ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আন্দোলনকারী শ্রমিকরা কাজে না ফিরলে ব্যবস্থা॥ মুজিবুল হক চুন্নু

অনির্দিষ্টকালের জন্য ৫৫ গার্মেন্টস বন্ধ ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২১ ডিসেম্বর ২০১৬

অনির্দিষ্টকালের জন্য ৫৫ গার্মেন্টস বন্ধ ঘোষণা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে বাধ্য হয়ে সাভারের আশুলিয়ায় ৫৫ কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। আশুলিয়াতে টানা ৯ দিন শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়ে মঙ্গলবার বিকেলে বিজিএমইএ ভবনে জরুরী সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান এ কথা বলেন। তিনি বলেন, আজ থেকে এসব কারখানায় শ্রমিকরা যত দিন কাজে যোগ না দেবে, তত দিনের বেতন তারা পাবে না। সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ’র বর্তমান ও সাবেক নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এ দুর্যোগ একা আমাদের নয়, দেশের জন্যও। এ দুর্যোগ আমাদের বাঁচা-মরার। পোশাকখাতের এ দুর্যোগ মোকাবেলায় তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, অত্যন্ত দুঃখজনক, আমরা যখন বৈশ্বিক ও আর্থিক এ দ্বিমুখী চাপের মধ্যে থেকেই টিকে থাকার সংগ্রামে রয়েছি- ঠিক তখন অর্থনীতির মেরুদ- ভেঙ্গে দিতে শুরু হয়েছে নানা অপতৎপরতা। বিশেষ করে আমাদের শান্ত শ্রমিক গোষ্ঠীকে উস্কানি দিয়ে অশান্ত করা হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে বহিরাগতদের উস্কানিতে আশুলিয়া এলাকার শ্রমিক ভাই-বোনদের নতুন মজুরি কাঠামো গঠন ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। কর্মবিরতি পালন করছে। অথচ এ মুহূর্তে নতুন মুজরি কাঠামো গঠনের কোন যৌক্তিকতা নেই। শ্রম আইন অনুযায়ী ৫ বছর পর পর মজুরি কমিশন গঠনের বিধান রয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, সর্বশেষ ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার পর তিন বছর অতিক্রম করেছে। আরও দুই বছর পর নতুন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এছাড়া বিগত ছয় বছরে পোশাক খাতের ন্যূনতম মজুরি ২২৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। কারখানা বন্ধের বিষয়ে বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিগত ৯ দিন যাবত আশুলিয়া অঞ্চলে শ্রম সমস্যা বিরাজ করছে। শুরুতে একটি কারখানায় সমস্যা থাকলেও পরবর্তীতে তা ৩/৪টি কারখানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তবে গত তিন দিনে এ সমস্যা প্রতিদিন ক্রমেই বাড়ছে। শ্রমিকরা কারখানায় এসে কার্ড পাঞ্চ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কারখানায় মালিকরা এ বিষয়ে যথেষ্ট ধৈর্য ধরেছেন। সিদ্দিকুর রহমান সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এ শিল্পকে নিয়ে যারা চক্রান্ত করছে, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিন। যদি প্রয়োজন হয়, সংসদে নতুন আইন প্রণয়ন করে অর্থনীতি ধ্বংসকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করুন। যাতে করে আর কেউ শিল্পকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। এসই সঙ্গে শিল্প-কারখানা চালানোর জন্য আমাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিন। বেতন বৃদ্ধির দাবিতে সাভারের আশুলিয়ায় পোশাক কারখানার আন্দোলনকারী শ্রমিকরা কাজে না ফিরলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু। শ্রমিকদের মঙ্গলবারই কাজে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে দুপুরে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমার এই অনুরোধের পর যদি কাজে না আসেন, তা হলে আইনগতভাবে যা যা করার তাই করা হবে। গত এক সপ্তাহ ধরে আশুলিয়ার অর্ধশতাধিক পোশাক কারখানার হাজার হাজার শ্রমিক সর্বনিম্ন বেতন ১৫ হাজার টাকা করার দাবিতে কর্মবিরতিসহ বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। এ আন্দোলন উদ্দেশ্যমূলক মন্তব্য করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমার মনে হয় কিছু কিছু মহল, কোন কালো হাত, কেউ সরকারের ভাল চায় না, কেউ এই সেক্টরের ভাল থাকুক চায় না, সেটা হতে পারে দেশী-বিদেশী, তারাই এ কাজটা করছে বলে মনে হয়। এটা আমরা বের করার চেষ্টা করছি এবং বের করতে পারব আশাকরি। শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি শ্রমিক ভাইদের অনুরোধ জানাব তারা যাতে অনতিবিলম্বে এ কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে কাজে যোগদান করেন। কারণ তাদের এ কর্মবিরতিটা শ্রম আইন অনুযায়ী সম্পূর্ণভাবে অবৈধ, এর আইনগত কোন ভিত্তি নেই। এ অবৈধ ও অন্যায় কাজটি না করার জন্য আমি শ্রমিক ভাইদের আহ্বান জানাব। বেতন বৃদ্ধি, ঘর ভাড়া না বাড়ানো, কথায় কথায় ছাঁটাই না করাসহ বিভিন্ন দাবিতে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের জামগড়া, বেরন, বাইপাইল, নরসিংহপুরসহ আশপাশে বিভিন্ন পোশাক কারখানায় শ্রমিকরা গত আট দিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সোমবার রাতে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বাসায় ৪২টি শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। চুন্নু বলেন, শ্রমিকদের এই কর্মবিরতি শ্রম আইন অনুযায়ী অবৈধ। তাদের উচিত ‘সংগঠনের মাধ্যমে আইনগতভাবে’ এগিয়ে আসা এবং নিজেদের বক্তব্য লিখিতভাবে সরকারকে জানানো। অন্যায়ভাবে যদি দাবি আদায় করতে চান তাহলে সরকার এ ব্যাপারে কঠোর। কারণ এই সেক্টর আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এই সেক্টরে কোন অন্যায় আবদার, কোন অসৎ পথে, পেছনের পথে কেউ যদি কিছু করতে চান সেটা বরদাস্ত করা হবে না। জানুয়ারি থেকেই পোশাক শ্রমিকদের সহায়তা শুরু হচ্ছে ॥ শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, পোশাক শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য গার্মেন্টস মালিকদের বলে আমরা একটা আইন করেছি, একটি ফান্ড গঠন করেছি। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে আমরা এ ফান্ডে টাকা কেটে রাখছি মালিকদের কাছ থেকে। ইতোমধ্যে প্রায় ২৫ কোটি টাকা ফান্ডে আসছে। প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা এ ফান্ডে আসবে। এ ফান্ডের পুরো টাকাটাই আমরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করব। তিনি বলেন, আমি ঘোষণা করছি আগামী জানুয়ারি মাস থেকে যদি কোন পোশাক শ্রমিক কর্মস্থলে মারা যায় তার পরিবার ৫ লাখ টাকা পাবে আমাদের এ ফান্ড থেকে। এ ফান্ড থেকে পোশাক শ্রমিকদের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ৩ লাখ টাকা, শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা সহায়তা দেয়া হবে। তিনি বলেন, টঙ্গীতে শ্রম বিভাগের জায়গায় শ্রমিকদের জন্য ২০০ বেডের স্পেশালাইজড হসপিটাল আমরা করছি। মহিলা শ্রমিকদের নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও গাজীপুরে ডরমেটরি করছি। এগুলো টেন্ডার পর্যায়ে রয়েছে। মন্ত্রীদের আশ্বাসের পরও শ্রমিক অসন্তোষ চলছে ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা সাভার থেকে জানান, ন্যূনতম মজুরি ১৫ হাজার টাকা ধার্যসহ ১৬ দফা দাবি আদায়ে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় শ্রমিক অসন্তোষ অব্যাহত রয়েছে। মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের আশ^াসের পরও কাজে যোগ দেয়নি শ্রমিকরা। মঙ্গলবারও দাবি আদায়ে বিক্ষোভ করেছে অর্ধশত তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের কাজে ফেরাতে আশুলিয়া গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের উদ্যোগে শ্রমিক নেতারা আশুলিয়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনসহ শিল্প এলাকায় মাইকিং করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে আশুলিয়া গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক সরোয়ার হোসেন আন্দোলনরত শ্রমিকদের বিক্ষিপ্তভাবে কারখানা থেকে বের হয়ে কাজ বন্ধ রেখে পোশাক শিল্পের সুনাম নষ্ট না করার জন্য অনুরোধ জানান। এছাড়াও তিনি চলমান শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় যদি কারও ইন্ধন থাকে তা খুঁজে বের করে প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান। এর আগে সকালে শিল্পাঞ্চলের জামগড়া, বাইপাইল ও নরসিংহপুর এলাকার অর্ধশত পোশাক কারখানার লক্ষাধিক শ্রমিক কারখানায় প্রবেশ করে টানা অষ্টম দিনের মতো কর্মবিরতি পালন করে। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানা থেকে বের হয়ে আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়কের ঘোষবাগ, নরসিংহপুর, বেরণ, সরকার মার্কেট, ছয়তলা, জামগড়া, ইউনিক ও বাইপাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়। এ সময় উত্তেজিত শ্রমিকরা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করলে কর্তব্যরত পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জসহ টিয়ারশেল ছুড়ে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে শ্রমিকসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়। আহতদের উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। এদিন সকালে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার ‘দি রোজ ড্রেসেস লিমিটেড’, ‘এনভয় গ্রুপ’ ও ‘হা-মীম গ্রুপ’-এর শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশ করে হাজিরা কার্ড জমা দিয়ে কর্মবিরতি শুরু করে। এরপর সকাল সাড়ে আটটার দিকে এসব কারখানার শ্রমিকরা একযোগে কারখানা থেকে বের হয়ে এসে আশপাশের অন্যান্য কারখানা লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলে নিরাপত্তার কারণে তাদেরও ছেড়ে দেয় ওই সকল কারখানা কর্তৃপক্ষ। ওই সকল কারখানার শ্রমিকরাও বাইরে এসে কয়েকটি অংশে বিভক্ত হয়ে আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়কে অবস্থান নেয়। এ সময় ওই মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঘণ্টাখানেক ধরে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা মহাসড়কে অবস্থানের পরই পুলিশ মারমুখী ভূমিকা নেয়। এতে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের কয়েক দফা ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সকাল ১০টার দিকে পুলিশ বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ওপর লাঠিচার্জ করে ও টিয়ারশেল ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পুুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসে শ্রমিক ও পথচারীসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়। কাজে ফেরাতে শ্রমিক নেতাদের মাইকিং ॥ শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে মঙ্গলবার দুপুর সোয়া ১২টায় আশুলিয়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন শেষে বুধবার থেকে শ্রমিকদের কাজে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করা হয়। এছাড়া শ্রমিক অসন্তোষের জের ধরে আশুলিয়া থানা ও শিল্প এলাকায় আগামী তিন বছরের জন্য সব ধরনের বাসা ভাড়া বৃদ্ধি না করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন, বাড়িওয়ালা, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ সুশীল সমাজ।
×