ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গৌতম পাণ্ডে

রবীন্দ্র আবহে হেলেন কেলার

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২২ ডিসেম্বর ২০১৬

রবীন্দ্র আবহে হেলেন কেলার

শুধু মুখের ভাষাই মুখ্য নয়, আছে ইশারার ভাষাও। প্রতিটা ভাষার আলাদা ইশারার ভাষা আছে কিনা জানা নেই, তবে আমেরিকা, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার ভাষা এক হলেও ইশারার ভাষা কিন্তু আলাদা। আছে আন্তর্জাতিক ইশারার ভাষাও। যারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তারা মুখে বলেন আর কানে শোনেন, পড়েন ব্রেইল পদ্ধতিতে। কিন্তু যারা একই সঙ্গে শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তাদের উপায় কি? কিংবদন্তিসম হেলেন কেলারের শিক্ষা হয়েছিল অভিনব উপায়ে। তার শিক্ষিকা এবং চিরবান্ধবী এ্যানি সুলিভান তার এক হাত রাখতেন যে জিনিসটার নাম শেখাতে চান, অন্য হাতের ওপর সেই নাম লিখতেন। যেমন, একটা হাত পানির কলের নিচে রাখলেন, অন্য হাতে লিখলেন ও-য়া-টা-র। এভাবেই শুরু হয়েছিল শিক্ষাজীবন যার স্থায়িত্ব ছিল ৪৯ বছর। প্রচ- ইচ্ছেশক্তি মানুষকে যে কত আলোকিত করতে পারে, তার বড় উদাহরণ হেলেন কেলার। তিনি তার সব শারীরিক অক্ষমতাকে মানসিক শক্তি দিয়ে জয় করে হয়ে উঠেছিলেন একজন চিন্তাশীল-সৃষ্টিশীল মানুষ। যে মানুষটি সব সময় বলতেন, ‘অন্ধত্ব নয়, অজ্ঞতা ও অনুভূতিহীনতাই দুনিয়ার একমাত্র দুর্ভেদ্য অন্ধকার।’ অন্ধ, বোবা, কালা হয়েও জ্ঞানেগুণে এবং তার লেখার মধ্য দিয়ে তিনি একজন বিশ্ব ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। বিশ্বের বিস্ময় এই মহীয়সী নারী হেলেন কেলারের জীবন-কর্ম-স্বপ্ন-সংগ্রাম-দর্শন দৃশ্যকাব্যে তুলে এনেছে ঢাকার স্বনামধন্য নাট্য সংগঠন স্বপ্নদল। ‘হেলেন কেলার’ নাটকটি লিখেছেন এ প্রজন্মের নাট্যকার অপূর্ব কুমার কু-ু। নির্দেশনা দিয়েছেন স্বপ্নদলের কর্ণধার জাহিদ রিপন। নাটকটিতে একক অভিনয়ে অংশ নিয়েছেন জুয়েনা শবনম। আন্তর্জাতিক একক-অভিনয় নাট্যোৎসব উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনে নাটকটির উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয় ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। নাটকটি দলের ১৭তম প্রযোজনা। এর প্রযোজনা ব্যবস্থাপনায় শাখাওয়াত শ্যামল। অন্ধ ও বধির নারী হওয়া সত্ত্বেও প্রবল আত্মবিশ্বাস আর শিক্ষয়িত্রী এ্যানি সুলিভানের অতি-মানবিক প্রেরণায় হেলেন কেলারের সকল নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনী ‘হেলেন কেলার’। একজন আলোকিত মানুষকে দৃশ্যকাব্যে রূপদান খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়। এই স্পর্শকাতর ও কঠিন দায়িত্বটি পালন করার চেষ্টা করেছেন অপূর্ব কুমার কু-ু। পুরো নাটকটিতে রয়েছে হেলেন কেলারের আত্মকথন। যখন তিনি তার কর্মক্ষমতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন। বার্ধক্যে এসে তিনি জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করছেন। নাটকে উঠে এসেছে রবীন্দ্রমানসে প্রভাবিত হেলেন কেলার ও তার শিক্ষয়িত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষ্য। কেমন করে সাত বছরের ছোট্ট মেয়ে হেলেনের মুখোমুখি হলেন তার শিক্ষক এ্যানি সুলিভান। কেমন করে অন্ধ এই শিশুকে স্পর্শের মাধ্যমে জগতকে চেনাতে লাগলেন। আলোর ছোঁয়া অন্ধকারের অনুভূতির তফাত বোঝালেন। কল চালিয়ে হাতের ওপর বয়ে যাওয়া তরলকে চেনালেন ‘জল’ বলে। অবাক হলো সে শিশু। একে একে পরিচয় ঘটল বাড়ির আসবাবপত্র, টেবিল, চেয়ার, বিছানা ইত্যাদির সঙ্গে। এ ছাড়া উঠে এসেছে চার্লি চ্যাপলিন-মার্ক টোয়েন-কেনেডি-আইনস্টাইন প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যে তার জীবনে সম্ৃদ্ধির কথা। উঠে আসে নারীজাগরণ-মানবতাবাদের পক্ষে এবং যুদ্ধ-ধ্বংস-সহিংসতা-বর্ণবাদ তথা আণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে তার স্পষ্ট অবস্থানের কথা। তার বিরুদ্ধে অসত্য অভিযোগে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর বিষয়টিও রয়েছে এতে। পাশাপাশি রয়েছে ব্যক্তি জীবনের নানা পূর্ণতা-অপূর্ণতার প্রসঙ্গও। অজস্ত্র প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রকাশিত ও বিকশিত হয়ে মানবকল্যাণে নিবেদিত হতে পারাটাই যে জীবনের চূড়ান্ত সার্থকতাÑএ উচ্চাঙ্গের শিক্ষাই শেষাবধি প্রধান হয়ে ওঠে হেলেন কেলারের জীবনীনির্ভর এ নাট্যপ্রযোজনায়। নাটকটি ঘিরে ছিল রবীন্দ্রনাথের গান। আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, চোখের আলোয় দেখে ছিলেম, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে, হে নুতন দেখা দিক আরবার, আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে, ভালবাসি ভালবাসি, আমি চঞ্চল হে এবং সবশেষে ছিল আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা। এ গানগুলো নাটকের মানকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। প্রতিটি গানের সঙ্গে হেলেনের জীবনের যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, তা পরতে পরতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন নির্দেশক জাহিদ রিপন। তবে অভিনেত্রী জুয়েনা শবনম অভিনয়ে সাধ্যমতো চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। একজন আলোকিত ব্যক্তিকে দৃশ্যকাব্যে তুলে ধরা যেমন কঠিন, তেমনি অভিনেত্রীর অভিনয়ের দক্ষতাও এখানে উপেক্ষিত নয়। এককভাবে শুধুমাত্র সংলাপ বলার প্রবণতা বেশি ছিল এ নাটকে। পাশাপাশি উচ্চারণের দিকেও লক্ষ্য দেয়া উচিত বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। নাটক শেষে অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার বলেই ফেলেন, রবীন্দ্রনাথের গানই নাটকটিকে বেশি সমৃদ্ধ করেছে। তবে নাটকের ভাষাগুলো কিছুটা সরস ও সহজবোধ্য হওয়া এবং অভিনেত্রীর উচ্চারণে যতœবান হওয়া উচিত। স্বপ্নদলের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য জুয়েনা শবনম হেলেন কেলারের যথাযথ উপস্থাপনে সামর্থ্যরে সর্বোচ্চ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। যা হোক হেলেন কেলার সবার জন্য এক মাইল ফলক। তার চিন্তাশীলতা, ইচ্ছেশক্তি সব কিছুই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রভাবিত হবে এটাই মুখ্য বিষয়। হেলেন কেলার সব সময়ই সবার কাছে সমসাময়িক। নির্দেশকের কথায়, শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ হওয়ার পরেও কীভাবে একজন মানুষ আপন চেষ্টায় এবং একজন অসামান্য শিক্ষকের সাহচর্যে সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে গগন-উচ্চতায় পৌঁছতে পারে তার প্রমাণ হেলেন কেলার। তাই তিনি হতে পারেন সব নেতিবাচকতার বিপরীতে আমাদের আদর্শ ও প্রেরণা। ‘হেলেন কেলার’ প্রযোজনা মঞ্চায়নে এ বিষয়টিই ছিল আমাদের অন্তর্গত প্রেরণা। ‘হেলেন কেলার’ উপস্থাপনায় প্রাচ্যের বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতির সঙ্গে পাশ্চাত্যের কারিগরি সুবিধার মিলন ঘটানো হয়েছে। মনোড্রামা মঞ্চায়নে স্বপ্নদলের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ডিজাইনাররা চেষ্টা করেছেন সামর্থ্যানুযায়ী ভাল কিছু করার। নাটকটির মঞ্চসজ্জা এবং আলোক নিক্ষেপণে ফজলে রাব্বি সুকর্ণর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। এ ছাড়া সঙ্গীত-আবহ পরিকল্পনা : তানভীর শেখ ও সোনালী রহমানের আবহসঙ্গীত পরিকল্পনাও ছিল ভাল।
×