ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আরও ১৩৫ পোশাক শ্রমিক ছাঁটাই ॥ ৭ নেতাসহ আটক ১৯

আশুলিয়া থমথমে ॥ নাশকতা চেষ্টাকারীরা চাকরি পাবে না

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

আশুলিয়া থমথমে ॥ নাশকতা চেষ্টাকারীরা চাকরি পাবে না

নিজস্ব সংবাদদাতা, সাভার, ২২ ডিসেম্বর ॥ শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে আশুলিয়ায় ৫৯ তৈরি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করায় সেখানে এখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। এছাড়া, আশুলিয়ায় আরও একটি পোশাক কারখানার ১৩৫ শ্রমিককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে ভাইসহ আশুলিয়া মহিলা দলের সভানেত্রী ও সাভার উপজেলা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের ৭ নেতাসহ ১৯ জনকে। পোশাক কারখানায় নাশকতার চেষ্টাকারী শ্রমিকরা কোন পোশাক কারখানায় চাকরি পাবে না বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার। বুধবার রাতে হা-মীম গ্রুপ কর্তৃপক্ষ ৫ শতাধিক শ্রমিকের বিরুদ্ধে অপর একটি মামলা দায়ের করে। এ নিয়ে মামলা সংখ্যা দাঁড়াল ৩-এ। এছাড়া পুলিশ বাদী হয়ে অপর একটি মামলা দায়ের করে। ঢাকা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাসহ (ডিইপিজেড) আশুলিয়া ও সাভার এলাকার অন্যান্য পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকরা সুষ্ঠুভাবে কাজ করছে। বৃহস্পতিবার সকালে বন্ধ কারখানাগুলোর সামনে শ্রমিকরা জড়ো হলে পুলিশ তাদের সেখান থেকে সড়িয়ে দেয়। পরে তারা বাসায় ফিরে যায়। এছাড়া, এদিন ভোর ৫টার দিকে লিফলেট বিতরণ করে শ্রমিক আন্দোলন উস্কে দেয়ার অভিযোগে জামগড়া এলাকা থেকে পুলিশ বাদশা নামের এক যুবককে আটক করে। যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এদিনও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এছাড়া বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর মহাসড়কে র‌্যাব-পুলিশ টহল অব্যাহত রাখে। কারখানাগুলোর সামনে রাখা হয় পুলিশের জলকামানসহ সাঁজায়ো যানবাহন। জানা গেছে, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ (সংশোধনী) এর ২৩ (৪) (ক) (ছ) ধারা মোতাবেক গুরুতর অসদাচরণের দায়ে বাইপাইল থানা সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত ফাউন্টেন গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড কারখানার ১৩৫ শ্রমিককে সাময়িক বরখাস্তসহ কারণ দর্শানোর নোটিস ও ছবিসহ তাদের নামের তালিকা কারখানার প্রধান ফটকে টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়। এদিন সকালে শ্রমিকরা কাজে যোগদানের উদ্দেশে কারখানায় এলেও যাদের ছবি বোর্ডে টাঙ্গানো হয়েছে, তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি নিরাপত্তাকর্মীরা। কারখানার সুইং অপারেটর ফারজানা, মর্জিনা, ছাইদুলসহ কয়েকজন শ্রমিক জানান, শ্রমিক অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করছে। যারা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে পরিকল্পিতভাবে যাদের চাকরির বয়স ৫ বছর বা এর কাছাকাছি- তাদেরই বেছে বেছে সাময়িক বরখাস্তসহ কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়েছে। এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, চাকরির বয়স ৫ বছর হলে শ্রম আইন অনুযায়ী তাদের বিভিন্ন ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা দেয়ার বিধান রয়েছে। এ থেকে তাদের বঞ্চিত করতেই এটি মালিকের এক ধরনের নীল নক্সা। কারখানাটির প্রধান ফটকে বন্ধের নোটিস লাগানো থাকলেও ভেতরে শ্রমিকরা কাজ করে। এদিন দুপুরে বিরতির সময় শ্রমিকদের খাবার জন্য বাইরে বের হতে এবং নির্দিষ্ট সময় পর আবার কারখানায় প্রবেশ করতে দেখা যায়। কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, কারখানার সিসিটিভি’র ফুটেজ দেখে প্রাথমিকভাবে ১৩৫ শ্রমিকের ছাঁটাইয়ের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কর্তৃপক্ষ কয়েকদিন ধরে চলমান আন্দোলনে অবৈধভাবে কারখানায় প্রবেশ, ভাংচুর, চুরি প্রভৃতি অভিযোগ তুলে ১৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৬০ শ্রমিককে আসামি করে বুধবার থানায় একটি মামলা দায়ের করে। এদিকে, চলমান এ শ্রমিক অসন্তোষের প্রেক্ষিতে বুধবার রাতে ৭ শ্রমিক নেতাকে আটক করে পুলিশ। এরা হলেনÑ গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের সাভার-আশুলিয়া-ধামরাই আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি সৌমিত্র কুমার দাস, গার্মেন্টস এ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন, স্বাধীন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সাভার-আশুলিয়া-ধামরাই আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আল-কামরান, সাধারণ সম্পাদক শাকিল, বাংলাদেশ তৃণমূল গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শামীম খান, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির (বিসিডাব্লিউএস) আশুলিয়ার সংগঠক মোঃ ইব্রাহিম ও টেক্সটাইল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের আহ্বায়ক মোঃ মিজান। আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মহসিনুল কাদির জানান, কয়েক দিন ধরে উস্কানিমূলক কর্মকা-ের জন্য তাদের আটক করা হয়েছে। তার দাবি ২৮ নবেম্বর জামগড়ায় ফ্যান্টাসি কিংডমের সামনে সৌমিত্র কুমার দাস এক গণসমাবেশের আয়োজন করেন। শামীম খান ও রফিকুল ইসলাম সুজন মিলে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে গোপনে বেরণ এলাকায় আরও একটি সমাবশে করেন। তারা ২০টি দাবি সংবলিত লিফলেট শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করেন। আল-কামরান ও শাকিলের নেতৃত্বে ১৬টি দাবিতে শিল্পাঞ্চলে লিফলেট বিতরণ করে শ্রমিকদের উস্কে দেয়া হয়। অপরদিকে, পোশাক কারখানায় নাশকতার চেষ্টাকারীরা কোন পোশাক কারখানায় চাকরি পাবে না বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার শাহ্ মিজান সাফিউর রহমান। বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেন, আশুলিয়ায় পোশাক কারখানায় চলমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখনও মাঠে রয়েছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কারখানার সামনে অন্যদিনের মতো এদিনও পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, আর্মড পুলিশসহ অন্য সদস্যরা অবস্থান করছেন। এছাড়া, শ্রমিকদের নিজ নিজ বাসায় ফিরে যেতে করা হচ্ছে মাইকিং। তিনি আরও বলেন, শ্রমিক অসন্তোষের জের ধরে ৫৫ কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের ঘোষণা দেয় বিজিএমইএ। তবে, এর বাইরেও আরও কয়েকটি কারখানা বন্ধের খরব পাওয়া গেছে। এরই প্রেক্ষিতে ১ হাজার শিল্প পুলিশ, ১৫ প্লাটুন বিজিবি, ঢাকা জেলার ১ হাজার পুলিশ সদস্যসহ বিপুলসংখ্যক র‌্যাব সদস্য কাজ করে যাচ্ছে। আশুলিয়ার পুরো এলাকাটি ১০টি সেক্টর এবং ২০টি সাব-সেক্টরে ভাগ করে টহল অব্যাহত রয়েছে। যারা সুযোগ কাজে লাগিয়ে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল, তাদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। ইতোমধ্যেই ৩টি মামলা রেকর্ড হয়েছে। যারা সমস্যা তৈরি করেছে- তাদের অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের যে কোন সময় আটক করা হবে। ইতোমধ্যেই এ ঘটনায় জড়িত থাকা, নাশকতার চেষ্টা করা ও ইন্ধনদাতা ১২ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৪ জন এজাহারভুক্ত আসামি। এছাড়াও, অজ্ঞাতনামা আরও ৭ শতাধিক শ্রমিকের নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়াও বিজিএমইএকে তালিকা দিতে অনুরোধ জানানো হবে- যাতে করে এসব শ্রমিকরা যেন কোন শিল্প কারখানায় চাকরি না পায় এবং কোন ঝামেলা করতে না পারে। পুলিশ সুপার আরও বলেন, পুলিশ জনগণের বন্ধু। সরকারের নির্দেশে আমরা শ্রমিকদের নিরাপত্তা প্রদান ও আস্থা অর্জনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। অতীতে এখানে অনেক ভাংচুর ও রক্তপাতের ঘটনা ঘটে। এবারও এ ধরনের নাশকতার চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিতেই আমদের এ কর্মকা-। কারখানা কবে নাগাদ খোলা হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণ শ্রমিক ও বিজিএমইএ আলাপ করে এক সিদ্ধান্তে পৌঁছলে কারখানা খুলতে পারবে এবং কাজ করতে পারবে। সে ক্ষেত্রেও আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করব। তবে, সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত সার্বিক পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। উপজেলা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গ্রেফতার ॥ শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে উস্কানি দেয়া, পোশাক কারখানায় অশান্তি ও বিশৃঙ্খলতা তৈরিতে মদদ দেয়ার অভিযোগে আশুলিয়া মহিলা দলের সভানেত্রী ওসাভার উপজেলা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান উর্মি আক্তার মিনিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। একই সঙ্গে তার বড় ভাই ইসামুদ্দিন, বিএনপি নেতা দুলাল মীর ও ইসরাফিল আলমকে আটক করা হয়। বিএনপির একটি সূত্র জানায়, বুধবার গভীর রাতে মিনির বড় ভাই ইসামুদ্দিনকে আটক করে পুলিশ। বৃহস্পতিবার সকালে মিনি থানায় গিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা শেষে তার প্রাইভেটকারে করে জাতীয় স্মৃতিসৌধ সংলগ্ন নবীনগর এলাকায় পৌঁছলে আশুলিয়া থানা পুলিশ তাকে আটক করে। সকালে জামগড়া এলাকা থেকে বিএনপির থানা সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক দুলাল মীর ও শ্রমিক নেতা তোফাজ্জল হোসাইনকে আটক করা হয়। এছাড়া বিএনপির স্থানীয় নেতা ঝুট ব্যবসায়ী ইসরাফিল হোসেনকে ভাদাইল নিজ বাড়ি থেকে আটক করা হয়। এদের আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষে উস্কানি দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করে পুলিশ একটি পৃথক মামলা দায়ের করে। তাদের সঙ্গে আটককৃত অন্য শ্রমিকনেতাদের ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে প্রেরণ করে পুলিশ। আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পরিচালক মোস্তাফিজার রহমান জানান, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কারখানাগুলোর সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
×