ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রফিকুজ্জামান রণি

নক্ষত্রের সৃজন বিক্ষোভ থেকে নির্গত কবি

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

নক্ষত্রের সৃজন বিক্ষোভ থেকে নির্গত কবি

‘একটি শিশুর রূপে আমাকেই দেখি/জীবনের ভুবনের দেয়ালের কাছে/ চূর্ণিত হবার জন্যে পড়ে আছি/ কর্কটের রোগে/ ফুলে ঢেকে দেবো পৃথিবীকে/ এবার যদি বেঁচে যাই/ যদি/ বাঁচি’ মৃত্যুশয্যায় শুয়ে, পরলোকের ওম শরীর থেকে ছেঁটে ফেলার বাসনা নিয়ে; বেঁচে থাকার জন্যে যে কতটা তীব্র আকুতি ব্যক্ত করে গেছেন কবি সৈয়দ শামসুল হক- সে বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় তাঁর ‘হ্যারো বিপণি-বিতানে’ শীর্ষক শিরোনামের কবিতাটির শেষাংশ পাঠের মধ্য দিয়ে। ভোগ-বিলাস, অর্থ-আভিজাত্যের লালসা কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেননি তিনি, কেবলমাত্র সাহিত্যের স্বর্ণমাঠকে রাঙিয়ে তুলতে; নিজের কর্মযজ্ঞকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং সৃষ্টিশীল জগতকে আরও বেশি গন্ধমধুর করে তোলার প্রত্যয় নিয়েই সৈয়দ হক দীর্ঘজীবী হতে চেয়েছিলেন। বয়েসের দিক বিবেচনা করলে তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন, তবে লালনভক্ত কবি সৈয়দ শামসুল হক মরমি সাধক লালন শাহ্র মতো অন্তত ১১৬ বছর বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন; এ ব্যাপারে দেশের একটি খ্যাতিমান দৈনিক পত্রিকার সাময়িকীতে সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন- ‘লালন শাহ বেঁচেছিলেন ১১৬ বছর আমি সেদিকেই তাকিয়ে আছি।’ বাংলা ভাষার অমর কথাকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চেয়েছিলেন অন্ততপক্ষে তিনশ’ পৃথিবীতে টিকে থাকতে, নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদও চেয়েছিলেন দীর্ঘজীবন লাভ করতে। তাছাড়া ‘আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে আমি অমর হতাম’ ইংরেজী সাহিত্যের নৈরাশ্যবাদী ও ক্ষণকালীন প্রজাপতি কবি জন কীটসের এই খেদ্যোক্তি থেকে আমরা এটাও ধারণা করতে পারি যে, ঘাতকব্যাধি যক্ষ্মা গলায় ঝুলে থাকার পরও আরও কিছুদিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি, কুড়িয়ে আনতে চেয়েছিলেন হাজারো নৈরাশ্যময় অধ্যায়ের মধ্য থেকে একরত্তি আলোর নুড়ি। কিন্তু প্রকৃতি বড় নির্দয়, নির্মম ও একরোখা! কারও ইচ্ছের বিন্দুমাত্র মূল্যও তার কাছে নেই। প্রকৃতি তাই ইলিয়াস-হুমায়ূন এবং জন কীটস্রে তুলনায় সৈয়দ শামসুল হককে কিছুটা বেশি সময় পৃথিবীর আলো-বাতাসে হেঁটে বেড়ানোর সুযোগ দিলেও আশির কোঠা ছাপিয়ে উঠতে না উঠতেই তাঁকেও কেড়ে নিতে উদ্যত হয়ে উঠলো যেন এবং বাধ্য ছেলের মতো সে ডাকে সাড়া দিয়ে একদিন চলেও গেলেন অমৃতের পুত্র তিরিশ-উত্তর বাংলা সাহিত্যের সফল সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক। আশ্চর্য-পরিতাপ এবং দুর্লঙ্ঘনীয় সত্য এই যে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ এবং সৈয়দ শামসুল হকের মতো দীর্ঘায়ুপ্রত্যাশী, প্রবাদপ্রতিম লেখকত্রয়ী-ই প্রায় একই রোগে চলে গেলেন পরোপারে- ক্যান্সার! ‘বাংলা সাহিত্য অতীতে এবং বর্তমানে প্রতিভাবান অনেক লেখকের সৃষ্টিসম্ভারে সমৃদ্ধ হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন কবি, কেবল ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার, কেউবা প্রসিদ্ধ হয়েছেন নাটক লিখে, কারও খ্যাতি অর্জিত হয়েছে প্রবন্ধকার ও সমালোচক হিসেবে, কারও ভাগ্যে খ্যাতি জুটেছে অনুবাদক হিসেবে। একই সঙ্গে এসব সৃজনশীল ও মননশীল সাহিত্যচর্চায় সফল হয়ে অমরতা লাভ করেছেন রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথ সৃজনশীলতার বিচিত্র বিকাশে ছবিও এঁকেছেন এবং গীতিকার ও সুরকার হিসেবে অমর হয়েছে। তাঁর চিঠি সাহিত্যও উল্লেখের দাবি রাখে সাহিত্যগুণের জন্য। রবীন্দ্রনাথের মতো সবগুলো ক্ষেত্রে না হলেও নজরুল ইসলাম সাহিত্যের অনেক শাখায় সফলভাবে বিচরণ করে জনপ্রিয় হয়েছেন এবং স্মরণীয় হয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলামের পর বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে যিনি বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন, তিনি সৈয়দ শামসুল হক। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পর তার সঙ্গে তুলনীয় লেখক পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আর কেউ জন্মাননি।’ বাংলা ভাষার শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই-এর উপর্যুক্ত মন্তব্যে ক্ষুদ্রপরিসরে হলেও সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক সম্পর্কে বিস্তীর্ণ এবং সারসংক্ষেপ ধারণা পাওয়া যায়। সৈয়দ শামসুল হক সম্পর্কে তার এ মূল্যায়ন অবশ্যই যথার্থ ও গ্রহণীয় মনে করা হলে তা বাড়িয়ে বলা হবে না। সেইসঙ্গে বিশ্বনন্দিত কথাকার আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটি বক্তব্য তো সৈয়দ হকেদের মতো ব্যক্তিদের দিকেই ছুড়ে দেয়া যায়Ñ ওঃ’ং হড়হব ড়ভ ঃযবরৎ নঁংরহবংং ঃযধঃ ুড়ঁ যধাব ঃড় ষবধৎহ ঃড় ৎিরঃব. খবঃ ঃযবস ঃযরহশ ুড়ঁ বিৎব নড়ৎহ ঃযধঃ ধিু. কবি আহসান হাবীব তাঁর নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে যেমন দৃঢ়চিত্তে বলেছিলেন ‘আমি কোনো আগন্তুক নই’। তিনি যে মনেপ্রাণে কতটা বাঙালী ছিলেন কাব্যে সে কথা তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নান্দনিকভাবে। এ দেশের ফুল-পাখি, চন্দ্র-তারা, নদী-নালা, কীটপতঙ্গ, আলো-বাতাস, পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং ঝোপ-জঙ্গলের পশুপাখিটিও যে তাকে খুব ভালো করেই চিনে এবং তাঁর বাঙালিত্বের পরিচয় জানে সে কথা তিনি কবিতার ভাষায় পাঠককে জানিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। বক্ষমাণ রচনার প্রয়োজন নিরিখে আহসান হাবীবের ‘আমি কোন আগন্তুক নই’ কবিতা থেকে কিছু অংশ পাঠ নেয়া যেতে পারেÑ ‘আসমানের তারা সাক্ষী/ সাক্ষী এই জমিনের ফুল,/ এই নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী/ সাক্ষী এই জারুল জামরুল,/ সাক্ষী পূবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের পালে/ স্থিরদৃষ্টি মাছরাঙা আমাকে চেনে/ আমি কোনো অভ্যাগত নই/ খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই/ আমি কোনো আগন্তুক নই/ আমি ছিলাম এখানে,/ স্বাপ্নিক নিয়মে এখানেই থাকি আর/ এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকাÑ সারা দেশে।/ আমি কোনো আগন্তুক নই।/ এই খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘক্লান্ত বিকেলের পাখিরা আমাকে চেনে/ তারা জানে আমি কোনো অনাত্মীয় নই।/.../ আমি জমিলার মার শূন্য খা খা রান্নাঘর শুকনো থালা সব চিনি/ সে আমাকে চেনে/ হাত রাখো বৈঠায় লাঙ্গলে, দেখো/ আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীরে।’ এক্ষেত্রে কবি সৈয়দ শামসুল হককে দেখা যায় আরো ব্যতিক্রম ঢঙে, ভিন্নস্বরে এবং তীক্ষèউচ্চারণে এ দেশের ইতিহাস ঐহিত্য এবং পূর্বজনদের অতীত কীর্তিকে স্মরণ করিয়ে দিতে দিতে ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় নিজের পরিচয় তুলে ধরতেÑ ‘আমি জন্মেছি বাংলায়/আমি বাংলায় কথা বলি।/আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।/ চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।/ তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?/ আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে/ আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।/ আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে/ আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।/ এসেছি বাঙালী পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে/ এসেছি বাঙালী জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।/ এসেছি বাঙালী বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে/ এসেছি বাঙালী আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।/ আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে/ আমি তো এসেছি ‘শ্যামলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে/ আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে/ আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।’ সৈয়দ হককে নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা, সত্যমিথ্যের মিথ বাজারে চালু আছে; এ জাতীয়, হারকিসিমের আলোচনা-সমালোচনা থেকে সোনালি কাবিনের কবি আল মাহমুদও রেহাই পাননি; কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদও না। তাছাড়া নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও এমনটা বহুচর্চিত হয়েছে, শনিগোষ্ঠীর হাত থেকে, সজনীকান্তের দল থেকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও কম ভর্ৎসনা কুড়াননি। জীবদ্দশায় একজন জীবনানন্দ দাশকেও কি আমরা ঠিকমতন চিনতে পেরেছি? জীবৎকালে ‘ফিরে এসো চাকা’র বিনয় মজুমদারকেও কি আমরা কম কটাক্ষ করেছিলাম? আসলে যার ভেতরে লেখকসত্তা, শিল্পসম্ভার ও কবিমানস আছে, আছে মৌলিকত্ব; তার কাছে কোনো আলোচনা-সমালোচনাই ধোপের বাড়িতে টেনবে নাÑ এটাই চিরন্তন সত্য। হয়তোবা সৈয়দ হককের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটবে না। যুদ্ধের দিয়েই প্রতিনিয়ত মানুষ বেড়ে ওঠেÑ এটা ভালো করেই তিনি জানতেন। সৈয়দ হক ‘স্থাপিত এ পরাবৃত্তে’ শিরোনামের সুদীর্ঘ কবিতায় যুদ্ধের যে নান্দনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন এককথায় সেটা তুলনারহিত। যুদ্ধ মানেই যে রক্তপাত আর অশ্রুপাত এমন নয়। জীবনের বর্ণিল ঢেউয়ের মতো যুদ্ধ এবং যুদ্ধ-ক্ষেত্রেরও যে রয়েছে হাজার হাজার রং, পট ও পটভূমিÑ তা সৈয়দ শামসুল হকের পূর্বে কে বলেছেন কোনকালেÑ বাস্তব তো এই : যুদ্ধের আলাদা কোনো ক্ষেত্র নেই। একটি পায়ের ছাপ, ইতিহাসের একটি দিন, একটি নারীর জন্যে অপেক্ষা যার গর্ভে বীজ, একটি কবিতার জন্যে শব্দের পেছনে অবিরাম।’ সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের পরিচয় একটা নয়। অজস্র। বাংলা ভাষার পাঠকদের সামনে তাঁকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার বিষয়টা চিন্তায় আনাও বালখিল্যতার শামিল। তারপরও একজন দক্ষ গল্পকার হিসেবে তাঁর যে সৃষ্টির প্রাণপ্রাচুর্য, সেখান থেকে কিঞ্চিৎ অনুভূতি ব্যক্ত করার প্রয়াস নেয়া যেতে পারে। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে, দেশের ঐতিহ্যবাহী এবং সুপ্রাচীন জাতীয় পত্রিকা দৈনিক সংবাদের ৫৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রকাশিত তাঁর একটি গল্প ‘ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়’ সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে। উত্তমপুরুষে লেখা পুরো গল্পটিতে আহামরি কোনো ঘটনার পরম্পরা নেই, তবুও লেখকের বর্ণনাশৈলী, গল্পের বুনন-বিন্যাস এবং পর্যবেক্ষণশক্তির দিকে তাকালে মুগ্ধতার শুমার থাকে না। ক্ষুদ্রবিষয়ের কী নান্দনিক উপস্থাপন! দৌলতিয়ার ফেরি জাহাজের জন্যে আরিচা ঘাটে অপেক্ষমাণ এক নিঃসঙ্গ পথিকের খ-কালীন মুহূর্তের বর্ণনা পাওয়া যায় পুরো গল্পে, সঙ্গে আরো ক’জন নারীপুরুষের বর্ণনাও। জাহাজটি ঘাটে ফেরা পর্যন্ত যাত্রীদের যাত্রাবিরতিকালে অবতীর্ণ হওয়া দু’একটা ছোটখাটে দৃশ্যকে গল্পের ক্যামেরায় নিখুঁতভাবে ধারণ করেছেন তিনি। বিষয়টা একেবারেই সাদামাটা এবং অহরহ ঘটে চলা মানবজীবনের ঘটনাপ্রবাহ কিন্তু এরমধ্যেও যে অসাধারণ গল্পের পট লুকিয়ে থাকে তা সৈয়দ হকদের মতো বিদগ্ধজনেরাই কেবল দেখতে পান। যেহেতু উত্তমপুরুষে বর্ণিত তাই আলোচ্যমান গল্পটি পাঠ নিতে গিয়ে প্রথমদিকে পাঠক যতবেশি সামনে অগ্রসর হবেন তত বেশি লেখক তথা গল্পের নায়ক সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করবেন। লেখকের চরিত্র সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলে ধরতে পারেন অনভ্যস্ত কোনো কোনো পাঠক। কেননা, এখানে একটি অপরিচিত মেয়ের দিকে তার এমন শ্যেনদৃষ্টি কাম্য নয়, কাম্য নয় মেয়েটির শরীরের স্পর্শকাতর স্থানের খোলামেলা বর্ণনা। কিন্তু গল্পের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সে ধারণা একেবারেই রহিত হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় নায়কের প্রতি দারুণ এক মমতাবোধ। মনে হয় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নায়ক কোনো অন্যায়ই করেনি, এ নজর একেবারেই স্বাভাবিক ঘটনামাত্রÑ বলা যায় এটাই লেখকের সৃষ্টির সম্মোহনী শক্তি। শেষদিকে এসে লেখক যখন বলেন ‘আমার স্মরণ হয়, এই প্রথম আমি একা বেরিয়েছি গাড়ি নিয়ে। একা। শুধু আমি। আজ আমার স্ত্রী সঙ্গে নেই। এই প্রথম সে নেই। ঊনচল্লিশ দিন আগে আমার স্ত্রী মারা যায় স্তনের ক্যান্সারে। আগামীকাল তার কুলখানি। আমি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি। সেখানে তার কুলখানি হবে।’ তখন পূর্বের ঘটনাপ্রবাহ মনে থাকে না, উল্টো বরং নায়কের প্রতি করুণা বর্ষিত হয়। একটু আগেই একই ব্যক্তি যে বলে গেলেনÑ ‘মেয়েটি এবার আকাশের দিকে মাথা তুলে ঢকঢক করে কোক গিলতে লাগলো। আকাশের দিকে মুখ তোলার সময় হাতও উঠেছিলো তার বোতল সমেত। তখন বুকের শার্ট তার উঁচু হয়ে উঠলো। কোমরের গোলাপি রঙের বেল্ট বেরিয়ে পড়লো। স্তন দুটো ঠেলে উঠলো, যেন প্রতিবাদে, যেন তারাও খাবে কোক।...মেয়েটি গলা নামালো, বোতল নামালো, তৎক্ষণাৎ তার বুকের ওপর ঢিলে শার্ট ঝুলে পড়লো। স্তনের উচ্চতা মিলিয়ে গেলো শার্টের ভেতরে। ঠিক তক্ষুণি একটা জোর বাতাস উঠলো। বাতাস যেন বললো, আরে আমি তো ভালো করে দেখতেই পাইনি। তাই সেই বাতাসের দাপটে মেয়েটির বুকের বল দুটো আবার উঁচু হয়ে দেখা দিলো। বাতাস এবার বড় অসভ্যতা করলো। শার্টে চেপে ধরে বল দুটোকে ফুলিয়ে রাখলো।’ গল্পের শেষসীমানায় দাঁড়ালে এই কথাগুলোও একেবারেই হালকা হয়ে যায়, মনেই থাকে না এসব অশ্লীল কোনো মুখের উচ্চারণ! তাছাড়া পূর্বের দেখা দৃশ্যগুলো মানুষ হিসেবে তিনি দেখতেই পারেন, এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হোক কিংবা অন্য কিছুই হোকÑ মানুষের তো আর চোখ পকেটে রাখা সম্ভব নয়। তবে শালীনদৃষ্টি বলেওতো কিছু একটা থাকা দরকার। এই গল্পে তেমন প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক কিন্তু সেই দৃশ্যের আড়ালেও যে মৃত স্ত্রীর প্রতি নিগূঢ় ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল তা আরও একটু এগুলে চোখে পড়েÑ ‘পিলার থেকে পাছা তুলে তরুণী মেয়েটি বুকের ওপর তার শার্ট ঢিলে করে টেনে দেয়। নদীর বুক ভেঙে ফেরি জাহাজের ভোঁ শোনা যায়। আমি আমার স্ত্রীর কথা স্মরণ করে উঠি। ওগো, আমি মরে গেলে তুমি আর কারও দিকে চোখ দেবে না তো? পরক্ষণেই হতভাগা স্ত্রীর স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে, একজন পতিœহারা স্বামীর আকুতি নিয়ে এবং নিঃসন্তান পিতার যন্ত্রণার কথা জানান দিয়ে; বুকের সমস্ত কষ্ট ঢেলে তিনি বলে ওঠেনÑ ‘আমাদের কোনো সন্তান নাই। আমাকে সে স্তন দিয়েছিল, সন্তানকে দেবার মতো ভাগ্য হয় নাই রাহেলার।’ তারপর বোধহয় অশ্লীলতা কিংবা অশালীনতার প্রশ্নটা পুরোপুরি তামাদি হয়ে যায়। সৈয়দ হকের আরও একটি চমৎকার গল্পের কথা বলা যেতে পারেÑ ‘কোথায় ঘুমোবে করিমন বেওয়া’। গল্পটির একাংশে নারীসমাজের অসহায়ত্ব, তাদের প্রতি নৃশংস আচরণের বাস্তবিক রূপ তুলে ধরতে গিয়ে বড় আক্ষেপ ঢেলে তিনি যখন বলেনÑ ‘যুবতীরা আজকাল বড় বেশি খুন হয়। কেউ তাদের কাছে শরীর না পেয়ে খুন করে, কেউ তাদের বাবা-মায়ের কাছে যৌতুক না পেয়ে খুন করে।’ তখন ঘাতকের অট্টহাসি আর বিষদাঁত দেখে স্বাধীন রাষ্ট্রের মানুষেরও মনে ভয় সঞ্চারিত হয়। এখনো এরকম দৃশ্য কম উদয় হয় না, ফলে দিনে দিনে স্বাধীনতার সুফল ভোগ করার অধিকার থেকে যেন বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে এদেশের মানুষ এবং ঘাতকদের কাছে বার বার জিম্মি হয়ে হচ্ছে মানবতা, অপদস্থ হচ্ছে সততা। ‘কোথায় ঘুমোবে করিমন বেওয়া’ এই গল্পের দিকে তাকালে সে চিত্রই আমরা দেখতে পাই। এই গল্পে আঞ্চলিক ভাষা এবং প্রমিতভাষার যৌথমিশ্রণ বড় নান্দনিক। পুরো গল্পটাই একজন নারীর রহস্যঘন লাশকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। যে নারীর পরিচয় ইতোমধ্যে কেউ জানতো না, সে নারীর পরিচয় জানার পর এবং সমাজের নির্মম আচরণ দেখার পর ‘আমরা বিকটভাবে আবিষ্কার করি, করিমন বেওয়া আমাদেরই পাশে ঘুমিয়ে আছে, কারণ সে আর কোথায় ঘুমাবে?’ গল্পের শেষান্তে লেখক এমন আক্ষেপ মেশানো বক্তব্য ছুড়ে দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন মুখোশপরা ভদ্রসমাজে একজন অসহায় নারীর জীবন কতটা তুচ্ছ, কতটা হিংস্র সমাজ ও রাষ্ট্রের ভদ্রবেশি মানুষগুলো। সেই সঙ্গে দেখা যায়Ñ ষড়যন্ত্র, রাজনীতি আর ফতোয়াবাজির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে একজন অসহায় নারী মৃত্যুর পরও নিগৃত হওয়ার ভয়ঙ্কর দৃশ্যÑ ‘লোকটি বলে, হবে আবার কী? ভোটে জিতেও তার খায়েশ মেটে নাই, সে এখন প্রতিশোধ নিতে চায়, আমাদের মসজিদের মওলানা সাহেবকে সে বলে দিয়েছে, করিমন বেওয়ার জানাজা হবে না, কারণ এই যে শিশুটিকে দেখছেন এটি নাকি করিমনের জারজ সন্তান। তার স্বামী মারা যাবার পর পেটে আসে। কিন্তু এত বড় ডাহা মিছে কথা আর নেই, কারণ মানুষের স্মরণশক্তি এখনও একেবারেই নষ্ট হয়ে যায় নাই। এই শিশুটিকে মওলানা সাহেবের সাক্ষাতেই, তার হাত ধরে পোষ্য নিয়েছিল করিমন। এখন সে কথা মওলানা সাহেবকে স্মরণ করিয়ে দেয় কে?’ কবি সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে, ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র আঠারো বছর বয়েসে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্য ‘একদা এক রাজ্যে’। ছয় দশকের দীর্ঘ পরিক্রমায় তিন শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। যতদিন বেঁচে ছিলেন অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে কাটিয়েছেন লেখকজীবন। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের খেদ নেই, আছে গর্ব। কেননা, জীবনের শেষ দিনটিতেও তাঁর হাত থেকে কলম খসে পড়েনি। জাত লেখক না হলে কিংবা সাহিত্যের প্রতি নির্মোহ টান না থাকলে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করে কেউ সবকিছুকে তুচ্ছজ্ঞান করে লেখালেখিতে এতটা মনোযোগী হতে পারেন না। ‘মৃত্যুর কথা নিশ্চিত জেনেও কবিতা লেখা কেবল আবুল হাসানের ক্ষেত্রেই সম্ভব’Ñ বাংলা ভাষার ক্ষণজন্মা কবি আবুল হাসানকে উদ্দেশ্য করে প্রদান করা একুশের ফেরারি কবি আল মাহমুদের এই বক্তব্যটি শুধুমাত্র আবুল হাসানের জন্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা যেন এখন শতভাগ প্রযোজ্য হয়ে গেলো সৈয়দ শামসুল হকের বেলায়ও। গত ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে, মঙ্গলবার শরীরিকভাবে না ফেরার দেশে চলে গেছেন নক্ষত্রের সৃজন বিক্ষোভ থেকে নির্গত কবি সৈয়দ শামসুল হক। রেখে গেছেন তাঁর সৃষ্টি ও আদর্শ। বৈশাখ ১৪১৯ সংখ্যায় বাংলা একাডেমির মাসিক সাহিত্যপত্র ‘উত্তরাধিকার’-এ প্রকাশিত সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘অপার্থিব তাঁতের বয়ন’ শিরোনামের একটি দীর্ঘ কবিতার শেষ কটি লাইন তাঁকে উদ্দেশ্য করেই উচ্চারণ করে আলোচনার ইতি টানা যেতে পারে- ‘তুমি সেই ব্যক্তি/ যার জন্ম যেন কোনো এক নক্ষত্রের/ সৃজন বিক্ষোভ থেকে নতুন নির্গত/ গ্রহ, একই সঙ্গে চাঁদটিও তার। জেনো,/ এখন অপেক্ষা শুধু অক্ষপথটিকে/সমূহ নির্ণয় করা, জেগে ওঠা, বাঁচা,/ ফলিত আলোয় মুখ মেজে নেয়া, আর/ অপার্থিব তার তাঁতের বয়নে পাওয়া/ বস্ত্র পরে জীবনের সামগীত গাওয়া॥’
×