ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

নিষ্ক্রিয় ‘তরুণ’ দিয়ে আমাদের কী হবে?

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

নিষ্ক্রিয় ‘তরুণ’ দিয়ে আমাদের কী হবে?

এক সময় পরিসংখ্যান ও তথ্যের আকাল ছিল। এখন তথ্য ও পরিসংখ্যানের এত ছড়াছড়ি যে, মাঝে মাঝে এসবের মধ্যে একটির সঙ্গে আরেকটির কী সম্পর্ক তা বুঝতেই বহু সময় লেগে যায়। দেশে বেকারের সংখ্যা কত, সাক্ষরতার হার কত, শিক্ষিতের হার কত, কত লোক বিদেশে কাজ করে, প্রবাসীরা কত টাকা বছরে দেশে পাঠায়, কত গাড়ি ঢাকার রাস্তায় চলাচল করে, কত গাড়ি প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় নামে, ব্যাংক লোন পেতে কত ঘাটে ‘জল’ দিতে হয়, শিক্ষকের চাকরি পেতে কত টাকা খরচ করতে হয়- এমন সব হাজার ধরনের পরিসংখ্যান প্রতিদিন খবরের কাগজে প্রকাশিত হচ্ছে। আবার এমনও হচ্ছে যে, প্রকাশিত একই তথ্য ও পরিসংখ্যান আরেক কাগজে নতুন মোড়কে এমনভাবে পরিবেশিত হচ্ছে যাতে মনে হয় সম্পূর্ণ নতুন খবর। এ কারণে আমি বেশ বিপদে আছি। কোনটা আসল, কোনটা নকল, কোন তথ্যের কী উদ্দেশ্য- এসব ভেবে মাঝেমাঝে অসহায় বোধ করি। চারদিকে পরিসংখ্যান, আর পরিসংখ্যান দেশী এবং বিদেশী। আবার পরিসংখ্যান রয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোরও। শিক্ষিত ও বোদ্ধা লেখক এসব দেখে ও পড়ে একটা কিছু বোঝে। যারা লেখাপড়া জানে না তারা এসব তথ্য শোনে কিছুই বোঝে না। তাই এই সময়টা তথ্যের কারণে বিশেষ করে বাস্তবানুগ তথ্যের কারণে মাথা গরম হওয়ার জন্য যথেষ্ট। যেমন সর্বশেষ একটা তথ্যের কথা বলি। এতদিন শুনেছি ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের’ কথা। এখন আরেক পরিসংখ্যানে পাচ্ছি উল্টো খবর। কোনদিকে যাই? যাওয়ার আরও কয়েকটা অভিজ্ঞতার কথা বলি যা তথ্য বাস্তব অবস্থা বুঝতে সাহায্য করবে। কিছুদিন আগের কথা। ঢাকার কাছেই এক পরিচিত ভদ্রলোকের দেশের বাড়িতে যাই। সঙ্গে আরও কয়েকজন। সুন্দর গ্রাম। গাছ পালায় ভর্তি। প্রায় বাড়িতেই পুকুর আছে। দেখেশুনে মনে হলো অবস্থাসম্পন্ন লোকদের গ্রাম। প্রায় বাড়িই পাকা। পোশাক পরিচ্ছদও ভাল। গায়ে জামা-কাপড় আছে। পায়ে জুতো আছে। গ্রামে একটা খেলার মাঠও আছে। একটু দূরেই প্রাথমিক একটা স্কুল। কাঁচাবাজারও অনতিদূরে অবস্থিত। বলাবাহুল্য, বিদ্যুত আছে গ্রামে। ভদ্রলোকের বাড়িতে ঢুকেই বসে পড়লাম একটা চেয়ারে। মাথার উপরে চলছে পাখা। এরই মধ্যে ১৮-২০ বছরের এক যুবক ঘরে ঢুকল। বাড়ির মালিক ছেলেটিকে বললেন, সেলাম কর। যথারীতি সেলাম শেষ হতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, ও কী করে? কলেজে পড়েÑ এলো উত্তর। জিজ্ঞেস করে জানলাম ছেলেটি নামে কলেজে পড়ে। কলেজে যায় না নিয়মিত। বাজারে আড্ডা মেরে বেড়ায়, আর বিদেশে যাওয়ার জন্য দালালের পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু টাকা খরচও করে ফেলেছে। তার এক চাচাত ভাই সৌদি আরবে আছে। মাসে অনেক টাকা পাঠায়। ছেলেটির স্বপ্ন সেও সৌদি যাবে, দেশে টাকা পাঠাবে। এর অর্থ ছেলেটির লেখাপড়া শেষ, কোন কাজ করে না, কোন প্রশিক্ষণও নিচ্ছে না। এরকম আরেকটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি নোয়াখালী জেলায়। বছর দুয়েক আগে গিয়েছিলাম নোয়াখালী। ব্যক্তিগত কাজে নয়। বেশ কয়েকজন, বলা যায় সরকারী কাজেই সেখানে গিয়েছি। সেখানেও এক পরিচিতজনের ভাতিজার সঙ্গে দেখা। তার বয়সও কুড়ির নিচে। ‘গ্র্যাজুয়েশন’ করতে পারেনি। বেশ স্মার্ট। নাকে মুখে কথা বলে। আমাদের আদর-যতœ করছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম ও বিদেশ যাবে। তার বড় ভাই কুয়েতে। বস্তুত, তাদের বাড়ির বহু লোক কুয়েতে। তাই সেও কুয়েত অভিমুখী। ব্যবস্থা করছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে এই ছেলেটিরও পড়ালেখা শেষ, কোন কাজ করে না, প্রশিক্ষণও নিচ্ছে না। এ ধরনের অভিজ্ঞতা আরও আছে। একটু ভিন্ন ধরনের পরিচিতজন, বন্ধু-বান্ধবগণ প্রায়ই চাকরির কথা বলেন। ছেলে-মেয়েরা বিএ-এমএ পাস করেছে। কেউ বিবিএ-এমবিএ করেছে। চাকরি খুঁজছে। চাকরি নেই। ইন্টারভিউ দিচ্ছে, চাকরির জন্য পরীক্ষা দিচ্ছে- কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। তার অর্থ এদের পড়াশোনাও শেষ, চাকরি করে না, প্রশিক্ষণেও নেই। অর্থাৎ ‘নিষ্ক্রিয়’। এই যে উদাহরণগুলো দিলাম, তা কেন দিলাম। দিলাম একটা পরিসংখ্যান খবরের কাগজে দেখে। পরিসংখ্যানটি দিয়েছে ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা’ (আইএলও) ‘ডিসেন্ট ওয়ার্ক ডিকেড : এশিয়া, প্যাসিফিক এ্যান্ড দ্য আরব স্টেট’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে মারাত্মক এক তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হচ্ছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী এ তরুণরা শিক্ষায় নেই, প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন না, চাকরিতেও যোগ দিতে পারেননি। ‘আইএলও’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ অঞ্চলের ২১টি দেশের মধ্যে খারাপ অবস্থার দিক থেকে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে। আমাদের চেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে মালদ্বীপ ও ইয়েমেন। নিষ্ক্রিয় তরুণের হার ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে অনেক কম বলে ‘আইএলও’ তার প্রতিবেদনে দাবি করেছে। প্রশ্ন : এই পরিসংখ্যান কী বাস্তবভিত্তিক? এ পরিসংখ্যানকে কী আমরা আমলে নেব? আমি নিবন্ধের শুরুতে কয়েকটি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছি। কথা হচ্ছে নিষ্ক্রিয় তরুণদের নিয়ে। নিষ্ক্রিয় তরুণ কারা? যারা লেখাপড়া করে না, চাকরিও করে না, কোন প্রশিক্ষণও নিচ্ছে না। এই তিনটি ‘ক্রাইটেরিয়া’ পূরণ করলেই সেই তরুণ ‘নিষ্ক্রিয়’। আমি যে তিনটি উদাহরণ দিলাম, সেই উদাহরণের তরুণরা ‘নিষ্ক্রিয়’ সন্দেহ নেই। বলাবাহুল্য, এ ধরনের তরুণের অভাব দেশে নেই। আমি যখন এসব উদাহরণ দেখি তখন মনে কোন প্রশ্ন জাগেনি। মনে করেছি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। হয়ত সারাদেশের অবস্থা এমন নয়। কিন্তু এখন ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার’ জরিপে দেখা যাচ্ছে সত্যি সত্যি নিষ্ক্রিয় তরুণের সংখ্যা আমাদের দেশে প্রচুর। এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আমাদের অবস্থা বেশ খারাপ। এদিকে আমরা কিন্তু অভ্যস্ত হয়েছি অন্য খবরে। দীর্ঘদিন যাবত আমরা বিশ্বাস করেছি বাংলাদেশ তরুণের দেশ। দেশের অধিকাংশ মানুষই তরুণ। তরুণরাই পারে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাতে। উন্নত দেশসমূহ, ইউরোপ ও আমেরিকার দেশসমূহ, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে তরুণের অভাব। তাদের দেনা বৃদ্ধির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ কারণেই তারা আমাদের মতো দেশ থেকে লোক নিচ্ছে, যা নিয়ে এখন আবার নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। তারা মনে করছে প্রবাসীরা তাদের চাকরি নিয়ে নিচ্ছে। যাক সে ভিন্ন কথা। আসল কথা উন্নয়নের জন্য, শ্রমের জন্য, মেধার জন্য, প্রতিযোগিতার জন্য দরকার ক্রিয়াশীল তরুণের। আমাদের জনসংখ্যায় তরুণের সংখ্যা বেশি। আমরা ভেবেছিলাম এটা আমাদের সম্পদ ভবিষ্যতের জন্য। একেই আমরা আখ্যা দিয়েছিলাম। ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বলে। এখন দেখা যাচ্ছে তরুণ আছে ঠিকই, কিন্তু এদের বিরাট সংখ্যক হচ্ছে নিষ্ক্রিয়। লোক দিয়ে কী হবে। যদি কাজের লোক না থাকে। দেখা যাচ্ছে অবস্থা তাই। আমি খুশি হতাম যদি আমার অভিজ্ঞতার সঙ্গে ‘আইএলও’র জরিপের কোন মিল না থাকত। কিন্তু তা নয়, এজন্য প্রথমেই বলেছি এমন সব পরিসংখ্যান এখন আসছে। যা মাথা আওলিয়ে দিচ্ছে। এখন করণীয়? দেশে কর্মীর অভাব। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্পে কয়েক লাখ বিদেশী কাজ করে। আমাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও দক্ষতা এসব কাজের জন্য উপযোগী নয়। আমরা বিএ, এমএ, বিবিএ, এমবিএ নামে যেসব ছেয়েমেয়ে তৈরি করছি তাদের বিরাট সংখ্যকই কোন কাজের নয়। প্রয়োজনের তুলনায় তাদের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা নেই। দেশে শত শত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, বিজনেস স্কুল ইত্যাদি গড়ে উঠছে। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের চারটি পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। তাদের হাতে বই তুলে দেয়া হচ্ছে কিন্তু শিক্ষার গুণগতমান সর্বকালের মধ্যে সর্বনিম্নে। কারিগরি শিক্ষা অবহেলিত। বিজ্ঞান, অঙ্ক, ইংরেজী এমনকী বাংলা পড়ানোর মতো শিক্ষক নেই প্রাথমিক ও সেকেন্ডারিতে অথচ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যত্রতত্র। ‘ফাউন্ডেশন’ নেই, বিল্ডিং দোতলাÑ এই হচ্ছে অবস্থা। এমতাবস্থায় নতুনভাবে ভাবতে হবে। ‘নিষ্ক্রিয়’ নয়, কাজের উপযোগী ছেলেমেয়ে তৈরি করতে হবে। বিদেশে চাকরির সুযোগ দেশে ‘নিষ্ক্রিয়’ লোক তৈরি করছে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। নিষ্ক্রিয় লোক আবার সবসময় ‘নিষ্ক্রিয়’ থাকবে না। বাজে কাজে জড়িয়ে যেতে পারে। হচ্ছেও তাই। এমতাবস্থায় পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ও চাকরি প্রাপ্তির সুযোগ ইত্যাদিকে পর্যবেক্ষণের মধ্যে আনা দরকার। কর্মমুখী শিক্ষা কীভাবে উদ্ভাবন করা যায় সেদিকে নজর দেয়া দরকার। নতুবা নিষ্ক্রিয় তরুণরা দেশের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×