ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরায় বিজয়ের বইমেলা

মূল শহরের বাইরে বড় আয়োজন, নতুন বইয়ের সম্ভার

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২২ ডিসেম্বর ২০১৬

মূল শহরের বাইরে বড় আয়োজন, নতুন বইয়ের সম্ভার

মোরসালিন মিজান ॥ সব আছে। একদম ঠিকঠাক। শুধু বই নেই। পাঠাভ্যাস গত হয়েছে বাঙালীর। গত হয়েছে বললে খুব ভুল বলা হবে না। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্ম জ্ঞানার্জনের এই অফুরান উৎসটি থেকে নিজেদের কেমন যেন বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এ অবস্থায় একমাত্র ভাল খবরটি হলো- হাল ছাড়েননি প্রকাশকরা। অনেকদিন ধরেই একটি যুদ্ধ তারা করছেন। পাঠক সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে। আশার কথা যে, সরকারও থাকছে এসব উদ্যোগের সঙ্গে। প্রকাশকদের পাশে নিয়ে নতুন নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। একেবারে সাম্প্রতিক উদাহরণটি ‘বিজয়ের বইমেলা।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের সর্ববৃহৎ এবং সমৃদ্ধ আয়োজন অমর একুশে গ্রন্থমেলা। যানজট ঠেলে দূর-দূরান্ত থেকে বাংলা একাডেমির মেলায় আসা চাট্টিখানি কথা নয়। বহু মানুষ তবু আসেন। আবার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকে আসতে পারেন না। বিষয়টি মাথায় রেখে উত্তরায় আয়োজন করা হয়েছে ‘বিজয়ের বইমেলা।’ বুধবার আজমপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। বড় পরিসরে আয়োজনে অংশ নিয়েছে ৮৫টি প্রতিষ্ঠান। জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির অংশগ্রহণ বিশেষভাবে দৃশ্যমান। ৮০টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নিয়ে মেলায় রয়েছে সমিতি। দেশের খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই মেলায় আছে। মাওলা ব্রাদার্সের সামনে গিয়ে দেখা গেল, বিভিন্ন সময় প্রকাশিত বইয়ের সমাহার। প্রকাশিত প্রায় সব বই আছে স্টলে। নতুন বইয়ের মধ্যে চোখে পড়ল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন : জীবন ও কর্ম গ্রন্থটি। দেশীয় চারুকলার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করা মহান শিল্পীর কাজ ও জীবনের নানা দিক নিয়ে লিখেছেন জাহাঙ্গীর হোসেন। অন্য প্রকাশে যথারীতি হুমায়ূন আহমেদ প্রধান। অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক প্রয়াত হলেও, তার বই নিয়ে কৌতূহলের এখনও শেষ নেই। স্টলের সামনে তাই ভিড় করেছিলেন পাঠক। বিগত দিনে প্রকাশিত সব বই এখানে দেখা গেল। পাশাপাশি রয়েছে নতুন বই। কিছুদিন আগে প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদ রচনাবলীর দুটি খ- পাওয়া যাচ্ছে বিজয়ের মেলায়। এর আগে প্রকাশিত হয়েছিল অষ্টম খ- পর্যন্ত। এবার এসেছে নবম ও দশম খ-। উৎস প্রকাশনের স্টলে বরাবরের মতোই মরমী সাহিত্য। সিলেট অঞ্চলের লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে প্রকাশিত বই দিয়ে স্টল সাজানো। এখানে নতুন প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘করিম সন্দর্শন।’ সম্পাদনা করেছেন হেনা নূরজাহান। সুফীবাদ নিয়ে লিখেছেন আফজল শাহ। বইয়ের শিরোনাম ‘রিসালায়ে মারিফাত।’ আগামী, কথা প্রকাশ, অনন্যা, বিদ্যা প্রকাশ, অনুপম, অনিন্দ্য, তাম্রলিপিসহ কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হয়েছে, পুরনোর পাশাপাশি আছে নতুন বইও। মেলায় সরকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, নজরুল ইনস্টিটিউট, শিশু একাডেমি ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন। বাংলা একাডেমির স্টলে প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের সম্ভার। নজরুল ইনস্টিটিউটের স্টলেও অত্যন্ত সমৃদ্ধ প্রকাশনা। উত্তরায় প্রথমবারের মতো এমন আয়োজন। ফলে এদিন স্থানীয়দের মধ্যে দেখা যায় বাড়তি কৌতূহল। উদ্বোধনের আগেই অনেকে আসতে শুরু করেন। বিভিন্ন বয়সী পাঠক মেলার স্টল ঘুরে দেখেন। পছন্দের বই খুঁজতে দেখা যায় তাদের। আমিনা সুলতানা মেলায় এসেছিলেন দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, যত রকমের চর্চা, আচার, অনুষ্ঠান সবই ওই শাহবাগ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। বিজয়ের বইমেলা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বাসার কাছে মেলা। তাই মনের আনন্দে বই দেখার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু আজকের প্রজন্ম কি বই পড়ে? এমন প্রশ্নের উত্তর দেন আবিদা শেলী। দুই বাচ্চাকে নিয়ে মেলায় এসেছিলেন তিনি। বললেন, আমি বই পড়ে বড় হয়েছি। এখন সময়টা তথ্য প্রযুক্তির। ছেলেমেয়েরা পাঠ্য বই পড়ে সময় পায় না। তবে পাঠাভ্যাস না গড়ে উঠলে ভবিষ্যতে ওদের ঠকতে হবে। তাই মেলায় নিয়ে আসা বলে জানান তিনি। নতুন আয়োজন সম্পর্কে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ওসমান গণি বলেন, প্রকাশ করা নয় শুধু, আমরা বই নিয়ে পাঠকের আরও কাছে যেতে চাই। এরই অংশ হিসেবে উত্তরায় আসা। শহর ঢাকার এই অংশে বহু মানুষের বাস। অনেকে ইচ্ছা সত্ত্বেও বাংলা একাডেমির বই মেলায় আসতে পারেন না। তাছাড়া শহরে বইয়ের দোকান হাতেগোনা। এ অবস্থায় বিজয়ের মাসে বিশেষ বইমেলার আয়োজন। উত্তরার মানুষ সুযোগটি কাজে লাগাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এর আগে মেলার উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আকতারী মমতাজের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মোঃ আখতারুজ্জামান। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ওসমান গণি। প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মন্ত্রী বলেন, আমরা প্রতিবছর বাংলা একাডেমিতে অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করে থাকি। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত মেলা একমাস ধরে চলে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের পক্ষে মেলায় আসা মুশকিল হয়ে যায়। বিশেষ করে ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসা-যাওয়া করা খুব কঠিন। এ কারণে উত্তরায় বিজয় মেলার আয়োজন করা হয়েছে। প্রকাশকদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিবছর এই মেলার আয়োজন করা হবে বলে ঘোষণা দেন মন্ত্রী। এ সময় করতালি দিয়ে সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান স্থানীয়রা। পাঠাভ্যাসের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে মন্ত্রী বলেন, বেশি বেশি পাঠ্য বই পড়লে, পরীক্ষায় ভাল ফল করলেই জ্ঞান অর্জন হয় না। দুঃখের সঙ্গে বলি, অনেক অভিভাবক এমনকি শিক্ষকরা মনে করেন জিপিএ ফাইভ পেলে সব পাওয়া হয়ে গেল। আসলে তা নয়। ছেলেমেয়েদের আলোকিত মানুষ করে গড়ে তুলতে বই পড়ার ওপর জোর দেন মন্ত্রী। দশ দিনব্যাপী মেলা চলবে ডিসেম্বরের শেষদিন পর্যন্ত। সাধারণ দিনগুলোতে বিকেল ৩ টায় শুরু হয়ে চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। সরকারী ছুটির দিনে উন্মুক্ত থাকবে বেলা ১১ টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।
×