ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দেবশ্রী চক্রবর্তী, কলকাতা থেকে

এ এক অন্য বিরাট

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২১ ডিসেম্বর ২০১৬

এ এক অন্য বিরাট

আমার পাশের ফ্লাটে টিনা বৌদির ছেলের নামকরণ অনুষ্ঠানে ছুটে গেছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি প্রদীপে একটি নাম জ্বল জ্বল করছে, আশপাশে আর কোন প্রদীপ না দেখে প্রশ্ন করে জেনেছিলাম, একটা নামই যথেষ্ট, আর তা উজ্জ্বল হয়ে আলো দিচ্ছে যখন, এর থেকে ভালো কথা আর কি হতে পারে! সবই ঠিক আছে কিন্তু বাঙালী ছেলের এই নাম। সে দিন বাড়ি ফিরে নিজের মনে হেসেছিলাম, কিন্তু কিছু দিন পর সেই নাম যখন দেখতে পেলাম আমার ১০ বছরের মেয়ে ফ্রুটির খাতার পেছনের পাতায় তখন সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। একজন ক্রিকেটারের নাম যখন ২২ গজের বাইরে বেরিয়ে সদ্যজাত শিশুর নামকরণের প্রদীপ থেকে ১০ বছরের বালিকার খাতার পেছনের পাতায় স্থান নেয়, তখন একটা কথা বুঝে নিতে হয় সেই ক্রিকেটারের ক্রিকেট ময়দানের বাইরে দূরদূরান্ত পর্যন্ত আলোকিত হয়ে আছে , তিনি আর কেউ নন, ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমের টেস্ট ক্যাপ্টেন, বিরাট কোহলি। কিন্তু তার ক্রিকেট জীবনের কথা না, এ এক অন্য জীবন যা সাফল্যের আলোর পাশে অন্ধকারই থেকে যায়। বিরাটের চরিত্রটা অনেকটা অপ্রতিরোদ্ধ যোদ্ধার মতন কিংবা একটা ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক ঝড়ের মতন, যার আক্রমণের সামনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যান তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা। কিন্তু মাঠের বাইরে সে একজন সমাজ সেবক হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। কিছু দিন আগে আইপিএল ম্যাচ চলাকালীন তিনি ময়দান থেকে উধাও হয়ে যান এবং বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি ফিরে জানান যে তিনি পুনের “অভলমায়া” বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে তার ম্যাচের অর্জিত অর্থের ৫০% দান করে এসেছেন। পাঠকরা হয় তো ভাববেন এ কোন বিরাট ? শুধু তাই নয়, বিরাট কোহলি ফাউন্ডেশন এখন পর্যন্ত একটি অলাভজনক সংস্থা অনরষ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন বৃদ্ধ মানুষদের পাশে আরও সক্রিয় ভাবে দাঁড়াতে। বিরাট কোহলি চ্যারিটেবেল ফাউন্ডেশন শুধু মাত্র বৃদ্ধ না তারা দরিদ্র শিশুদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের জন্য সারাবছর বহু কাজ করেন। কিছু দিন আগে মুম্বাই হায়াতে “স্মাইল” নামে একটি সমাজ সেবী সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে তারা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, যেখানে বহু দুঃস্থ শিশুর হাতে সাহায্য তুলে দেয়া হয় । বিরাট নামটির এখানেই স্বার্থক। একজন বড় মনের মানুষই মনে হয় সফল হতে পারেন। এই দানবীর বিরাটের আরেকটি চারিত্রিক দিক হচ্ছে স্পর্শকাতরতা। একটা ছোট্ট সংখ্যা ১৮। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে তার চরিত্রের অন্যতম এক দিক। খেলোয়াড়দের জার্সির পেছনে থাকে একটি নম্বর। খেলোয়াড়দের কল্যাণেই এক সময় বিখ্যাত হয়ে যায় কিছু নম্বর। ফুটবলে যেমন ১০ নম্বর জার্সি বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পেলে, দিয়াগো ম্যারাডোনা ও লিওনেল মেসির ছবি। আবার ৭ নম্বর জার্সিকে মহামন্বিত করেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। ক্রিকেটেও ৭ নম্বর জার্সিটা বেশ জনপ্রিয়। ‘মিস্টার কুল’ খ্যাত ভারতের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি পরেন ৭ নম্বরের জার্সি। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিব আল হাসান ৭৫ নম্বর জার্সিটাকে ট্রেডমার্ক বানিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু বিরাট কোহলির এই নম্বরের পেছেনের রহস্যটা কী? এত নম্বর থাকতে ১৮ কেন? খেলোয়াড়দের সঙ্গে কুসংস্কারের একটা সম্পর্ক রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা জার্সি কিংবা জুতা বিশেষ খেলোয়াড়ের কোনও বিশেষ জিনিস ব্যবহারের কারণটা হয় কুসংস্কার। তবে কি বিরাটও কোন কুসংস্কারের জন্যই পরেন ১৮ নম্বর জার্সি? না, কুসংস্কার নয়। ১৮ নম্বরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিরাটের অনেকখানি আবেগ ও ভালোবাসা। কি সেই কাহিনী? ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৬। কোহলি তখনও আজকের কোহলি নন। ভারতের নীল জার্সি তখনও তার গায়ে ওঠেনি। ওই দিন বিরাট হারিয়েছিলেন তার বাবাকে। বাবাই ছিলেন তার ক্রিকেট জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। ছেলে দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলবে, এটাই ছিল বিরাটের বাবা প্রেম কোহলির স্বপ্ন। সে স্বপ্ন আজ সত্যি। কিন্তু দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য তার হয়নি। সেই সময় বিরাটের বয়স ছিল ১৮। ১৮ বছর বয়সে ১৮ তারিখে বাবাকে হারিয়েছিলেন কোহলি। তাই এই সংখ্যাটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে জার্সিতে রেখে দিয়েছেন তিনি। তার জন্য এটা শুধু একটা নম্বর নয়, আবেগ ও ভালোবাসা। বাবা ছিলেন তার জীবনের প্রেরণা, ভারতীয় ক্রিকেটের শেষ কথা এখন বিরাট কোহলি। জানেন কি একসময় কোহলির কেবল এক জোড়া জামাকাপড় ছিল? এই কথা জানিয়েছেন বিরাটের দাদা বিকাশ। বিকাশের কাছ থেকেই জানা যায়, একসময় বিরাট কোহলির ছিল একটা স্কুলের ইউনিফর্ম। অপরটি ক্রিকেট ইউনিফর্ম। এই থেকেই ছেলেবেলায় কোহলির পছন্দ জানা যায়। অন্যদিকে মনই ছিল না কোহলির। কেবল ক্রিকেট আর ক্রিকেট। ক্রিকেটই ছিল বিরাটের আত্মার শান্তি, মনের আনন্দ। তিন বছর বয়সে হাতে ব্যাট তুলে নিয়েছিলেন বিরাট কোহলি। ছোট বিরাট বাবা প্রেমকে বল ছুড়তে বলতেন। কলোনিতে গলি ক্রিকেটও খেলতে দেখা যেত বিরাট। বিরাটের খেলা দেখে এক প্রতিবেশী একদিন বাবা প্রেম কোহলিকে বলেন, ‘ছেলেকে এ্যাকাডেমিতে ভর্তি করুন।’ গলি ক্রিকেট খেলে সময় নষ্ট করার থেকে প্রতিভার বিকাশ ঘটানো উচিত। প্রতিবেশীর এ হেন সুচিন্তিত পরামর্শ শোনার পরে প্রেম কোহলি বিরাটকে ভর্তি করে দেন নয়ডার কাছে সুমিত ডোগরা এ্যাকাডেমিতে। ২০০৬ সালে বিরাট যখন রঞ্জি ট্রফি খেলছেন কর্নাটকের বিরুদ্ধে, সেই সময় ম্যাচের আগের দিন তার বাবা মারা যান। কিন্তু তারপরেও ম্যাচ ছেড়ে যাননি বিরাট। পরের দিন ম্যাচে তার ব্যাট থেকে আসে রানের ঝড়। তিনি ৯০ রান করেন কর্নাটকের বিরুদ্ধে। এ হয় তো তার বাবার প্রতি তার শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
×