ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাহালুল মজনুন চুন্নু

আবদুর রাজ্জাক ॥ মানবতা প্রতিষ্ঠার সাধক

প্রকাশিত: ০৪:২০, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

আবদুর রাজ্জাক ॥ মানবতা প্রতিষ্ঠার সাধক

আমার স্মৃতিরা বড় উচ্ছৃঙ্খল/দমকা হাওয়া যেন/ লুকোচুরি, ভাঙাভাঙি/ওলোটপালটে মহাখুশি/দুঃখেরও দুপুরে গায়,/গাইতে পারে, আনন্দ-ভৈরবী... পুর্ণেন্দু পত্রীর ‘স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল’ কবিতার এই লাইনগুলোর মতোই মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বীর সেনানী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আদায় আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শিক সৈনিক, তাঁর স্নেহধন্য এবং চিন্তা-চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের অন্যতম এক শীর্ষযোদ্ধা, দুর্দিনে আওয়ামী লীগের হাল ধরা অনন্য সাংগঠনিক দক্ষতাসম্পন্ন এক নাবিক, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আজীবন সাহসী যোদ্ধা জাতীয় নেতা আবদুর রাজ্জাকের স্মৃতিগুলো মানসপটে সমুজ্জ্বল হয়ে বিচরণ করে বেড়ায় সর্বক্ষণ। স্মৃতি হাতড়াতে হয় না, এসে পড়ে বানের জলের মতো হুহু করে। আনন্দ-বেদনার কাব্য রচিত হতে থাকে হৃদয়ের গহীনে, টের পেতে থাকি তাঁর স্নেহস্পর্শ। ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে তাঁর পাশে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেই সৌভাগ্যময় মুহূর্তগুলো স্মৃতির পটে আঁকা হয়ে আছে নক্ষত্রের সমুজ্জ্বল আলোকরশ্মীর মতো। হৃদমন্দিরে সেই স্মৃতিগুলো ক্ষণে ক্ষণে জেগে ওঠে আমাকে অনুপ্রেরণা দেয় বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে জীবনের দীর্ঘ ঊষর পথ পাড়ি দিতে। রাজ্জাক ভাই ছিলেন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর। সারাজীবন লড়ে গেছেন অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। হেলাল হাফিজের কবিতার দুটি লাইনের সঙ্গে রাজ্জাক ভাইয়ের যৌবনকালের অদ্ভুতরকম মিল আছে। এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার/যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। ঠিক এই লাইনটির মতোই রাজ্জাক ভাই নিজের যৌবনকালকে প্রথাগত চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করে নিরাপত্তার চাদরে মোড়া ঘরসংসার করার জীবন বেছে নেননি। তিনি বেছে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর দৃপ্ত শপথ লড়াইয়ে রক্তভেজা রাজপথ, কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের অনিশ্চিত এক জীবন। সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর আঠারো বছর বয়স কবিতায় বলেছিলেন, আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,/ আঠারো বছর বয়সেই অহরহ/বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় উঁকি। রাজ্জাক ভাইয়ের বয়স যখন আঠারো, তখনই তিনি হয়ে উঠতে থাকেন রাজপথের এক লড়াকু সৈনিক, এক তুখোড় ছাত্র নেতা, যিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বাঙালীর স্বাধিকারের স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলেন, উন্মুখ হয়েছিলেন দেশের তরে, দেশের মানুষের সামষ্টিক কল্যাণে নিজ জীবনকে বিসর্জন দিতে। তাই তো ষাটের দশকের আগ্নেয়গিরির লাভার মতো জ্বলন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে স্বাধিকার আন্দোলনগুলোতে তাঁর ছিল সরব এবং তেজোদীপ্ত উপস্থিতি। যার ফলে শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে সহ্য করতে হয়েছে বছরের পর বছর কারা প্রকোষ্ঠের অন্ধকারময় জীবন, ভোগ করতে হয়েছে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন-নিপীড়ন। বঙ্গবন্ধুর আর্দশ বাস্তবায়নের জন্য তাঁর এক বিশ্বস্ত সৈনিক হিসেবে রাজপথ থেকে শুরু করে জেল জীবনে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে করতেই এক সময় রাজ্জাক ভাইয়ের উত্তরণ ঘটে জাতীয় নেতা হিসেবে। বৃদ্ধি পায় তাঁর কর্মপরিধি, ব্যস্ততা। সেইসঙ্গে বৃদ্ধি পায় ব্যক্তিগত জীবনচাহিদার ত্যাগের পরিধিও। রাজনীতির মাঠ কাঁপিয়ে, সারাদেশ চষে বেড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক সারাদেশের মানুষকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উদ্ধুদ্ধ ও সংগঠিত করাই ছিল যেন তখন জীবনের একমাত্র ব্রত। দীর্ঘ সংগ্রাম পরিক্রমার চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যখন স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তিনি নিজ জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। দেশমাতৃকার প্রতি প্রবল ভালবাসা আর বঙ্গবন্ধুর প্রতি তীব্র আবেগ তাঁকে রণক্ষেত্রে সর্বদা সাহস যুগিয়েছিল। মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ও রূপকার হয়ে দেরাদুনে কাজ করেছেন মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষক হয়ে, নিজেও লড়াই করেছেন সম্মুখ সমরে। বাঙালী জাতির দীর্ঘ প্রতীক্ষিত, বহু ত্যাগ-তিতিক্ষাময় স্বাধীনতা অর্জন ও তৎপর চূড়ান্ত বিজয়ের পর থেকে রাজ্জাক ভাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ বাস্তবায়নে কাজ করে গিয়েছিলেন নিরলস। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দলকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন জাতির পিতার নির্দেশ পালন করে। পরবর্তীকালে বাকশালের সম্পাদক হিসেবে জাতির পিতার দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচীকে সাফল্যমণ্ডিত করার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় দীর্ঘ আড়াই বছর তিনি কারাবন্দী থাকেন। দলের নেতাকর্মীরা যখন দিশাহারা, সেই সময়টাতে তিনি জেলে বসেই দলকে সংগঠিত করার জন্য, জাতির পিতার হত্যার বদলা নিতে নানা কৌশল অবলম্বন করে দল পরিচালনা করতেন। পঁচাত্তর পরবর্তী যে দুঃসময় গেছে, যে দুর্যোগ ঘটেছে জাতীয় জীবনে, সামরিক জান্তার শোষণ-নিপীড়নে ছাত্রলীগের কর্মীরা যখন অসহায়-দিশাহারা হয়ে পড়েছিল, তখন সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ছাত্রলীগের কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছিল। সেটা করার জন্য কারাগার থেকে তিনি আমাদের যাবতীয় দিকনির্দেশনা দিতেন সবসময়। তিনি তা করতে আমাদের দিকনির্দেশনা দিতেন জেল থেকেই। পঁচাত্তর পরবর্তী ক্ষমতা দখলকারীরা নানা প্রচেষ্টা চালিয়েও তাঁকে তাদের অনুগত করতে পারেনি। শত নিপীড়নেও তিনি কাবু হননি, মাথা নত করেননি। বঙ্গবন্ধুর দীক্ষাই তাঁকে সাহসী করে তুলেছিল। রাজ্জাক ভাই ছিলেন দূরদর্শী-বিচক্ষণ এক রাজনীতিবিদ। তিনি বুঝেছিলেন এই বাংলায় আওয়ামী লীগের ঐক্য ধরে রাখার জন্য, আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই। তাই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি বানাতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। শুধু তাই নয়, স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জননেত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে সাফল্যমণ্ডিত করে স্বৈরাচার সামরিক সরকারের পিলে চমকে দিতে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও রাজ্জাক ভাইয়ের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। নব্বই দশকের শুরুতে শহীদ-জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম এক সক্রিয় সৈনিক। তাদের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা পদক্ষেপের কারণেই মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যেমে আজ দেশ কলঙ্কমুক্ত হতে চলেছে। মনে পড়ে সেই দিনটির কথা যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। আজ থেকে প্রায় আটচল্লিশ বছর আগের কথা। আমি তখন সরকারী রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র। আর তিনি তখন আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য। কেন্দ্রীয় নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ও কাছের মানুষ হিসেবে বলা চলে তখন তিনি দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক নেতা। ঢোলা পাঞ্জাবি-পায়জামা আর স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরা সাদাসিধে চালচলনের সেই নেতাকে দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলাম। কর্মীদের প্রতি রাজ্জাক ভাইয়ের ছিল অপরিসীম ভালবাসা-দায়িত্ববোধ। কর্মীপ্রাণ এমন নেতা খুঁজে পাওয়া ভার। কোন কর্মী বিপদে পড়লে তিনি ছুটে আসতেন সর্বাগ্রে। আন্দোলন-সংগ্রামে কোন কর্মী যদি গ্রেফতার হতো, তাহলে তার মুক্তির জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যায় সবকিছুই করতেন তিনি। জেলে থাকা অবস্থায় কর্মীরা যেন দুঃসহ কষ্ট ভোগ না করে সেইদিকেও ছিল তাঁর নজর। তাঁর চিন্তা-চেতনায় কর্মীদের মঙ্গলকামনা ছিল সবর্দা বিরাজমান। রাজ্জাক ভাইয়ের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতির মধ্য দিয়ে। ষাটের দশকের শুরুর দিকে তিনি ছাত্রলীগের একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করে দুবার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাই ছাত্রলীগের প্রতি ছিল তাঁর তীব্র আবেগ। যদি কোন কারণে ছাত্রলীগের মধ্যে কোন অন্তর্কলহ দেখা দিত, তবে তিনি মুষড়ে পড়তেন। নিজেই অন্তর্কলহ মিটিয়ে দিতেন, আবার অনেক সময় তোফায়েল ভাইয়ের ওপর মেটানোর ভার দিতেন। এখানে একটা কথা না বললেই নয়, তোফায়েল ভাইয়ের প্রতি তাঁর ছিল প্রচণ্ড আবেগ-ভালবাসা, ঠিক যেমন আপন ভাইয়ের প্রতি থাকে। তাঁরা দুজনে ছিলেন মানিকজোড়, বঙ্গবন্ধুর দুই বিশ্বস্ত নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক। রাজ্জাক ভাই ছিলেন দলের নেতাকর্মীদের বিশ্বাস ও আস্থার কেন্দ্রস্থল। সেই বিশ্বাস ও আস্থা ছড়িয়ে পড়েছিল আপামর জনসাধারণের মাঝে। কর্মনিষ্ঠা, কর্মকুশলতা এবং আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠ কর্মী হয়ে নিরলস শ্রমের মাধ্যমে তিনি নিজেকে জনগণের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনা ধারণকারী জনকল্যাণকামী একজন নেতা হিসেবে। এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নির্লোভ, সৎ, ত্যাগী, সাহসী, স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী এমন একজন সফল রাজনীতিক, যাঁর চেতনায় সবর্দাই বিরাজ করত দেশ ও সমাজের কল্যাণ। আদর্শ, সততা ও মানবতার ধারা বজায় রেখে সমগ্র জীবন পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। সমাজহিতৈষী নির্মোহ রাজনীতিবিদ রাজ্জাক ভাই ছিলেন সৌম্য-শান্ত-নম্র অথচ দৃঢ়চেতা মনোভাবের এক মূর্ত প্রতীক। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর কর্মময় স্মৃতি। রয়ে গেছে তাঁর দেশপ্রেম এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার অমরগাথা। তাঁর মৃত্যুর সংবাদে তীব্র শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল তাঁর অসংখ্য নেতাকর্মী, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ী। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে তিনি আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমান। পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করি সশ্রদ্ধ বিনম্র চিত্তে। লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাবি সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
×