ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধারাবাহিক ॥ উপন্যাস

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

ধারাবাহিক ॥ উপন্যাস

(পূর্ব প্রকাশের পর) মুরাদ-মেহজাবীনের সুহাগ রাত (শেষ প্রহর) দূর সম্পর্কের পূর্বপুরুষ মহান কুবলাই খানের অন্দরমহলের অনেক কাহিনী শুনেছেন শাহজাদা মুরাদ। সমগ্র এশিয়া হতে বাছাই করা রূপসীদের নিয়ে নিজস্ব তাঁবুতে তিনি রাতযাপন করতেন। খোদ কুবলাই খানের প্রধান মহীয়সী শাবি এদের নির্বাচন ও তত্ত্বাবধান করতেন। এর নাম দিয়েছিলেন ‘পঞ্চ-স্বর্গ’। মুরাদ মঙ্গোল-জাত মুঘল হিসেবে এই ঐতিহ্য বজায় রাখতে পেরে ভেতর ভেতর অনেক গর্ববোধ করেন। আর যাই হোক বিলাস-ব্যসনে দাদাজান জাহাঙ্গীরের নাম উজ্জ্বল তো তিনিই করতে পেরেছেন। তিনি ছাড়া এমন মুঘল-তেজ আর কার আছে? বড় ভাই দারা আছেন বোনদের সঙ্গে ফিসফিস করে ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত। দয়ার শরীর তার। মেজ ভাই সুজা শিকারের নেশায় মশগুল। বনে-জঙ্গলে ঘুরে বাংলার তাবৎ বাঘ-ভাল্লুক মেরে তিনি মনের সুখ মেটাচ্ছেন। তবে হ্যাঁ, সেজ ভাই আওরঙ্গজেব সবার চেয়ে আলাদা এবং হুঁশিয়ারি। এক আজব মুঘল তিনি। লোকে বলে মেয়েমানুষ তাঁকে টানে না, মুরাদের কিন্তু তা বিশ্বাস হয় না। আরে, দুনিয়াতে মদ আর মেয়েমানুষ ছাড়া কি রাজপুরুষ টিকতে পারে? অবসরে তিনি নাকি টুপি সেলাই করেন। ভাবতেই একাকি হো হো করে হেসে উঠলেন মুরাদ। সম্ভবত আওরঙ্গজেবের কপালে মেহজাবীনের মতো সুন্দরী জোটেনি কিংবা অন্য কোন সমস্যাও থাকতে পারে। এটা প্রজাদের চোখে ব্যতিক্রমী হবার কৌশল না তো? আফিমের কৌটাটা হাতে নিয়ে মুরাদ ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি বোধ করেন। বাদশাহ শাহজাহান আলী নকীকে প্রধান উজির হিসেবে গুজরাটে নিয়োগ দেবার পর হতেই বুলন্দের বাড়া ভাতে যেন ছাই পড়লো। শাহজাদা মুরাদ নিজেও বিষয়টিতে খুশি হননি। রাজ্যের জমা খরচের হিসাব, যাবতীয় অনুমোদন সবকিছুতেই আলী নকী দিল্লী হতে পূর্ব-অনুমতি নিতে চান। মুরাদের নিজের ইচ্ছার যেন কোন মূল্যই নেই। অথচ তিনি দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাবান মুঘল সম্রাটের আদরের পুত্র। তাকেই কি না সামান্য উজিরের কাছে কৈফিয়ত দিতে হয়! শাহজাদা মুরাদ উপহারস্বরূপ নামমাত্র মূল্যে বুলন্দকে রাজকোট এলাকা দিতে চেয়েছিলেন। ন্যায্য মূল্য হচ্ছে না বিধায় সেই চুক্তি আলী নকী বাতিল করে তা দিল্লীতে সম্রাটকে অবগত করেন। শুধু তাই নয় মুরাদ শাসন কাজে ঢিলেমি করছেন বা ঠিক মতো প্রজাদের তদারকী করছেন না এমন অভিযোগও করেছেন দিল্লীশ্বরকে। একইভাবে পাটানের ফৌজদার আব্দুল খাসেগী দুর্নীতির দায়ে নাজেহাল হয়েছেন আলী নকীর কাছে। এরা সবাই শাহজাদার প্রিয়ভাজন। কিন্তু আলী নকীর বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু করার সুযোগ নেই কারণ বাদশাহ তাঁকে অনেক পছন্দ ও বিশ্বাস করেন। সুতরাং এমন কিছু প্রয়োজন যেটা হাতে পেলে মুরাদ সরাসরি আলী নকীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন। অবশেষে ভেবে একটা উপায় বের করলো নকীর বিরুদ্ধ পক্ষ। বুলন্দ ও খাসেগী দু’জন মিলে সুচতুরভাবে আলী নকীর হাতের লেখা ও সিলমোহর নকল করলো। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই চিঠি ছিল বাদশাহের কাছে মুরাদের বিরুদ্ধে নালিশ আর মনের মাধুরী মেশানো ষড়যন্ত্রে ভরা। দিল্লী হতে গুপ্তচর মীর নসরুল্লাহর চিঠিটা হাতে পাবার পর মোক্ষম সময়ে আলী নকীর নামে লেখা নকল চিঠি সম্পর্কে বুলন্দ মুরাদকে অবহিত করলো। মুরাদের মাথার ভেতর জ্বলা আগুনকে এখন কামনার বারুদের সঙ্গে মিশিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো বুলন্দের একমাত্র উদ্দেশ্য। অনেক যতেœ মেহজাবীনকে বুলন্দ সাজাচ্ছে। সেই অনুযায়ী আগেই তাকে তালিম দেয়া হয়েছে। ওস্তাদ রেখে শেখানো হয়েছে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও নৃত্য। চৌষট্টি কামকলা ছাড়াও কি ভাবে পান-তামাক পাতায় আফিম মেশাতে হয়, মদপাত্রে পরিবেশন করা, শাহজাদার মতিগতি অনুযায়ী মেপে মেপে মধুর স্বরে কানের কাছে ঠোঁট রেখে কথা বলা, হাসির ভঙ্গিমা সব কিছুই আলাদা করে শেখানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, মেহজাবীনের মুখে বা শরীরে যেন কোন রকম দুর্গন্ধ না থাকে তার জন্য বিশেষ পদের খাবার বিশেষ মসলার অনুপাতে রান্নার দেখভাল নিজেই করতো বুলন্দ। তার শারীরিক সৌন্দর্যকে কি ভাবে আরো আকর্ষণীয় রাখা যায় তার জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকতো বুলন্দ। প্রথম মেহজাবীনকে মুরাদের কাছে পেশ করা হয় যখন শাহজাদা ওয়াঙ্কানের জঙ্গলে সপ্তাহকালের জন্য সিংহ শিকারে যান। সচরাচর তিন হতে চারজন মেয়ে থাকে এই জাতীয় প্রমোদ ভ্রমণে। কিন্তু সেই শিকার যাত্রায় বুলন্দ ইচ্ছে করেই শুধু একা মেহজাবীনকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। মুরাদ যেন নিবিড়ভাবে মেহজাবীনেই মনোনিবেশ করেন সেটাই ছিল আসল উদ্দেশ্য। বুলন্দের উদ্দেশ্য শতভাগ সফল হয়েছিল। মেহজাবীন পুরো শিকার যাত্রায় মুরাদের পাশবিক অত্যাচার মুখ বুঁজে খুব দক্ষতার সঙ্গে সহ্য করার পুরস্কারস্বরূপ মুরাদের হারেমের কনিষ্ঠতম উপপতœী হবার প্রস্তাবও পেয়েছিলেন। কিন্তু বুলন্দের অসম্মতির কারণে তা সম্ভব হয়নি। আরো বড় কিছু আদায় করার ফন্দি তখন হতেই ঘুরছিল বুলন্দের মাথায়। এই মেয়েই পারবে মুরাদের রিপুকে পুরোপুরি কাবু করতে তা বুঝে নেয় সে। গোলাপ জলের চৌবাচ্চায় গোসল করে উঠলেন মেহজাবীন। প্রথমে তার হাতের কব্জি, কানের তালু, উরুসন্ধি, ঘাড়ে হাল্কা মিষ্টি সুগন্ধী তেল লাগিয়ে দেয়া হলো। বুলন্দ তার জন্য আনালো শরীর ও কোমরের মাপে আঁটসাঁট টকটকে লাল সিল্কের পিঠখোলা চোলি আর ঘাঘরা। গলায় জড়ালো ঢাউস আকারের একটা হীরা খচিত নক্ষত্রের দ্যূতিতে উজ্জ্বল গলাবন্ধ হার। খোলা চুল গড়িয়ে পড়লো ওড়না ছাপিয়ে পিঠজুড়ে। স্বর্ণখচিত পাল্কিতে উঠলেন মেহজাবীন। দুইজন দাসী তাকে নিয়ে চললেন মুরাদের খাস কামরার দিকে। সঙ্গে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো বুলন্দ। -হুজুর, দাসী মেহজাবীন আপনার সেবায় প্রস্তুত, ঘোষণা দিল বুলন্দ। মুরাদ আধশোয়া হয়ে শুয়ে ছিলেন মখমলের খাটিয়ায়। অতিরিক্ত আফিম আর সুরা পানে ঠিকমতো চোখ খুলে রাখতে পারছেন না। চোখ টিপে ইশারায় বেরিয়ে যাবার আগে মেহজাবীনের কানে কানে ফিসফিস করে বুলন্দ বললো, ‘মনে থাকে যেন যা শিখিয়েছি।’ দূরে ঘোড়সওয়ারদের খুরের আওয়াজ শোনা গেল। কাছে কোথাও লক্ষ্মীপেঁচা ডেকে উঠলো শিকারের খোঁজ পেয়ে। গুজরাটের এই রাত কি অনেক দীর্ঘ? মেহজাবীন আলতো করে মুরাদের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিলেন। ফিসফিস করে মুরাদের ঠোটের কাছে ঠোট ঘেঁষে মৃদু ঘণ্টাধ্বনি-তরঙ্গে লহর তুলে বললেন, ‘শাহজাদা, আমাকে চিনতে পেরেছেন?’ চলবে...
×