয়েছি যখন দেখলাম সে নিজেই বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের বর্তমান নিয়ে একটি তূলনামূলক চিত্র তৈরি করেছে। আমার কাছে ওর যে বাক্যটি সবচেয়ে ভাল লেগেছে সেটি হলো, তোমরা পাকিস্তান ভেঙ্গে আমাদের একটি জগদ্দল পাথরের নিচ থেকে রক্ষা করেছো। আমরা এখন তালেবান থাকতাম এবং সারা দুনিয়ায় মুখ দেখাতে পারতাম না। সে তার মাকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছে বাংলাদেশ কোন কোন সূচকে পাকিস্তানের চাইতে এগিয়ে আছে। আমাদের ছেলে যদিও নেতিবাচক বিষয়গুলো এড়িয়ে যায় তবু আমি এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মাঝে অসন্তোষ দেখি। দুর্নীতিকে ওদের ঘৃণা করতে দেখি। সহিংসতাকে ঘৃণা করতে দেখি। যানজট ওদের পছন্দ না। রাজনীতিবিদদের সাধারণভাবে পছন্দ করে না তারা। আমলাদের সম্পর্কে ওদের ধারণা নেতিবাচক। আমলারা অদক্ষ, দুর্নীতিবাজ এবং স্বার্থপর সেই কথাটি সরাসরি বলে ফেলে। ওদের মাঝে সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা লক্ষ্য করেছি সেটি হলো, কাজটি কেন এখনই হচ্ছে না তাতে অস্থিরতা কাজ করে। ইন্টারনেটের গতি নেই কেন বা দাম কেন বেশি সেটি যেমন করে ওদেরকে ভাবায়, তেমনি করে পেপাল নেই কেন বা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে সচিবালয়ে কোন পরিবর্তন নেই কেন, সেটিও এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের বিশাল প্রশ্ন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে আবুল হোসেন কেন মন্ত্রী হয়েছিলেন সেটিও ওরা জানতে চায়। কেন ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রমকে সঠিকভাবে সমন্বয় করা হয় না সেই প্রশ্ন আছে ওদের। এটুআই কী করছে সেটি তারা জানতে চায়। আমি মাত্র কদিন আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচকটি আমার ছেলেকে বলছিলাম। তাকে জানিয়েছিলাম বাংলাদেশের নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক তথ্যগুলো। আমাদের মেয়েরা যে বিশ্বের অন্যতম সেরা ওয়ার্কফোর্স সেটি ওকে বোঝাতে হলো না। আমাদের মা ও শিশুর স্বাস্থ্য বিষয়ক অগ্রগতি ছাড়াও কৃষক, প্রবাসী বাংলাদেশী ও গার্মেন্টস শ্রমিকদের অর্জন নিয়ে ওকে নিজেকেই গর্ব বোধ করতে দেখলাম। স্বাধীনতার পরপর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের তলাহীন ঝুড়ির গল্পটা সে জানে। সে এটিও জানে যে, মাত্র ৭০০ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু এবং এখন আমরা সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার বাজেটের মাঝে পৌঁছেছি। ওর নিজের কাছে অবাক লেগেছে যে হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি খালের জন্য বরাদ্দ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের ক্রিকেটের জয়যাত্রা থেকে শুরু করে আউটসোর্সিং-এ ওর প্রজন্মের সফলতাসহ আমাদের সকল অর্জনকে আমাদের সন্তানের প্রজন্ম ইতিবাচক হিসেবেই দেখে। যেদিন আমাদের সন্তান এমনসব বাক্য উচ্চারণ করেছে সেদিন আমার কাছে মনে হয়েছে আমরা একাত্তরে ভুল করিনি এবং মুক্তিযুদ্ধ করেও কোন ভুল করিনি। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর যাদের জন্য বাংলাদেশ গড়েছিলাম তাদের মাঝে আশার আলো দেখলে ভাল লাগে। এটিও ভাবতে ভাল লাগে যে, কেবলমাত্র একটি দক্ষ, দুর্নীতিহীন প্রশাসন ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোর মীমাংসা করা গেলে সামনের এক দশকে বাংলাদেশ বিশ্বের একটি সেরা দেশে পরিণত হতে পারে। আর সেই লক্ষ্যটি পূর্ণ হবে যখন আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে পারব এবং এর পরের স্তরে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ব।
×