ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এ বিজয় না’গঞ্জবাসীর, নেত্রী আমাকে নৌকা প্রতীক দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জবাসী তাকে বিজয় উপহার দিয়েছে- আইভী ;###;ভোট গণনায় ত্রুটি হয়েছে-সাখাওয়াত

উৎসবমুখর শান্তিপূর্ণ নাসিক নির্বাচন ॥ বিপুল ভোটে জয়ী আইভী

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

উৎসবমুখর শান্তিপূর্ণ নাসিক নির্বাচন ॥ বিপুল ভোটে জয়ী আইভী

আরাফাত মুন্না/ মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ থেকে ॥ আইভীই ফের নারায়ণগঞ্জের নগরপিতা। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে তাকেই আবারও মেয়র হিসেবে বেছে নিলেন নারায়ণগঞ্জবাসী। এই নির্বাচন নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলার সুযোগ না দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয় ভোটগ্রহণ। সেনাবাহিনী ছাড়াই কঠোর নিরাপত্তার ঘেরাটোপে ন্যূনতম সন্ত্রাস বা গোলযোগবিহীন শান্তিপূর্ণ এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভী ১ লাখ ৭৫ হাজার ৬১১ ভোট পেয়ে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির এ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান পেয়েছেন ৯৬ হাজার ৪৪ ভোট। রাত সাড়ে এগারোটায় নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে রিটার্নিং কর্মকর্তা নুরুজ্জামান তালুকদার এই বেসরকারী ফল ঘোষণা করেন। তিনি ডাঃ আইভীকে মেয়র ঘোষণা করে জানান, এই নির্বাচনে মোট ভোটারের ৬২.৩৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। দেখা গেছে, বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান তার নিজ কেন্দ্রেও পাস করতে পারেননি। তার আদর্শ স্কুল কেন্দ্রে তিনি ৯৬৮ ভোট পেয়েছেন। এই কেন্দ্রে আইভী পেয়েছেন ১ হাজার ৯৩০। অন্যদিকে আইভীর শিশুবাগ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ১ হাজার ৫৯১ ভোট পেয়েছেন। সাখাওয়াত পেয়েছেন ৬২৮ ভোট। নির্বাচনে মেয়র পদে অংশ নেয়া অন্য পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী মাহবুবুর রহমান ইসমাইল (কোদাল) ৬৭৮, এলডিপির কামাল প্রধান (ছাতা) ৪৩২, ইসলামী আন্দোলনের মুফতি মাসুম বিল্লাহ (হাতপাখা) ১৩ হাজার ৯১৪, ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী মাওলানা এজহারুল হক (মিনার) ৯১০ ও কল্যাণ প্রার্থীর রাশেদ ফেরদৌস (হাতঘড়ি) ৪৮০ ভোট পেয়েছেন। ফল ঘোষণার আগে রিটার্নিং অফিসার নুরুজ্জামান তালুকদার বলেন, এই নির্বাচন স্মরণ রাখার মতো শান্তিপূর্ণ হয়েছে। কোথাও কোন বিশৃঙ্খলা হয়নি। আমার কাছে কোন অভিযোগও আসেনি। তিনি বলেন, ভোটগ্রহণ পর্যন্ত যেমন শান্তিপূর্ণ ছিল, আশা করছি আপনারা এখনও একই রকম শান্তিপূর্ণ থাকবেন। এদিকে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আইভী তার জয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি উৎসর্গ করেন। এ বিজয়কে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি উৎসর্গ করে তিনি বলেন, নেত্রী আমাকে নৌকা প্রতীক উপহার দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জবাসী তাকে বিজয় উপহার দিয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচিত হয়ে আমি আমার অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করব। অপরদিকে পরাজিত প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান রাতে বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও ভোট গণনায় ত্রুটি হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে মোট ভোটার রয়েছেন ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯৩১ জন। তাদের মধ্যে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬৬২ জন পুরুষ, ২ লাখ ৩৫ হাজার ২৬৯ জন নারী। একজন মেয়র, ৯ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর এবং ২৭টি ওয়ার্ডের জন্য একজন করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হচ্ছেন এই ভোটারদের ভোটে। গতবার ভোটের হার ছিল ৬৯ শতাংশ। আর এবার তা ৬৫ শতাংশ বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কর্মকর্তারা। এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু করে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে বিরতিহীনভাবে। ভোটগ্রহণের এই আট ঘণ্টায় কোথাও কোন বিশৃঙ্খলার খবরও পাওয়া যায়নি। নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বিএনপি প্রার্থী সেনা মোতায়েনের দাবি জানালেও তার সেই শঙ্কার বিন্দুমাত্র দেখা যায়নি ভোটের মাঠে। উৎসবের আমেজেই শেষ হয়েছে ভোট। ভোট শেষে আইভী জানিয়েছেন, নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট। বিএনপি প্রার্থী সাখাওয়াতও নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে কোন অভিযোগ করতে পারেননি। প্রধান দুই মেয়র প্রার্থীই জানান, জনরায় মেনে নিবেন। নারায়ণগঞ্জে কার্যত স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বিশ্লেষকরা মনে করেন এই নির্বাচনে পাওয়া গেছে জাতীয় নির্বাচনের আমেজ। এদিকে নিজের ভোট প্রকাশ্যে দিয়ে নাটকীয়তার জন্ম সৃষ্টি করেন নারায়ণগঞ্জ চার আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। তিনি প্রকাশ্যে আইভীকে ভোট দিয়ে আইসক্রিম রেডি রাখতে বলেন। ফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থান ছিল। ভোটগ্রহণের সময়ও নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা ছিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার দুপুরে জানান, ব্যালট বাক্স রক্ষা করকে যা প্রয়োজন সবই করা হবে। আইভীকে আইসক্রিম রেডি রাখতে বললেন শামীম ওসমান ॥ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে গোপনকক্ষে না গিয়ে সবার সামনে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়েছেন স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমান। আইভীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আইসক্রিম যেন তৈরি রাখা হয়। দুপুরে নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমি কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেন শামীম। এরপর মেয়র প্রার্থীদের সাদা ব্যালট উঁচিয়ে সাংবাদিকদের দেখান, যেখানে নৌকা প্রতীকে সিল মারা ছিল। কাউন্সিলর প্রার্থীদের সবুজ ও গোলাপী ব্যালটও এ সময় তার হাতে ভাঁজ করা ছিল। অন্য হাতে ছিল দুই আঙুল উঁচানো বিজয়ের চিহ্ন। ভোটারদের ভোটকক্ষের ‘গোপনকক্ষে’ গিয়ে সিল মারার বিধান থাকলেও শামীম তা ভাঙলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভীর সঙ্গে তার আর কোন বিরোধ না থাকার প্রমাণ দেখানোর জন্য। শামীম ও আইভীর দ্বন্দ্ব তাদের পারিবারিক উত্তরাধিকার। ওসমানদের বিরোধী শিবির থেকে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন আইভীর বাবা আলী আহমেদ চুনকা। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বিদেশে চলে যান। তখন প্রবাস থেকে ফিরে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন আইভী। ২০০৯ সালে শামীম দেশে ফেরার পর দুজনের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়। ২০১১ সালের নির্বাচনে দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আইভী এই শামীমকে হারিয়েই নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র হন। এরপর বিভিন্ন ঘটনায় তাদের বিরোধী চরমে ওঠে। কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে শামীম ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। এ নির্বাচনে দুটি চ্যালেঞ্জ ছিল। ভোট সুষ্ঠু হয়ে একটি চ্যালেঞ্জ সম্পূর্ণ হয়েছে। আরেকটি চ্যালেঞ্জ নৌকার বিজয়। নৌকাও বিপুল ভোটে বিজয়ী হবে, বলেন শামীম। আইসক্রিমের কথা আবার মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, আইভীর বিজয় নিশ্চিত দেখে বলেছি- হয় খাব, না হয় খাওয়াব। নৌকার বিজয় হবে। আইভী-শামীমের বিভেদের খবরের কারণেই প্রকাশ্য ভোট দিলেন কিনা, এতে আচরণবিধি লঙ্ঘন হলো কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংবাদের খোরাক দেয়ার জন্য আমি নিজেকে রক্তাক্ত করলাম। ব্যালট বাক্স রক্ষায় সবই করবো বললেন এসপি ॥ সিটি নির্বাচনের নিরাপত্তায় সব ধরনের প্রস্তুতি থাকার কথা জানিয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মঈনুল হক বলেছেন, সুষ্ঠুভাবে ভোট আয়োজনে যা যা প্রয়োজন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার সবই করবে। কেন্দ্র ঘুরে দেখে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ব্যালট বাক্স রক্ষা করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন; আমরা তাই করব। তিনি বলেন, আমাদের কাছে প্রতিটি কেন্দ্র ও ভোটার সমান গুরুত্বপূর্ণ, আমি ইতোমধ্যে পরিদর্শন করেছি। এখন যেভাবে চলছে, ভোট শেষ পর্যন্ত এভাবেই চলবে। নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে মঈনুল বলেছেন, এ বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ‘সুযোগ নেয়ার চেষ্টা’ যেন কেউ না করে। স্থানীয় ভোটে জাতীয় নির্বাচনের আমেজ ॥ দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর উপজেলা, পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলেছিল বিএনপি। দখল-অভিযোগের মধ্যে ব্যাপক সমালোচিতও হয় নির্বাচন ব্যবস্থাপনাও। স্থানীয় সরকার আইন সংশোধনের পর নারায়ণগঞ্জ দিয়েই প্রথম মুখোমুখি হলো প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ফলে এ নির্বাচন এরই মধ্যে দুই প্রধান দলের মর্যাদার লড়াইয়ের রূপ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, নারায়ণগঞ্জে আইভীর জয় হলে তা সরকারের কাজের প্রতি জনগণের সমর্থনের প্রকাশ ঘটবে। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের ভোটে সরকারের বিরুদ্ধে জনরায়ের আশায় আছে বিএনপি। নারায়ণগঞ্জের প্রবেশ পথে পুলিশের ব্যারিকেড ॥ নারায়ণগঞ্জে প্রবেশে পুলিশের পক্ষ থেকে সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় এক ব্যারিকেট দেয়া হয়েছে। ভোটার ও নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ছাড়া বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়। ৮টা বাজতে কিছু সময় বাকি। সাইবোর্ডে শতাধিক মানুষের জটলা। পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের তুমুল কথা কাটাকাটি চলছে। কেন? রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজন যাঁরা সকাল থেকে এই রাসত্মা দিয়ে নারায়াণগঞ্জে প্রবেশ করার চেষ্টা করছেন, তাদেরই মূলত আটকান হচ্ছে। যানবাহন প্রবেশও নিষিদ্ধ ছিল। নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা ছিল নারায়ণগঞ্জ ॥ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, নৌ-পুলিশ, শিল্প পুলিশ, কোস্টগার্ড ও আনসার বাহিনীসহ ৭টি বাহিনীর সাড়ে ৯ হাজার সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ২২ প্লাটুন বিজিবির, ৩২ ব্যাটালিয়ন র‌্যাব, পুলিশ ৪ হাজার, শিল্পাঞ্চল পুলিশ ২শ’, কোস্টগার্ড ৩ প্লাটুন, নৌ-পুলিশ ৩ প্লাটুন ও আনসার ১ প্লাটুন। ২২ প্লাটুন বিজিবির মধ্যে সদরে ৭ প্লাটুন, সিদ্ধিরগঞ্জে ১০ প্লাটুন ও বন্দরে ৫ প্লাটুন মোতায়েন করা হয়। মোট সাড়ে নয় হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের মধ্যে সাড়ে ৫ হাজার বিভিন্ন ওয়ার্ডে মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। বাকি ৪ হাজার পুলিশ ও আনসার ১৭৪ কেন্দ্রে স্থায়ী দায়িত্বে ছিল। এছাড়াও ৭১ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ১৪ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে মোবাইল কোর্ট দায়িত্ব পালন করেছে। এই সিটি কর্পোরেশনের আয়তন ৭২.৪৩ বর্গকিমি। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে ২৭টি ওয়ার্ড আছে। ১৮৭৬ সালে পৌরসভা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ। ২০১১ সালের ৫ মে থেকে সিটি কর্পোরেশন হিসেবে রূপ পায় নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার সঙ্গে বিলুপ্ত হয় কদমরসুল ও সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভাও। একই বছরের ৩০ অক্টোবর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সিটি কর্পোরেশন পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। এই সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র হিসেবে এই নগরকে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দেন ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভী।
×