ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভোট না দিলে আমগো আইভী পাস করব কেমনে- উত্তর সত্তরোর্ধ কেশবানুর

শতবর্ষী লজ্জাতুন নেছা ভোট দিলেন নাতির কাঁধে ভর করে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

শতবর্ষী লজ্জাতুন নেছা ভোট দিলেন নাতির কাঁধে ভর করে

আরাফাত মুন্না/ মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ থেকে ॥ কেশবানুর বয়স ৭০ এর বেশি। ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। স্ট্রেচারে ভর করে হাঁটেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের শিশুবাগ ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে একাই এসেছেন তিনি। এত কষ্ট করে ভোট দিতে এসেছেন কেন- প্রশ্নের জবাবে তার এক কথায় উত্তর। ‘ভোট না দিলে আমগো আইভী পাস করব কেমনে।’ কেশবানু বলেন, ‘ভোটটা দিতে পারলে ভাল্লাগে। হের লেইগা কষ্ট হইলেও ভোটটা দিয়া যাই। কেশবানুর ভোটার নম্বর ১২৫৭। ভোটার সিøপে তার ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে দেওভোগ ওয়েস্ট রোড। স্বামী একিন আলী মৃত। আরেকজন লজ্জাতুন নেছা। বয়স ১০৬। দুপুর একটার দিকে সিটি কর্পোরেশনের ৭নং ওয়ার্ডের এম ডব্লিউ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে এসেছেন দুই নাতির সহায়তায়। কেমন ভোট দিলেন প্রশ্নে জানালেন, খুব ভাল। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিভিন্ন কেন্দ্রে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এমন অনেক কেশবানু ও লজ্জাতুন নেছারা ভোট দিয়েছেন। বার্ধক্য তাদের আটকে রাখতে পারেননি ভোট কেন্দ্রে আসা থেকে। সরেজমিন সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে এমন চিত্রই দেখা গেছে। দেখা যায়, সকাল আটটায় ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর থেকেই কেন্দ্রগুলোতে ভিড় বাড়তে থাকে। প্রথম ঘণ্টায় উপস্থিতি কিছুটা কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রে বাড়ে ভোটারের উপস্থিতি। দিনে কোন সময় কেন্দ্রগুলো ফাঁকা ছিল না বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন কয়েকজন প্রিসাইডিং অফিসার। নির্বাচনে কেউ কোন প্রভাবও বিস্তার করেনি বলে জানান তারা। নির্বাচনে প্রবীণ ভোটারদের সঙ্গে নবীন ভোটাররাও ভোট দিয়েছেন উৎসবমুখর পরিবেশে। প্রবীণ ভোটারদের পাশাপাশি নবীন ভোটারদের অনেক প্রত্যাশা নতুন জনপ্রতিনিধিদের কাছে। সন্ত্রাসমুক্ত নগরী দেখার প্রত্যাশার পাশাপাশি উন্নয়নও প্রত্যাশা করেন নবীন ভোটাররা। সরেজমিন ভোট কেন্দ্র ॥ সকাল আটটায় ১ নম্বর ওয়ার্ডের মিজমিজি রেকমত আলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুবই তৎপর। ভেতরে ভোট শুরু হয়েছে। কড়া নিরাপত্তা। কাউন্সিলর চার প্রার্থী গেটের বাইরে ভিড় করে আছে। ভোটারদের সিøপ দেখে দেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে। এ সময় সেফা আক্তার নামে এক ভোটার জানান, এমন নিরাপত্তা দিতে কোন দিন দেখিনি। নাসিমা বেগম বলেন, ভোট দেয়ার পরিবেশ ছিল খুবই শান্ত। তিনি বলেন, ‘অনেকেই ডর দেখাইছিল ভোট কেন্দ্রে যাইচ্ছ না। আমি শুনি নাই।’ এই কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার আঃ জলিল বলেন, একেবারে ফেয়ার ভোট হচ্ছে। কোন ভয়ভীতি নেই। পরে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ৯৩নং সুমিলপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেখা যায়, তিন বুথের সামনে ভোটারা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ ২-৩ ঘণ্টা ধরেও দাঁড়িয়ে আছেন। তবে এতে ভোটাদের ধৈর্যের চ্যুতি ঘটেনি। রহিমা খাতুন জানান, তিনি ১ ঘণ্টা ধরে ভোট দেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। তবুও তার ভাল লাগছে। হাসিনা বেগম জানান, প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে ভোট দেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। তবে সুষ্ঠু পরিবেশ দেখতে পেয়ে ভাল লাগল। নবীন ভোটারদের মুখে ছিল আনন্দের ছাপ ॥ নিপা রানী সরকার এবার নতুন ভোটার হয়েছেন। তিনি ১ নম্বর ওয়ার্ডের মিজমিজি পাইনাদী রেকমত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে কেন্দ্র সকাল সাড়ে নয়টায় ভোট দিতে আসেন। ভোট দিয়ে তিনি জানান, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিতে পেরে খুবই ভাল লাগছে। কোন সমস্যা হয়নি। আরেক নতুন ভোটার তানিয়া আক্তার। ৬নং ওয়ার্ডের ৯৩ নম্বর সুমিলপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দেন তিনি। এবার তিনি নতুন ভোটার হয়েছেন। তিনি জানান, দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছি। ভোট দেয়ার সময় পরিবেশ খুুই সন্তোষজনক ছিল বলে জানান তানিয়া। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচেন ৭০ হাজার ৭৪২ নতুন ভোটার রয়েছেন। তাদের প্রায় সকলেই ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এর মধ্যে এবার নারায়ণগঞ্জ নগরীতে প্রায় ২৪ হাজার, সিদ্ধিরগঞ্জে প্রায় ৩২ হাজার এবং বন্দরে ১৬ হাজার নতুন ভোটার ছিল। দেখা গেছে, কেন্দ্রগুলোতে নতুন ভোটারদের উপস্থিতি রেকর্ড সংখ্যক। জীবনের প্রথম ভোটটি শান্তিপূর্ণভাবে দিতে পেরে খুশি তারা। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নুরে মদিনা দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রের ভোট দিতে আসেন নতুন ভোটার সামির বানু জানান, ভোটের আগে অনেকেই বলে ছিল ঝামেলা হতে পারে। তবে কোন ঝামেলাই তো দেখিনি। ভালভাবে এসেছি, ভোট দিয়েছি। আদমজী এম ডব্লিউ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস সাইফুল ইসলাম জানান, এটাই আমার প্রথম ভোট। নিজের ভোটটি দিতে পেরে মনে হচ্ছে আমি এখন দেশের নাগরিক হয়েছি। ভাল লাগছে। তিনি আরও জানান, জনপ্রতিনিধির কাছে আমার চাওয়া হচ্ছে, এলাকার উন্নতি। শিক্ষা খাতেও যাতে উন্নয়ন করা হয়। ১ নম্বর ওয়ার্ডের মিজমিজি পাইনাদী হাইস্কুলের নতুন ভোটার রুমা ভোট দিয়ে তার অনুভূতি প্রকাশ করে জানান, নির্বাচন উপলক্ষে টিভিতে নিরাপত্তার বিষয়টি দেখেছি। তাছাড়া আমি জেনেছি নির্বাচন উপলক্ষে ব্যাপক নিরাপত্তা নেয়া হয়েছে। তাই বেলা এগারোটায় আমি ভোট দিতে ছুটে এসেছি। নতুন মেয়রের কাছে আমার প্রত্যাশা থাকবে তিনি এলাকার উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি করবেন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি মুক্ত সিটি গড়ে তুলবেন। প্রবীণ ভোটারদের মুখেও ছিল উচ্ছ্বাস ॥ সিটি নির্বাচনে ১০৬ বছর বয়সী লজ্জাতুন নেছা দুই নাতির কাঁধে ভর করে ৭নং ওয়ার্ডের এম ডব্লিউ উচ্চ বিদ্যালয়ে দুপুর একটায় ভোট দিতে এসেছেন। এ সময় তিনি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিয়ে নির্বিঘেœ বাড়ি ফিরে যান। সাংবাদিকরা ভোট দেয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি শুধু মাথা নেড়ে শান্তির পরিবেশে ভোট দিতে পেরে স্বস্তি প্রকাশের ইঙ্গিত দেন। ১ নম্বর ওয়ার্ডের হাজী শামসুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র ভোটার ফজলুল রহমান ভূঁইয়া (৭০) জানান, সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট দিতে পেরেছি। এজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। ৮নং ওয়ার্ডের ভোটার আয়েশা খাতুনের বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। তিনি তার মেয়েকে নিয়ে ভোট দিতে এসেছেন। ভোট দিয়ে তিনি বলেন, মারামারি হইবো বলে প্রথমে আসতে চাইনি। পরে আমার মেয়ে জানতে পারল সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে। তাই আমার মেয়ে আমাকে ভোট দিতে নিয়ে এসেছে। একই কেন্দ্রের শামসুন নাহারের বয়স বাহাত্তর বছর। তিনি ভোট দিয়ে বলেন, এত সুন্দর নির্বাচন কখনও দেখিনি। ভোট দিতে এসেছি রাস্তা আমাকে কেউ বাধ্য করেনি। একই কেন্দ্রের আব্দুল হামিদের বয়স আশির কোঠায়। এমন সুন্দর নির্বাচন দেখে আমি অবাক হয়েছি। তাই আমার কাছে আনন্দ লাগছে। জানি না সামনে ভোট দিতে পারব কিনা।
×