ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হারুনর রশীদ

রোদ

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

রোদ

-মুক্তিযুদ্ধ মানে কি বল্তো। -জয় বাংলা। গ্রীষ্মের দুপুর। যখনকার কথা তখনও এই কুরিপোল গ্রামে বিদ্যুতের দেখা মেলেনি। গ্রামের আম বাগানগুলোর মধ্যে অবশিষ্ট চিহ্ন হিসেবে রক্ষা পাওয়া লুৎফরদের এই আম বাগানের ছায়ায় ছোটরা যখন এমন বাকযুদ্ধে লিপ্ত তখন সেখানেই বড়দের মধ্যে লুৎফর নিজে বন্ধুবান্ধব নিয়ে মাদুর পেতে বসে তাস পিটছে। সকলের খুব শ্রদ্ধার মানুষ দুই প্রৌঢ় স্কুল শিক্ষক আকরাম মাস্টের আর মতিন মাস্টের বসেছেন এক জায়গায় দাবা নিয়ে। আরেক জায়গায় উঠতি রাজনৈতিক কর্মী আনু বসেছে খেজুর আলি মুহুরির সঙ্গে লুডো খেলায়। আসান আর সুকচাঁদ আরও দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে খেলছে ক্যারাম। কেউ বা পড়ছে বই বা দৈনিক কাগজ। কোথাও আবার কেউ কেউ গোল হয়ে বসে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবে আছে মেতে। আনু ছোটদের কথা শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় এবং হালকা হাসির সঙ্গে বলে, দ্যাখো কা-। মুক্তিযুদ্ধ মানে নাকি জয় বাংলা! আকরাম মাস্টের দাবার ঘুঁটি চালান দিয়ে মুখ তোলেন, খারাপ তো বলেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওটাই তো ছিল একমাত্র মন্ত্র, একমাত্র শক্তি। এমন সময় তাস খেলুড়ে লুৎফরের কিশোরী নাতনি ছোটদের দল থেকে ছুটে এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যাজার মুখে জিজ্ঞেস করলো, নানা, নানা। আমি না সেদিন রোদেলা বুয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি মুক্তিযোদ্ধা না বীরাঙ্গনা? সে কোনো উত্তর না দিয়ে আমাকে ধমক দিয়ে বললো, যা ভাগ্। তুমি বলোতো নানা, সে আসলে কী? আকরাম মাস্টের দাবার চাল দিতে ভুলে গিয়ে কিশোরীর দিকে তাকিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কথাগুলো শুনলেন এবং তারপর নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেখান থেকে উঠে গেলেন। আমবাগানের ছায়াশীতল পরিবেশটি হঠাৎই যেন ছন্দ হারালো। আনু মতিন মাস্টেরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিসফিস কণ্ঠে বললো, জানেন স্যার, রোদেলার গর্ভে জন্ম নেওয়া আর ক্যানাডায় দত্তক হিসাবে মানুষ হওয়া সেই মেয়েটি এতো বছর বাদে মায়ের খোঁজে এই গ্রামে আসার পর থেকেই গ্রামের ছেলেবুড়ো যেন নতুন করে মুক্তিযুদ্ধকে আগলে ধরতে চাইছে। ভেবে দ্যাখেন ঠিক বললাম কিনা। মতিন মাস্টের শুধু ‘হুম’ উচ্চারণ করে তার দিকে তাকান। আনু বলে চলে, ভেবে দ্যাখেন, সেই মেয়েটা তার ইংরেজ স্বামীকে নিয়ে এসেছিল বছরখানেক আগে। পত্রপত্রিকায় তখন তার সব কাহিনী ছাপা হয়েছিল। রোদেলার সঙ্গে তার ছবিও ছাপা হয়েছিল। তখন থেকেই মানুষ যেন সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো। কি বলেন স্যার? মতিন মাস্টের আবারও ‘হুম’ বলে পাশে লুডো খেলা দেখার উদ্দেশ্যে সেখান থেকে সরে গেলেন। আকরাম মাস্টের একটু দূরে গাছের গুঁড়িতে বসে এক যুবককে খবরের কাগজ পড়তে দেখে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। এতো মনোযোগ দিয়ে কি পড়ছো হে? মুক্তিযুদ্ধের উপরে একটা ছোটগল্প স্যার। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে। তাই? পড়বেন স্যার? তোমার পড়া হয়ে থাকলে দাও দেখি। যুবক কাগজটা এগিয়ে দিলে তিনি সেটা হাতে নিয়ে সেখানেই বসে পড়ে চোখের সামনে মেলে ধরেন। গল্পের নাম ‘রোদ’। * * * পাল তোলা ছইবিহীন নৌকাটি ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে মৃদু মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে। সঙ্গে আছে মাঝির বৈঠা টানার অল্পবিস্তর শব্দ। এ ছাড়া সবকিছুই যেন নিঃশব্দ। বিশ্ব চরাচর যেন নীরব-নিথর। পাটাতনে মাথা গুঁজে বসে আছে নয়ন। মাঝেমধ্যে শুধু মৃদু শ্বাস ফেলে মাথা তুলে চারদিকে তাকায়। আকাশে বাতাসে সর্বত্র ছড়ানো এক পীতাভ বিষণœতা। শিরদাঁড়া বেয়ে এক ধরনের ভয়ের শিহরণ বয়ে যায়। কিন্তু কিছুতেই তা প্রকাশ হতে দেওয়া যায় না। নৌকার গলুয়ের দিকে তার মতো আরও দুটি যুবক গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে। ওরই মতো ফ্যাকাশে চেহারা হলেও একরকমের দীপ্তি আছে চোখেমুখে। ওরা নিজেদের মধ্যে কখনও সখনও ফিসফাস করছে, এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কিন্তু কারো মুখে উচ্চৈঃস্বরে কথা নেই। নয়নের সঙ্গে তো নয়ই। হঠাৎ চোখে চোখ পড়লে স্বাভাবিক লয়ে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া শুধু। এ এক বৈরী সময়ের নাটুকে খেলা! সবারই চোখেমুখে অজানা ভয়। সবাই আজ ভয়ানক বিপন্ন। কে কার শত্রু, কে কার মিত্র বোঝা দায়। অপরিচিত কারো সঙ্গে কথা বলার সাহস নেই কারও। ওরা দুজন মনে হয় একই দলের। নয়নকে ভাবনায় পেয়ে বসে - আচ্ছা, আমি যেমন ওদের কথা ভাবছি, ওরাও কি আমার সম্বন্ধে কিছু ভাবছে? ওরা যদি অন্য পক্ষ হয়ে থাকে তবে কি ওদের হাতেই আমাকে এই নৌকাতে প্রাণ হারাতে হবে আজ? নয়ন এবার শূন্যে তাকিয়ে বিপরীত ভাবনা ভাবতে থাকে- তা না হয়ে ওরাও কি আমারই মতো মা, মাটি আর দেশের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য জীবনপণ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে! হঠাৎ এমন কথা ভেবে নয়ন পুলকিত বোধ করে। দেখলো, মনে তাতে বেশ সাহস ধরে। উজ্জীবিত মন বলে ওঠে, সাব্বাস্! আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা! নৌকার বুড়ো মাঝি সাহসে ভর করে আরিচা-গোয়ালন্দ লোক পারাপার করছে। পারাপারের লোকগুলো কি ভিন্ন ধরনের? ভিন্ন চেহারার? ভিন্ন মনের? হয়তো বা হবে। লঞ্চ বা ফেরির চলাচল যা আছে তা খুবই সীমিত আর অনিয়মিত। তাছাড়া মিলিটারি পাহারার বাড়াবাড়িও খুব। তাইতো এ চর সে চরের ধার ঘেঁষে কাশবনের আড়াল দিয়ে এই পারাপারের ব্যবস্থা। নয়ন মনে মনে মাঝির প্রশংসা করে, সাব্বাস বুড়ো! তুমিও এদেশের এক অখ্যাত সূর্যসন্তান। তুমি নিজের জীবন বাজি রেখে এইসব অসহায় হবু মুক্তিযোদ্ধাদের একটা গতি করতে নেমেছো। তুমি কি প্রকৃতই মাঝি, না এ তোমার ছদ্মবেশ! নয়ন মনে মনে ঠিক করে, কোনো মতে কুষ্টিয়া পৌঁছাতে পারলে প্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হলো ঢাকায় একটা সংবাদ দেওয়া যে, সে ভালো আছে এবং গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে ভালোভাবেই কুষ্টিয়া পৌঁছেছে। না হলে বাসার সবাই চিন্তায় থাকবে। কিন্তু কীভাবে সংবাদ পাঠাবে এইসব ভাবতে ভাবতে রোদেলার কথা মনে পড়ে যায়। এইতো মাত্র সেদিনের কথা। অগুনতি মেলামেশা দেখা সাক্ষাতের শেষটির কথা। সেদিন শীতের অপরাহ্ণে রোদেলার সঙ্গে কাটানো মিষ্টি সময়ের কথা। বোটানিক্যাল গার্ডেনের এক কোণে গায়ে নরম রোদ মেখে রোদেলার ছড়ানো পায়ের ওপর মাথা রেখে শুয়ে নয়ন। কতক্ষণ ওরা ওভাবে আছে জানে না। কথা বলতে বলতে দু’জনের কথাও যেন শেষ হয়ে গেছে। নয়নের মুখে ঘাসের কচি ডগা। নীরবে তা চিবোচ্ছে। নীরবতা ভেঙ্গে একসময় সে অস্ফুটে ডাকে, রোদ! রোদেলা অস্ফুটে উত্তর দেয়, উঁহ্? নয়ন উঠে বসে নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে রোদের হাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলে, চলো রোদ কালই আমরা বিয়েটা সেরে ফেলি। রোদের মুখে মিটিমিটি হাসি, আচ্ছা কাল আসুক তো আগে। নয়নের কণ্ঠ ক্ষিপ্ত। রোদের হাত ছেড়ে দিয়ে বলে, তাহলে চলো আজই। তোমার আজ হলো কি বলো তো নয়ন? বিয়ের জন্য হঠাৎ ক্ষেপে উঠলে কেন? সামনে দু’জনেরই এম এ ফাইনাল। হঠাৎ বিয়ে করে পড়াশুনোটা ভেস্তে দিতে চাও? নাকি আমি হারিয়ে যাবো বলে তোমার মনে ভয়? ঠিক তাই। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে বুঝতে পারছো না রোদ? ভয় পেয়ো না। যে কোনো অবস্থায় আমি চিরকাল তোমারই থাকবো। আশ্বাস দিয়ে রোদ আলগোছে তার বুকে মাথা পাতে। নয়ন রোদের ওম পেয়ে গুনগুনিয়ে ওঠে। ট্রেনে কুষ্টিয়া পৌঁছাতে সন্ধ্যে উৎরে গেল। এখন আর সড়কপথে গ্রামের বাড়ি যাওয়া সম্ভব না। নয়ন ঠিক করে, ছোটবেলার বন্ধু ঠান্টুর কাছে রাতটা কাটিয়ে দেবে। ঠান্টু আই এ পাশের পর আর লেখাপড়া করেনি। পিডব্লিউডি-তে চাকরি করে। শুনেছে, সে নিরাপত্তার খাতিরে এরই মধ্যে মেস ছেড়ে আর সব চাকুরেদের সঙ্গে সরকারী অফিসে ডেরা বেঁধেছে। কিন্তু তার কাছে যাওয়ার আগে সে কোচ স্টেশনে গিয়ে হাজির হয়। ঢাকা থেকে এখন কিছু কিছু জেলা শহরে প্রতিদিন বিশবাইশ সিটের একটি করে কোচ যাতায়াত শুরু করেছে। বুদ্ধি করে ঢাকা থেকেই একটা ডাকের খাম কিনে এনেছিল। মায়ের কাছে লেখা দু’লাইনের চিঠিটাও তার মধ্যে ভরে মুখ বন্ধ করা আছে। কে উর্দুভাষী আর কে নয় তা জানবার আগেই মানুষ এখন নিজের থেকেই উর্দুতে কথা বলতে উৎসুক। আজকে সন্ধ্যেয় আসা কোচের ড্রাইভারকে উর্দুতে ভাইয়া সম্বোধন করে অনুরোধ জানালো, আগামীকাল ঢাকায় পৌঁছে রাস্তার কোনো ডাকবাক্সে চিঠিটা ফেলে দিতে পারবে কিনা। ড্রাইভারটি বাঙালী কিনা কে জানে। তবে সেও উর্দুতেই জবাব দিল, ইতনা ছোটা সা কাম কিঁউ কর নেহি সকেঙ্গে ভাইয়া! নয়ন তার হাতে চিঠির খামটা দিল। বড়া মেহেরবানী ভাইয়া। লেকিন ভুলনা মাত। নয়নকে দেখে ঠান্টু ভূত দেখার মতো বিবর্ণ হয়ে ঢোক গেলে। পাগল হয়েছিস নয়ন? দেখছিস বটে, অফিসঘরের মেঝেয় সবার কেমন সুন্দর ঢালাও বিছানা। কিন্তু মিলিটারির কড়া অর্ডার, বহিরাগত কাউকে আশ্রয় দেওয়া যাবে না। ভাবিস না ঠান্টু, তোকে বিপদে ফেলবো না। রাত কাটাবার অন্য ব্যবস্থা আমি করে নেব। বলে পা বাড়াতেই ঠান্টু তার হাত ধরে ফিসফিস করে ঢাকার বর্তমান অবস্থা কি তা জানতে চায়। নয়নও ফিসফাস করে জবাব দেয়, অবস্থা আর কি! চারদিকে শুধু আগুন, গুলির আওয়াজ আর মানুষের মৃত্যু। এক অকল্পনীয় বিভীষিকা! রাস্তায়-ফুটপাথে, রিকশায়-ঠ্যালাগাড়িতে, বাড়ির ভেতরে-বাইরে লাশ আর লাশ। বুড়িগঙ্গা নদীতে ভেসে যাচ্ছে লাশ। কেন এতো মৃত্যু কেউ জানে না। যারা বেঁচে, তারাও জানে না কোন্ অলৌকিতায় তারা বেঁচে আছে। সামনাসামনি দেখা হলে কেউ কাউকে চিনতে কষ্ট হয়। কথা বলতে ভয় হয়। কে কার শত্রু সেই সন্দেহে দূর থেকেই যে যার মতো মাথা নিচু করে দ্রুত সরে পড়ে। এমনি এক দম বন্ধ পরিস্থিতি ঢাকা শহরের। নয়ন রুদ্ধশ্বাসে এতসব তথ্য উজাড় করে দেয় ঠান্টুর কাছে। ঠান্টুর রক্ত যেন টগবগিয়ে ওঠে। এককালে সে তার প্রেমিকার কাছে গদগদ কণ্ঠে পুরো ‘মানসী’ মুখস্থ আউড়াতে পারতো। এখনও সেই জোশে বলা শুরু করে, বাঙালী কিন্তু শেষমেশ জীবনকেই বিশ্বাস করে রে। বাঙালী চিরকাল সৃজনশীল। একদিন না একদিন আমরা জীবনকে আবার প্রাণময় করে তুলতে পারবো বলেই আমি বিশ্বাস করি। নয়নও উজ্জীবিত কণ্ঠে উচ্চারণ করে, হ্যাঁ। তাইতো আমি মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছি। মুহূর্তের মধ্যে হঠাৎই আবার রোদেলার কথা মনে পড়ে নয়নের। মনে পড়ে তার অঙ্গীকারের কথা- আমি সবসময় তোমারই থাকবো। মনে দুশ্চিন্তা জড়ো হয়, এখন কোথায় তার রোদেলা! মানসম্ভ্রম নিয়ে বেঁচে আছে তো! পঁচিশে মার্চের পর তার সন্ধানের জন্য তো নয়ন কিছুই করতে পারেনি। ট্রেনিং শেষে ফিল্ড অপারেশনে নামতে নামতে বর্ষা এসে গেল। নয়নদের গ্রুপের কমান্ডার নজরুল করিম। কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর থানার খন্দবাড়িয়া গ্রামের মানুষ। নয়ন ছাড়া আর সবাই সেই এলাকার। দলের সবার কাছে সে নজরুল ভাই। লোকটা বেশ ভালো। এলএমজি, এসএমজি, গ্রেনেড ব্যবহার তো দূরের কথা ওসবের নামও যারা কোনোদিন শোনেনি বা দেখেনি তাদের কীভাবে মন চাঙ্গা রাখতে হবে, কীভাবে তাদের দিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে তা লোকটা জানে। সেনাবাহিনীতে ছিল তো। গ্রুপের ছেলেরাও তার নামে অজ্ঞান, তার কথায় জান দিতেও প্রস্তুত। অথচ এই ক’দিন আগেও অপারেশনের নানা কাহিনী শুনে নয়নরা আঁতকে উঠতো। দেশের মায়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের একদিকে যেমন আছে অকল্পনীয় কষ্ট আর পরিশ্রম আবার অন্যদিকে আছে জীবন দিয়ে হলেও সাহসের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা। এ যেন এক এ্যাডভেঞ্চার। থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার সংস্থান নেই। আছে শুধু প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুভয়। বন্ধুকে বন্ধুর কিংবা ভাইকে ভাইয়ের লাশ কাঁধে বয়ে আনা। নয়ন এসব গল্প শুনতে শুনতে শ্বাস ফেলে বলতো, কোথায় যেন পড়েছিলাম- ‘প্রাইস্ অব লাইফ এ্যাট ডিসকাউন্ট’! এও সেরকম। কিন্তু এখন আর ওসব ওদের মনকে কোনোরকম নাড়া দেয় না। এখন ওসব ওদের কাছে কেচ্ছাকাহিনী মাত্র। এখন সবার চোখ জ্বলজ্বল করছে। সবাই যেন কোমর বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে কমান্ডারের হুকুমের অপেক্ষায় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইতে নামার জন্য যে কোনো মুহূর্তে, যে কোনো পরিস্থিতিতে। ভারি বর্ষায় এবার নদীনালা খালবিল ফুলেফেঁপে উঠেছে। কোথাও কোথাও পথঘাটও পানিতে থই থই করছে। তার উপর রাতের নিকষ কালো আঁধার। বিলের পানিও যেন ঘন কালো ইস্পাত। নিঃশব্দে তরতরিয়ে চলেছে ছিপনৌকা। ছইয়ের ভিতরে বিচ্ছুদের নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমা-ার নজরুল করিম। বিলের শেষ প্রান্তে প্রত্যন্ত এক গ্রামের উদ্দেশ্যে তাদের যাত্রা। আগের দিন নয়ন এবং তার এক সহযোদ্ধা অন্ধ ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে গিয়ে রেকি করে এসেছে। সেই পরিকল্পনামতো প্রথমে ওরা আশ্রয় নেবে এক গরিব চাষীর বাড়িতে। ভোর রাতে দলটি দু’ভাগ হয়ে অভিযানে নামবে। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের বাড়িতে আর হাইস্কুলের মিলিটারি ক্যাম্পে। চাষীর বাড়ির ঘাটলায় নৌকা বেঁধে সবাই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিঃশব্দে নেমে পড়ে। একটা পতিত গোয়ালঘরে ঠাঁই করে নেয়। চাষী বউ তার শেষ সম্বল মুরগিটি জবাই করে গরম ভাত পরিবেশন করে। ওদের সঙ্গে যে চিড়ামুড়ি আছে সেকথা সে শুনতে নারাজ। খাওয়ার সময় চাষীর সঙ্গে ফিসফিস করে টুকটাক কথাবার্তা হয়। চাষী জানায়, চিয়ারম্যানকে তো বাড়িত পাওয়া যাবে না নে। তার যুবতী মিয়া রোদেলা, ঢাকায় থাইকি ভার্সিটিত্ পড়ে। গত পরসু সাঁঝের বেলায় মিলিটারিরা তাক্ বাড়ি থিকি ক্যাম্পে তুইলি নিয়ে গিয়েছে। সেই থিকি আইজ দুইদিন মিয়াক্ ছাড়াবার জন্যি চিয়ারম্যান ক্যাম্পে পইড়ি আছে। শুনা কথা, হাজার তেল মাইখিও নাকি কিছু হচ্ছে না। তাহলি বোঝেন, চিয়ারম্যানের মিয়ারই যদি এই অবস্থা হয় তাহলি অন্য মানুষের মিয়াগের কি গতি হোতি পারে? আহারে, কী সুন্দর মিয়াডা! সমবেদনায় চাষী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ার্ত চোখে ঘরের বাইরের দিকে তাকায়। নয়ন নজরুল করিমের দিকে আড়চোখে তাকায়। নজরুল ঠিক ঠাহর করতে পারে না। তবে মনে পড়ে, নয়ন তাকে একবার কথায় কথায় বলেছিল, রোদেলা নামে এক সহপাঠীর সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক আছে। স্থির হয়, ভোরের আঁধার কাটতে না কাটতেই ওরা মিলিটারি ক্যাম্প আক্রমণ করবে। হাই স্কুলের মাত্র তিন চারটি কামরা পাকা বিল্ডিং, বাকি সব টিনশেড। কোথায় মিলিটারির অস্ত্রশস্ত্র, কোথায় টর্চার সেল, কোথায় বন্দীরা তার মোটামুটি ধারণা পাওয়া গেছে। বন্দী ছেলেমেয়েগুলোকে বাঁচাতে হলে বুঝেসুঝে আক্রমণ চালাতে হবে। কমান্ডার নজরুল করিম সবকিছুর ছক সেইভাবেই কষেছে। ভাগ্য ভালো, শেষ রাতের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। শত্রুপক্ষ আরাম পেয়ে নিশ্চয়ই অকাতরে ঘুমোবে। সেই সুযোগে কাজ সারতে হবে। হলোও তাই। ফজরের আজানের আগেই ওরা আক্রমণ করে বসলো। রাতের স্তব্ধতা ভেঙ্গে একেবারে খানখান। গ্রেনেড, গোলাগুলি- একেবারে যাকে বলে চারদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণ। শত্রুরাও কি সহজে ছাড়বার পাত্র? শুরু হয়ে গেল ক্রস্ ফায়ারিং। যার যার মতো আত্মরক্ষা করে দুই পক্ষের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে গোলাগুলি চললো। এক সময় মুক্তিযোদ্ধাদের একই সঙ্গে দু’তিনটি গ্রেনেড চার্জে টিনশেড দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। মিলিটারিরা দৌড়ে পালালো এক আধজন। বাকিরা মারা পড়লো। বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়ে সবাই মিলিটারিদের অস্ত্রশস্ত্র দখল নিতে দৌড়ালো। নয়ন নজরুল করিমের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে, নজরুল ভাই, ভিকটিমদের আগে উদ্ধার করুন। বলে সে নিজেও সেদিকে ছুটতে থাকে। এরই মধ্যে ঘটলো দুর্ঘটনা। আড়ালে লুকিয়ে থাকা শত্রুর ছোঁড়া গুলি খেয়ে নয়ন চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা সতর্কভাবে শত্রু খুঁজতে থাকে। আবারও গোলাগুলি, আবারও গ্রেনেড ছোঁড়া। তারপর একসময় নেমে আসে স্তব্ধতা। নজরুল করিম আর তার সঙ্গীরা নারীপুরুষ যারা এতোদিন এই ক্যাম্পে বন্দী ছিল তাদের উদ্ধার করে আনে। কারো শরীরেই শক্তি নেই। সবাই চলৎশক্তিহীন, বাকশক্তিহীন, প্রাণশক্তিহীন। এক কথায় মৃতপ্রায়। তবুও সান্ত¡না, তাদের উদ্ধার করা গেছে। ভোরের আবছা আলোতে চারদিকে লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। মিলিটারিদের সঙ্গে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আর কয়েকজন রাজাকারেরও মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রোদেলাকে নজরুল হাত ধরে হেঁটে আসতে সাহায্য করে। গ্রামের কিছু লোক ভয়ে ভয়ে দূরে এসে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা সেই চাষীও। তাদের দেখে মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা বলে আনন্দে ফেটে পড়ে। রোদেলা চেয়ারম্যানের প্রায় অর্ধনগ্ন লাশ দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দু’চোখে যেন ঘৃণা। কিন্তু নয়নের দেহটি চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সটান দাঁড়িয়ে পড়ে। চারদিকে দৃষ্টি ফেরায়। নজরুল করিম তার দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছে। রোদেলা সঙ্কুচিত হয়ে নিচে নয়নের দিকে তাকায়। তাকিয়েই থাকে। এক সময় তার শরীর কেঁপে ওঠে। দু’চোখ ছাপিয়ে অশ্রু ঝরে। নজরুল এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখে। তোমার নাম রোদেলা? রোদেলা নীরবে মাথা নামিয়ে নেয়। অদৃষ্টের কী পরিহাস! নজরুল বিড়বিড় করে কথাটি বলে নিজেও আড়ালে চোখ মোছে। মুক্তিযোদ্ধারা নয়নের দেহটি তুলে নিয়ে প্রস্থানের সময় বলতে থাকে, ও মাঝেসাঝে বলতো, যুদ্ধের চাইতে শান্তি ভালো। এবার সত্যিসত্যি ওর সেই শান্তি এলো। রোদেলা নজরুলের উদ্দেশ্যে প্রায় অস্ফুটস্বরে বলতে চেষ্টা করে, আমাকে আপনাদের দলে নেবেন? বলতে বলতে প্রায় অজ্ঞানের মতো ঢলে পড়তে যায়। নজরুল করিম তাকে ধরে ফেলে। চাষী এগিয়ে আসে। দু’জনে মিলে রোদেলাকে তুলে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
×