ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

পাখিদের দুই আলাদা মেমোরি ব্যাংক

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

পাখিদের দুই আলাদা মেমোরি ব্যাংক

হাঁস ও অন্যান্য পাখির ছানারা ডিম ফুটে বের হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে সাধারণত মায়ের ক্রিয়াকলাপ অনুসরণ করে শেখে। তারা যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শেখে তাকে বলে ইমপ্রিন্টিং। এই প্রক্রিয়ায় হাঁসের ছানা ডিম ফুটে বের হওয়ার পর তার জীবনের সবচেয়ে ‘সংবেদনশীল অধ্যায়- অর্থাৎ প্রথম সপ্তাহের সময় যে কোন চলমান বস্তুকে শণাক্ত করতে সক্ষম হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে একটা পরীক্ষা চালান। তারা সদ্য ডিম ফুটে বেরোনো হাঁসের ছানাদের এক চোখ পট্টি মেরে অন্য চোখ দিয়ে তাদের সামনে মায়ের বিকল্প একটি ফাঁদ-হাঁস দেখান। অন্য চোখটি দিয়ে তারা সেই বস্তুটি চিনতে পারেনি। নতুন এই পরীক্ষায় এক চোখে আইপ্যাচ পরানো অবস্থায় হাঁসের ছানাদের প্রথমে একটি লাল অথবা নীল রঙের ফাঁদ-হাস দেখানো হয় যেটি বৃত্তাকার পথে চলছিল। হাঁসের ছানারা মায়ের এই নকল রূপটি স্মৃতিতে গেঁথে রাখে। তারা এই প্রথম চোখ দিয়ে তাদের সামনে উপস্থাপিত মায়ের রঙিন নকল রূপটি অনুসরণ করতে শেখে। পরবর্তী তিন ঘণ্টায় অন্যান্য পরীক্ষায় প্রতিটি হাঁসের ছানার সামনে একই সঙ্গে লাল ও নীল রঙের ফাঁদ-হাঁস হাজির করা হয়। এ সময় ওদের কারোর চোখে হয়ত কোন আইপ্যাচ পরানো ছিল না, কারোর ট্রেনিংয়ের সময় যে চোখে আইপ্যাচ ছিল সেই চোখেই আইপ্যাচ পরানো হয়েছিল, আবার কারোর ক্ষেত্রে অন্য চোখে অর্থাৎ ট্রেনিংয়ের সময় সে চোখে তারা নকল হাঁসটি দেখেছিল সেই চোখে প্যাচ পরানো হয়। দেখা যায় যে যে সব ছানাকে দু’চোখেই দেখতে দেয়া হয়েছিল তারা এবং যে সব ছানাকে ট্রেনিংয়ের সময় এক চোখে দেখতে দেয়া হয়েছিল তাদের দৃষ্টি সঠিকভাবে মূল নকল হাঁসটিকে অনুসরণ করেছে। বাকি ছানাগুলো দুই আলাদা রঙের নকল হাঁসের মধ্যে কোনটিকে অনুসরণ করবে সে ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোন পার্থক্য টানতে পারেনি। পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে গবেষকরা পাখিদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য পরিবেশন করেছেন। বিজ্ঞানীরা বলেছেন অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের দুই অর্ধাংশকে সংযোগকারী একটি বড় সেতুবন্ধ থাকে যার নাম করপাস কলোসাম। এই কাঠামোটি মস্তিষ্কের দুই অর্ধাংশের মধ্যে তথ্য দ্রুত স্থানান্তরের সুযোগ ঘটায়। এসব তথ্যের মধ্যে দর্শনঘটিত তথ্যও থাকে। পাখি ও অন্যান্য মেরুদ-ী প্রাণীর ক্ষেত্রে অবশ্য এ ধরনের কোন কাঠামো মস্তিষ্কের দুটি অংশের মধ্যে নেই। ফলে এদের বেলায় প্রতিটি চোখ থেকে সরাসরি ইনপুটগুলো মস্তিষ্কের বিপরীত দিকে চলে যায়। তার অর্থ হলো এক চোখ দিয়ে সংগৃহীত তথ্য অপর চোখে প্রাপ্তিযোগ্য হওয়ার জন্য অধিকতর জটিল শরীরবৃত্তিয় পথ ধরে যেতে হয়। নতুন পরীক্ষাটিতে দেখা গেছে, শরীরবৃত্তীয় এই পার্থক্যের অর্থ হলো হাঁসের ছানা যখন এক চোখ দিয়ে দর্শনঘটিত তথ্য সংগ্রহ করেÑ এমনকি সেই তথ্য যদি তার মাকে চিনতে শেখার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয় সেই তথ্যও স্বল্পমেয়াদী বিচারে প্রাপ্তিসাধ্য হবে না যখন আচরণটা অপর চোখ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অন্তত কিছু সময়ের জন্য একটা পাখি এক চোখ দিয়ে দর্শনঘটিত তথ্য অবগত হতে পারে এবং অন্য চোখ দিয়ে নাও হতে পারে। উপরন্তু এই দুই প্রতিযোগী তথ্য ব্যাংক অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণ ঘটাতে পারে। দ্বিতীয় পরীক্ষায় হাঁসের ছানাদের প্রতিটি চোখ দিয়ে বিপরীত ফাঁদ-হাঁসটি দেখানো হয়। যেমন বাঁ চোখ দিয়ে নীল রঙের ফাঁদ-হাঁস এবং ডান চোখ দিয়ে লাল রঙের ফাঁদ-হাঁস দেখানো হয়। এরপর প্রতিটি চোখ দিয়ে আলাদাভাবে পরীক্ষা করে দেখা যায়, ছানারা সেই চোখে যে ফাঁদ-হাঁসটিকে উপযুক্ত মনে করেছে সেটাই বেছে নিয়েছে। ব্যাপারটা এমন যেন তারা বাঁ চোখ দিয়ে তাদের মায়ের একটি রূপ এবং ডান চোখ দিয়ে আরেকটি রূপ উদ্ধার করেছে। আর যখন দু’চোখ দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে সেক্ষেত্রে তারা বাছাবাছিতে কোন অগ্রাধিকার দেখায়নি। তা থেকে এই সম্ভাবনাই বোঝায় যে বাম ও ডান ইমপ্রিন্টগুলো একে অপরকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আলেক্স কাসেলনিক বলেন পরীক্ষার এই ফলাফল থেকে বিভিন্ন প্রাণীর মনের বিভিন্ন ধরনের পরিচয় পাওয়া যায়। একটা পাখির মানসিক অভিজ্ঞতা আমাদের নিজস্ব মানসিক অভিজ্ঞতা থেকে গভীরভাবে ভিন্ন হওয়ারই কথা। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট চিত্র লাভ করা থেকে আমরা এখনও অনেক দূরে। স্তন্যপায়ী প্রাণী হিসেবে আমরা এক চোখ দিয়ে দেখার সময় প্রথমে অন্য চোখ দিয়ে দেখা হয়েছে এমন কোন বস্তু বা ব্যক্তিকে নাও শনাক্ত করতে সক্ষম হতে পারি এমন ধারণাটা বেশ অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু পাখিদের এবং সরীসৃপ, উভচর ও মাছসহ অন্য বেশিরভাগ মেরুদ-ী প্রাণীর ক্ষেত্রে সম্ভবত এমনটাই ঘটে। যেহেতু কেবল ইউথেরীয় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের অর্থাৎ ক্যাঙ্গারুর মতো পেটের নিচে থলেওয়ালা প্রাণী ও প্লাটিপাসের মতো মনোট্রিম প্রাণী বাদে অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের মস্তিষ্কে করপাস ক্যালোসাম থাকে তাই এমনটা সম্ভব। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের রিসার্চ ফেলো এন্টোস মার্টিনহো বলেন যখন কোন পাখি দু’চোখ দিয়ে একই সঙ্গে কিছু দেখে তখন প্রতিটি স্মৃতি ব্যাংক একই নতুন তথ্য আহরণ করতে পারে এবং সেই কারণে পাখি এমনভাবে কাজ করতে পারে যেন মস্তিষ্কের দুটো অর্ধাংশই অবগত আছে। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
×