ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কাজের পরিধি অনেক বেড়েছে

অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী লোকবল নেই জেলা প্রশাসনে

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬

অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী লোকবল নেই জেলা প্রশাসনে

সমুদ্র হক ॥ মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসনে যে লোকবল থাকা দরকার তা নেই। ডেপুটি কমিশনারদের (ডিসি, যারা জেলার প্রশাসক) কাজের পরিধি কয়েকগুণ বেড়েছে। বর্তমানে জেলা প্রশাসনের যে অর্গানোগ্রাম আছে তা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ হাতেগোনা কয়েকটি জেলা ছাড়া আর কোথাও শতভাগ পূর্ণতায় নেই। মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসনে যে জনবল থাকার কথা তার মাত্র ৫০ শতাংশ দিয়ে কাজ চলছে। ফলে ২ হাজার ২১ সালের মধ্যে নি¤œমধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা এবং জাতিসংঘ ঘোষিত সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) পূরণে যে পথে ছুটে চলার কথা সেই পথ হয়ে পড়ছে ধীর গতির। আরেকদিকে ডিজিটাল দেশ গড়তে জেলা প্রশাসকের অফিসগুলোতে এখনও অনলাইনের একটি নেটওয়ার্ক আওতায় আসেনি। এখনও ই-মেইলে যোগাযোগ করতে হয়। বর্তমানে যা আছে তা ডিসি অফিসেই একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে। যা আধা ম্যানুয়ালে বা কাগজকলমে (হার্ড কপি) আধা কম্পিউটারে। এই অবস্থায় জেলা প্রশাসনে ডিজিটালে যে গতি থাকার কথা তা নেই। ডিসি, অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (এডিসি), সহ জেলা প্রশাসনের সকল কর্মকর্তাকে এর মধ্যে থেকেই জনগণের সেবা দিতে হচ্ছে। ফলে যারপরনাই চাপে থেকে কাজ করতে হচ্ছে। এ বিষয়ে উপসচিব মর্যাদার (মাঠ পর্যায়ে যারা ডিসির দায়িত্ব পালন করেন) কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, ডিসিরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে যথেষ্ট চেষ্টা করেন যত দ্রুত পারা যায় কাজ শেষ করতে। বর্তমানে কাজের পরিধি অনেক বেড়েছে। নতুন নতুন কাজ যুক্ত হচ্ছে। সেই তুলনায় জনবল বাড়েনি। যে কাঠামো আছে তাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অর্ধেক। তারপর সংবিধানের আওতায় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে ডিসিরা তাদের দায়িত্ব পালনে সর্বদাই সচেষ্ট থাকেন। বর্তমানে প্রতিটি জেলা প্রশাসন অফিসে ডিজিটাল কার্যক্রম চালু হয়েছে। অনলাইনে অনেক কাজ হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে অনেক ডিসি অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমস্যা জেনে তা দ্রুত সম্পন্ন করছেন। এভাবে কাজের গতি এসেছে। তবে যে গতি থাকার কথা জনবল সঙ্কটে তা আসছে না। প্রতিটি জেলায় একজন ডিসিকে অফিসে কাজ করার পর বাসভবনেও কাজ করতে হয়। বাস ভবনেও অফিস আছে। একজন ডিসির দৈনিক কাজের ফিরিস্তি যান্ত্রিক মানুষের মতো। জেলা ও উপজেলার কত অনুষ্ঠানে যে তাকে প্রধান অতিথি হতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান, জাতিসংঘ ঘোষিত দিবসের অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, প্রদর্শনী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানসহ এমন কোন অনুষ্ঠান নেই যাতে ডিসিদের আমন্ত্রণ জানানো হয় না। ডিসি অফিসের কনফারেন্স রুমে নানা আয়োজন থাকে। সেখানেও ডিসিদের থাকতে হয়। এর ওপর মন্ত্রী, সচিব, উর্ধতন সরকারী আমলা, সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি, বিদেশী প্রতিনিধিদের প্রটোকল করতে হয়। অনুষ্ঠানের বেশি চাপ পড়লে কোন কোন অনুষ্ঠানে অবশ্য এডিসি(সার্বিক), এডিসি (শিক্ষা ও আইসিটি), এডিসি(রাজস্ব) ডিসির পক্ষ থেকে যোগদান করেন। দেখা যায় ডিসি, এডিসি কেউই সময়মতো দাফতরিক কাজ সম্পন্ন করতে পারছেন না। কখনও কাজগুলো তারা করেন অফিস সময়সূচীর নির্ধারিত সময়ের পরে। দিনের কাজ শেষ হয় কখনও মাঝরাতে, কখনও গভীর রাতে। কখনও পরের দিনের অপেক্ষায় থাকতে হয়। ৪৫ বছরে দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এই তুলনায় সিভিল প্রশাসনে জনবল বেড়েছে মাত্র ২৬ শতাংশ। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ১৯৮৭ সালে সিভিল প্রশাসনে সব মিলিয়ে জনবল ছিল ১০ লাখ ৯০ হাজার ৩শ’ ৩৩। বর্তমানে সিভিল প্রশাসনে সব মিলিয়ে জনবল ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৩শ’৯৩। ২৯ বছরে জনবল বেড়েছে মাত্র ২ লাখ ৯২ হাজার ৬০। সিভিল প্রশাসনে মাঠ পর্যায়ে লোকবল এতটাই কম যে বিপুল জনগোষ্ঠীর সেবা দিতে জেলা প্রশাসক তথা জেলা প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ছিলেন বর্তমানে যুগ্ম সচিব জানালেন, জেলা প্রশাসন মূলত জেলার সকল কাজের সমন্বয়কারী। একজন ডিসি জেলার সকল কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয় করে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করেন। তার মতে জেলা প্রশাসনের কাজের গতি দ্রুত করতে প্রথম দরকার যে অর্গানোগ্রাম (কাঠামো) আছে সেই অনুযায়ী শতভাগ লোকবল নিশ্চিত করা। প্রতিটি জেলাকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু ধরে সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পদায়ন দেয়া দরকার। প্রতিটি জেলার উন্নয়নের জন্য দরকার আলাদা বাজেট। শীঘ্রই জেলা পরিষদের নির্বাচন করে জেলার সকল বিভাগের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হচ্ছে। এটা পজিটিভ দিক। তিনি উদাহারণ দিয়ে বলেন চট্টগ্রামের ১শ’ ৯১ ইউনিয়নের জন্য জ্বালানি বরাদ্দ ১শ’ ৮০ লিটার। মেহেরপুরে ৩০ ইউনিয়নের জন্য জেলার জ্বালানি বরাদ্দ একই ১শ’ ৮০ লিটার। ভৌগোলিক ও আয়তনগত অবস্থান দেখে যে জেলার জন্য যে পরিমাণ সরকারী সাপোর্ট তাই দেয়া দরকার। ডিজিটাল অগ্রগতিতে যা দশ বছরে হওয়ার কথা তা ৫/৬ বছরে যথেষ্ট এগিয়েছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে এই অগ্রযাত্রাকে আরও দ্রুত এগিয়ে নেয়া দরকার। বর্তমানে ডিসি অফিসের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে কম্পিউটারের ব্যবহার হচ্ছে। তাও পরিপূর্র্ণ নয়। ডিসি অফিসে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি সফটওয়্যার দেয়া আছে। এখনও ফাইল ওয়ার্ক হয়। কিছু কাজ হয় কাগজেকলমে। কিছু বিষয় কম্পিউটারের আওতায় এসেছে। কথা ছিল ডিসি তার কম্পিউটারে জেলার সকল অফিসারের সঙ্গে এক নেটওয়ার্কে যুক্ত থেকে যোগাযোগ করবেন। জেলার প্রতি বিভাগের কর্মকর্তা কম্পিউটারে ফাইল ওয়ার্ক করে উর্ধতনের কাছে নেটওয়ার্কে পাঠাবেন। তিনি তা পাঠ করে জেনে প্রয়োজনীয় নোট দিয়ে পাঠাবেন এডিসি ও পরে ডিসির কাছে। ডিসি প্রয়োজনীয় নোট ও পরামর্শ দেবেন। এভাবে চেন অব কমান্ডে সর্বোচ্চ মহলে তা পৌঁছবে। কাগজে যে ফাইল নড়তে সময় লাগত ২ থেকে সাত দিন বা তারও বেশি। ডিজিটাল নেটওয়ার্ক সার্ভারে তা আধাঘণ্টা এক ঘণ্টার মধ্যেই সম্পন্ন হবে। বর্তমানে তা হয় না। ম্যানুয়াল ও কম্পিউটার দুই-ই ব্যবহার হচ্ছে। এমনিতেই লোকবলের অভাবে যে গতি থাকার কথা তা থাকছে না তার ওপর ডিজিটালে যে দ্রুততা আসবে তাও হচ্ছে না। প্রায় এক বছর আগে প্রতিটি জেলায় প্রথম শ্রেণীর সকল সরকারী কর্মকর্তার হাতে একটি করে ট্যাব দেয়া হয়েছে। কথা ছিল এই ট্যাবে কর্মকর্তাদের সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ করা যাবে। এ জন্য টেলিটক সিম ফ্রি সরবরাহ করে নির্দিষ্ট মাত্রায় ইন্টারনেট ব্যবহার ফ্রি করা হয়। এর পরও কার্যত কোন সুফল আসেনি। এই ট্যাব ব্যবহার অনেকক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকায় সর্বক্ষণিক সংযোগ রাখা যায়নি। খোঁজখবর করে জানা যায়, অনেক কর্মকর্তা এসব ট্যাবে, সামাজিক যোগাযোগ ফেসবুকে অনেকটা সময় দেন। একটি নেটওয়ার্ক সার্ভার সংযুক্ত থাকার ব্যবস্থা করলে দ্রুত পেন এ্যান্ড পেপারলেস (কাগজ কলমবিহীন) কার্যক্রমে মাঠ প্রশাসনের গতি আসবে। ট্যাবে যা সম্ভব হয় না ল্যাপটপে এক নেটওয়ার্কে সাচ্ছন্দে যুক্ত থাকা যায়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র জানান, মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন আগের চেয়ে অনেক চ্যালেঞ্জিং। বর্তমানে সরকারের উন্নয়ন কাজের পরিধি অনেক বেড়েছে। সামজিক ব্যাধিগুলো মোকাবেলা করতে হয়। জনবল প্রয়োজনীয় অনুপাতে না থাকায় বছর শেষে ডিসিদের কাজের প্রতিবেদন দেখলেই তা বোঝা যায়। এই সূত্র আশাব্যঞ্জক কথাও বলেছে- মাঠ পর্যায়ে অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী জনবল বাড়ানোর বিষয়টি সরকারের বিচেনায় আছে। শীঘ্রই তা পূরণের সকল ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিছুদিন আগে সচিবালয়ে এবং মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনে পদন্নতি দেয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে কাজের গতি বাড়াতে প্রশাসন এবং তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিতে (আইসিটি) গতি আনা হবে।
×