ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চৌধুরী শহীদ কাদের

ইতিহাস পড়ানোর সংগ্রাম

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬

ইতিহাস পড়ানোর সংগ্রাম

গুলশান ও শোলাকিয়ার জঙ্গী হামলার পর শিক্ষামন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ সমাজের নানা শ্রেণীপেশার সুধীজন বারবার উচ্চারণ করছিলেন, দেশে জাতীয় ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে। সবাইকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্থানের গৌরবময় আত্মত্যাগের ইতিহাস জানতে হবে। ইতিহাসকে উপেক্ষা করার ফল কী হতে পারে গুলশান, শোলাকিয়া রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারক ও চিন্তকদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, রাষ্ট্রের এসব সম্মানিত নীতি-নির্ধারকের কাছে গত দেড় দশক ধরে আমরা জাতীয় ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করার দাবি জানিয়ে আসছি। সকল স্তরের সকল শিক্ষার্থীকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ইতিহাস বাধ্যতামূলক করার দাবিতে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন কত শতবার তাদের কাছে চেষ্টা তদবির করেছেন। ১৯৯১ সালে দিনাজপুর সরকারী কলেজে ইতিহাস বিষয়ক এক কর্মশালায় অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও মেসবাহ কামাল সর্বপ্রথম জাতীয় ইতিহাস অবশ্য পাঠ্য করার দাবি তোলেন। এরপর এই দাবির সপক্ষে তৃণমূলে সচেতনতা বৃদ্ধি ও রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রায় দেড় দশক ধরে নানা প্লাটফর্মে অধ্যাপক মামুনের নেতৃত্বে আমরা চেষ্টা করেছি ইতিহাসকে গণমুখী করতে, পাঠ্য করতে। আমাদের এত সব কর্মকা-ের মধ্যেও বিষয় হিসেবে ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠায় যখন ব্যর্থ, ইতিহাস পড়ানোকে যখন প্রায় বাদ দেয়া হচ্ছে, সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার অডিটোরিয়ামে ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ আয়োজন করা হয় ইতিহাস শিক্ষক সম্মেলন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় দু’শতাধিক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস শিক্ষকের উপস্থিতিতে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী। এর মধ্য দিয়ে গত দেড় দশকের অসংগঠিত আন্দোলনকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়া হয়। সাম্প্রদায়িক ইতিহাস চর্চা ও ইতিহাসকে পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেয়া, খ-িত ও বিকৃত ইতিহাস পড়ানোর প্রতিবাদে অসাম্প্রদায়িক, গণমুখী ইতিহাস চর্চার এই ধারার সূচনা। ইতিহাস সম্মিলনী প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ইতিহাস পাঠকে বাধ্যতামূলক করার জন্য আয়োজন করে বেশ কয়েকটি একাডেমিক সেমিনার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে প্রেসক্লাবে আয়োজিত ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাঠক্রম : প্রসঙ্গ ইতিহাস’ শীর্ষক এক আলোচনায় উঠে আসে দেশে ইতিহাস চর্চার নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির চিত্র। প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত কীভাবে ইতিহাসকে পাঠ্যসূচী থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে, ইতিহাসকে খ-িত করা হচ্ছে, ইসলামের ইতিহাসকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে কীভাবে সাম্প্রদায়িক ইতিহাস জনপ্রিয় করা হচ্ছে সেসব উপাত্ত উঠে আসে আলোচনায়। অধ্যাপক মামুন সিদ্ধান্ত নেন বিষয়টি তিনি শিক্ষা সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে অবহিত করবেন। সম্মিলনীর পক্ষ থেকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে স্মারকলিপি দেয়া হয়। তিনি বিষয়টি স্থায়ী কমিটিতে শুনানির সিদ্ধান্ত নেন। এটা স্বাধীন বাংলাদেশে কোন বিষয়কে পাঠ্য করা নিয়ে প্রথম গণশুনানি। কমিটির সদস্য, জনপ্রতিনিধিরা বিস্ময় প্রকাশ করে ইতিহাস চর্চার করুণ চিত্র দেখেন। অধ্যাপক মামুন সংসদীয় কমিটির সামনে তুলে ধরেন বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চাকে কীভাবে বাদ দেয়া হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস কীভাবে নির্বাসিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ইতিহাসের বিকল্প হিসেবে ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী শিক্ষাকে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেন। ইতিহাসের এই সংকটাপন্ন অবস্থায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদ সম্মিলনীর অনুরোধের প্রেক্ষিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর ¯œাতক পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করেন। আমাদের দেড় যুগের যে সুদীর্ঘ ইতিহাস পড়ানোর আন্দোলন সেটার একটা বড় বিজয় এর মধ্য দিয়ে সূচিত হয়। ইতিহাসকে গণমুখী করতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে জাতীয় ইতিহাস পাঠকে অবশ্য পাঠ্য করতে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের দাবির আংশিক পূরণের পথ সুগম হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করবে। সেটা যদি বাস্তবায়িত হয় তবে সত্যিকার অর্থেই আমাদের ইতিহাস পড়ানোর সংগ্রাম সত্যিকার আলোর মুখ দেখবে। ‘যে সময় ইতিহাস সম্মিলনী যাত্রা শুরু করে সে সময়টা খুব অনুকূল ছিল না। সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। পাকিস্তানী মনোভাবাপন্নরা ক্ষমতা দখল করতে চাইছিল। সে সময় মুনতাসীর মামুনের নেতৃত্বে ইতিহাস সম্মিলনী যাত্রা শুরু করে অসাম্প্রদায়িক জনঘনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চার অঙ্গীকার নিয়ে’। সম্মিলনীর উদ্যোগে ২০১৩ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার শীর্ষ একাডেমিশিয়ানরা যোগ দেন, যেখানে জামায়াতের ধর্মীয় গুরু মওদুদীর পুত্র হায়দার মওদুদী এসে তাঁর বাবার ভ্রান্ত ইসলামিক দর্শন সম্পর্কে সাধারণকে অবহিত করেন। গণমাধ্যমে সাড়া ফেলে তাঁর আগমন। সে সম্মেলন আশাতীত সাফল্য অর্জন করে, নির্বাচনের প্রাক্কালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে উজ্জীবিত করে ও জনমত সংগঠন করে ইতিহাস সম্মিলনী তার জায়গা করে নেয়। ইতিহাসকে বাদ দেয়ার বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়ীকরণের বিরুদ্ধে দেড় দশক ধরে আমরা কথা বলছি। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ইতিহাসকে যখন খ-িত ও বিকৃত করা হচ্ছিল তখন আমরাই একমাত্র সামনে থেকে এর বিরোধিতা করেছি। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যেও ইতিহাসবিমুখতা লক্ষ্য করা যায়। অথচ নিজেদের স্বার্থে জাতি রাষ্ট্রের ইতিহাসকে সবচেয়ে বেশি পৃষ্ঠপোষকতা করা প্রয়োজন আওয়ামী লীগের। ইতিহাস না পড়ানোর বিরুদ্ধে আমাদের যে আন্দোলন সে সময় সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা আমরা পেয়েছি দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার। অসাম্প্রদায়িক ও গণমুখী ইতিহাসের প্রয়োজনীয়তা, ইতিহাসকে নির্বাসনে পাঠানোর নানা সংবাদ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে তারা। জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ সহযোদ্ধা হিসেবে ইতিহাস পড়ানোর আন্দোলনে তিনি কলম তুলে নিয়েছিলেন। লিখেছেন একাধিক সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়। শেকড়হীন কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। আমাদের অভ্যুদয়ের যে রক্তাভ ইতিহাস সেটার মর্মকথা তরুণ প্রজন্মকে জানাতে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক প্রজন্ম গঠনে ইতিহাস চর্চার বিকল্প নেই। চলমান উগ্রপন্থাকে আদর্শিক কৌশলে মোকাবেলার শক্ত হাতিয়ার হতে পারে ইতিহাস পাঠ। জাতি যত বেশি ইতিহাসমনস্ক হবে অসাম্প্রদায়িকতা, দায়িত্ববোধ ততবেশি তাকে প্রভাবিত করবে। সুতরাং জাতি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সত্যিকার মাথা তুলে দাঁড়ানো নির্ভর করে আমরা ইতিহাস পড়ছি কিনা, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ইতিহাসকে কি পর্যায়ে রেখে যাচ্ছি সে বিষয়ের ওপর। ইতিহাস না জানলে ভবিষ্যতের পথরেখা নির্দেশ করা দুরূহ। আমরা চাই সবাই ইতিহাস পড়–ক, ইতিহাসমনস্ক জাতি গড়ে উঠুক। আজ আমাদের প্রথম ত্রিবার্ষিক সম্মেলন। নতুন কমিটি দায়িত্বভার গ্রহণ করবে এবং আমরা আশা করি বিজয়ের মাসে নতুন কমিটির নেতৃত্বে সম্মিলনী বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখবে। লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও দফতর সম্পাদক, বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী
×